বাংলাদেশে মেধা সম্পদ সংরক্ষণ, এক নতুন দিগন্তের সূচনা — প্রথম অংশ
বাংলাদেশে মেধাবৃত্তিক সম্পদ, সচেতনতা এবং প্রায়োগিক আইন এর সমন্বয় এখন সময়ের দাবি। আর সে সম্পদ যদি হয় আপনার মেধাজাত, তাহলে আপনাকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে এর সুরক্ষা বা স্থায়িত্ব।
বাংলাদেশে আমরা মেধা বা বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবনা অথবা চর্চার বিষয়ে যতটা তৎপর, ঠিক যেন ততটাই উদাসীন এর সংরক্ষণ অথবা অধিকারের বিষয়ে। বিষয়টাকে একটু সহজ করে এবং উদাহরণ সহ বললে, প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ এর প্রথম উপন্যাস “নন্দিত নরকে” র প্রসঙ্গ চলে আসে। যেটি ১৯৭২ সালে খান ব্রাদার্স কর্তৃক প্রকাশিত হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র হুমায়ুন আহমেদ বই প্রকাশের আনন্দেই আত্মহারা হয়ে ছিলেন। কিন্তু বইটি এতটা আলোচিত হবে এবং তার পরবর্তী জীবনই পালটে দেবে সেটা তার ধারনার অতীত ছিল। যখন সেই সময় আসলো ততক্ষণে তিনি বইটির সর্বস্বত্ব বেচে দিয়ে বসে আছেন। তাই একদিকে ব্যক্তিগত উদাসীনতা কিংবা অজ্ঞতা যেটাই বলি না কেন, এর সাথে যুক্ত হয়েছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, বিশদ আইনের স্বল্পতা এবং এর প্রয়োগ। এই দুইয়ের মিলনে বহুদিন ধরে এখানে তৈরি হয়েছে ভারসাম্যহীন মেধা চর্চার সংস্কৃতি। হয়তো তাতেও বড় কোনও সমস্যা হত না, সমস্যা তখনই প্রকট হতে শুরু করেছে যখন মেধাবৃত্তিক কাজটির সাথে অর্থের সংযোগ ঘটেছে এবং অন্যদিকে এর স্রস্টা তার অধিকার হারিয়েছেন। এমন অসংখ্য উদাহরণ আমাদের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
তবে বাঙালির ইতিহাসে মেধাসম্পদ বিষয়ক সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটেছিল আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর (The Inventor who wouldn’t patent) জীবনে। সে সময়ে তার রেডিও ফিজিক্স আইডিয়ার কপিরাইট অথবা রেডিওর উপরে আন্তর্জাতিক পেটেন্ট থাকলে আজকে হয়তো রেডিও আবিষ্কারের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা থাকত। কপাল মন্দ আমাদের, সেটা হয়নি।
কিন্তু যে কারণে এই ইতিহাস আবার মনে করা; আজ এত বছর পরেও আমরা কি সেই ইতিহাস থেকে কিছু শিখেছি? আজও আমরা কি আমাদের মেধা সম্পদ সংরক্ষণের ব্যাপারে যথেষ্ট সজাগ? সোজা উত্তর হল, না। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। শুধু মাত্র ব্যক্তিগত উদ্যোগে মেধা সম্পদ সংরক্ষণ কখনই সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার সামগ্রিক সচেতনতা। ব্যক্তিগত ভাবে অনেকেই বিভিন্ন সময়ে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে কাজ করেছেন, নানা ভাবে পথ দেখেনোর চেষ্টা করেছেন। এমন কি এখনও যথেষ্ট আস্থার সাথে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ভলান্টিয়ার ফর ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি (VIP) বুট ক্যাম্প। মূলত যার উদ্দেশ্য ছিল ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি নিয়ে বিস্তর আলোচনা, জনসচেতনতা তৈরি এবং সরকারিভাবে যুগোপযোগী যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। অর্থাৎ আমাদের প্রয়োজন বা সচেতনতার সাথে সরকারি সদিচ্ছার সমন্বয় ঘটানো। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু একটা - দুটা বাৎসরিক আয়োজন কি যথেষ্ট? না। প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে গণসংযোগ। সারা বছর বিভিন্ন মাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া।
কারণ আমরা টেনজিবল প্রপার্টি অর্থাৎ যা কিছুর শারীরিক অস্তিত্ব আছে, তার ব্যপারে যথেষ্ট সাবধান থাকি। যেমন জমি-জমা, বাড়ি-গাড়ি’র বিষয়ে আমাদের সচেতনতা যতখানি, তার সিকিভাগও নেই ইনটেনজিবল প্রপার্টি যথা ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি বা মেধাসম্পদের ব্যাপারে। কিন্তু সবার আগে আপনার মেধাজাত সম্পদের সংরক্ষণ আপনাকেই করতে হবে। আপনার লেখা একটা কবিতা, গান, গল্প কিংবা একটা আইডিয়া বা পেইন্টিং যাই হোক না কেন, স্রস্টা হিসাবে তার পরিচয় আপনাকেই নিশ্চিত করতে হবে। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আপনার সৃষ্টিকর্মকে মেধাস্বত্ব আইনের আওতায় না আনছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এর মালিকানা বা অধিকার বিষয়ে আপনার আইনগত ভিত্তি যথেষ্ট দুর্বল। এখানে মনে রাখা জরুরী, আইন কখনই স্বপ্রনদিত হয়ে আপনার মেধা সম্পদের সুরক্ষা দেবেনা। এটা তার এখতিয়ারের বাইরে, যদি না আপনি নিজেই আপনার সৃষ্টি কর্মের সুরক্ষা আদায় করে নিতে পারেন।
বাংলাদেশে বিরাজমান প্রকট পাইরেসি সমস্যাই প্রমাণ করে মেধাস্বত্ব নিয়ে আমাদের অবহেলা অথবা অজ্ঞতা কতখানি। যদিও দুইটা ভিন্ন বিষয়, তারপরেও এদের মধ্যকার সম্পর্ক অবিছ্যেদ্য। কারণ মেধাস্বত্ব বিষয়ক অবহেলাকে যদি আমি “ব্যাধি” বলি, তাহলে পাইরেসি হচ্ছে সেই ব্যাধির “মহামারি” বা “বিপর্যয়”। ব্যক্তি উদ্যোগে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের আবেদন করা যায় মাত্র, কিন্তু নিশ্চিত করনের জন্য দরকার যথার্থ আইনের প্রয়োগ এবং ভোক্তা হিসেবে আপনার দায়িত্বশীলতা।
আপনি হয়তো অনলাইন থেকে একটা পাইরেটেড মুভি ডাউনলোড করে দেখলেন এবং দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন। কিন্তু ভাবুন, যখন আপনার মত হাজারো মানুষ এই কাজটা করছে তখন কি বিশাল অর্থনৈতিক শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। মুভির প্রযোজককে আপনার প্রতিটা ঢেঁকুর এর মূল্য গুনতে হচ্ছে টাকার অঙ্কে, লোকসান হিসাবে। বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৭০-৮০টি চলচিত্র মুক্তি পাছে। যার পেছনে প্রযোজক লগ্নি করছেন গড়ে ৫৬ কোটি টাকা। কিন্তু শুধু মাত্র ভিডিও পাইরেসি কারণেই প্রযোজকদের প্রতিবছর গড়ে লোকসান গুনতে হচ্ছে ১৫ কোটি টাকা। অডিও মিউজিকের অবস্থা আর ভয়াবহ, যেখানে অনলাইনে প্রাপ্ত মিউজিকের ৯৯% ই পাইরেটেড, এবং যার মুখ্য ভোক্তা আপনি, আমি অথবা আমরা। তার উপরে রিলেটেড কপিরাইট এর কারণে অবশিষ্ট ১% আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশিদারিত্বে ভাগ হয়ে কর্পূরের মত মিলিয়ে যায়। তাই এমন দেশে শিল্পী অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পাবেন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই প্রেক্ষাপট আমরাই বানিয়েছি এবং এখনও মনের অজান্তেই লালন করে যাচ্ছি। সুতরাং এর থেকে উঠে আসতে হলে আমাদেরকেই সবার আগে সজাগ হতে হবে। ভোক্তা হিসেবে বিনা পয়সায় সর্বগ্রাসী হবার অভ্যাস ছাড়তে হবে। একই সাথে মেধাস্বত্ব বিষয়ক আইন এবং এর কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
অন্যদিকে অনলাইন কন্টেন্ট এর অবাধ সংযোজন-বিয়োজন যেগুলো এখনও নিতান্তই ইউজার লেভেলে আটকে আছে, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা সুনিয়ন্ত্রিত কন্টেন্ট, কন্টেন্টের অরিজিনালিটি, মেধাস্বত্ব নিয়ন্ত্রণ, সংরক্ষণ এবং অধিকার; সর্বোপরি বৈশ্বিক ভাবে এর ব্যবহারিক প্রতিফলন দেখতে পারব। কারণ ইন্টারনেটের অবাধ বিস্ফোরণ একসময় সুস্থির হবে, ইউজার ব্যবহারিক দিক থেকে আরও পরিণত হবে এবং কন্টেন্ট মনিটরিং এর নতুন নতুন প্যারামিটার তৈরি হবে। ইতিমধ্যে ইউটিউব, ফেসবুক কিংবা টুইটার এর মত বেশ কিছু প্লাটফর্ম অথেনটিক কন্টেন্ট বেজড অ্যাকাউন্ট বা ইউজারের উপর একটিভ মনিটরিং শুরু করেছে।
তাই আমি বিশ্বাস করি আজ না হলেও কাল আমরা এ সমস্যা থেকে উদ্ধার পাবো। একটা সুস্থ ইকোসিস্টেম তৈরি হবে। মেধা সম্পদকে যথাযথ ভাবে ব্যবহার করার কালচার তৈরি হবে আমাদের দেশে। যদিও কালচারাল রেভ্যলুশন কখনই ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্ভব নয়, কিন্তু ব্যক্তি থেকেই আপনাকে শুরু করতে হবে। প্রতিটা একক ব্যক্তিত্ব যখন এগিয়ে আসবে, ঠিক তখনই এর পরিবর্তন ঘটতে শুরু করবে। যখন আপনি নিজে আপনার মেধাস্বত্ব নিয়ে ওয়াকিবহাল এবং আন্তরিক, তার মানে বুঝতে হবে; পরিবর্তন ইতিমধ্যে ঘটে গেছে! সুতরাং ব্যক্তি হিসেবে আপনার ভূমিকা অপরিসীম। এক অর্থে আপনার হাতেই আটকে আছে একটি সামাজিক আন্দোলনের শুভ সূচনা।