নিউজপেপার ইল্যুশন
কেন অনলাইনে নিউজ একদমই পড়া উচিত নয়!
গতকাল সুব্রত দেব নাথের একটি স্ট্যাটাস চোখে পড়ে আমার। স্ট্যাটাসটি হুবুহ তুলে দিচ্ছি পাঠকদের জন্য:
জাফর ইকবাল স্যারের কথা চিন্তা করলে অবাক লাগে। স্যার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন, রিসার্চ করেন, গ্র্যাজুয়েট-আন্ডারগ্র্যাজুয়েটের থিসিস সুপারভাইজার থাকেন, প্রতিবছর মিনিমাম ৬/৭ টা বই লেখেন, সরকারি-আধাসরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কমিটির মেম্বার যেখানে হাতে কলমে কাজ করা লাগে, পাঠ্যপুস্তক নতুন করে প্রণয়ন করেন, কলাম লেখেন…আরো নিশ্চয়ই অনেক আছে। আর জানার পরিধি বাড়ানোর জন্য নিয়মিত বই পড়া তো আছেই! আশ্চর্য রকমের রুটিন মেনে জীবন যাপন করা ছাড়া এরকম high and multidimensional prolificacy অসম্ভব।
স্ট্যাটাসটি পড়ে আমারও মনে হলো বিষয়টি আসলে কি? অনেকে অনেক যুক্তি দিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে যে-টি তা হলো ‘উনি তো ফেসবুক ব্যবহার করেন না!’
আরেকটি ব্যাপার আমার মনে হলো, উনি তো টেলিভিশনও দেখেন না বলে বিভিন্ন কলামে লিখেন। প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানোর জন্য টেলিভিশন বা ফেসবুক ব্যবহারের চেয়েও অন্য যে কাজটি তাকে অ্যাডভান্টেজ দেয়, তা হলো উনি অনলাইন নিউজ পেপার পড়েন না। মূলত ঘন্টা খানেক পরপর লেটেস্ট নিউজ না দেখা ও অনলাইন নিউজপেপার না পড়া তাকে বা তার মতো পরিশ্রমীদের অ্যাডভান্টেজ দেয়। কিন্তু কিভাবে? সেটাই বিশ্লেষণ করছি।
নিউজ বা সংবাদ ব্যাপারটাই মুখরোচক। মিষ্টি বা চিনির মতো! দেখলেই খেতে ইচ্ছে হবে! কিন্তু এই মিষ্টি বা চিনি খাওয়ায় শরীরের জন্য যে ক্ষতি হচ্ছে তা টের পেয়েও লোভ সামলাতে পারছেন না।
কাজের মাঝখানে স্মার্টফোন থেকে ফেসবুকে ঢুকে ব্রেকিং নিউজ দেখবেন, সাকিব আল হাসান-সহ দেশের সব ক্রিকেটার ক্রিকেট বোর্ডের বিরুদ্ধে গিয়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। আগ্রহ বেড়ে যাবে আপনার। নিউজের লিংকে ক্লিক করে পুরো নিউজটি পড়বেন। তারপর হয়তো আবার কাজে ফিরে যাবেন।
দশ-পনের মিনিট পর আবার মনে প্রশ্ন জাগবে, কি হলো এরপর? ক্রিকেটাররা সংবাদ সম্মেলন ডাকলো। কে কি বললো? দেখি তো একটু! আবার ফেসবুকে গেলেন, এরপর হয়তো দেখলেন ব্রেকিং নিউজ আরো এসেছে। নাঈম ইসলাম কি বললো,তামিম ইকবাল কি বললো তা পড়লেন। তারপর আবার কাজে ফিরে গেলেন।
আধা ঘন্টা না যেতেই আবার ফিরে আসবেন, এরপর ক্রিকেট বোর্ড বিসিবি কি বললো তা দেখতে মুখিয়ে থাকবেন। এভাবে হয়তো কর্মঘন্টার বড় একটি অংশ নষ্ট করছেন। তাই জাফর ইকবালের মতো মাল্টিফাংশনাল কাজে অংশ নেওয়া আপনার-আমার পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না।
একই উদাহরণ টেলিভিশনের সংবাদ বা ব্রেকিং নিউজের ক্ষেত্রেও খাটে।
এটাই শুধু একটি কারণ নয়, আরো কারণ আছে অনলাইন নিউজ না পড়ার জন্য। প্রথমত, আপনি কোন অনলাইন পোর্টালে কোনভাবে ঢুকে গেলে নিউজের শেষে বা মাঝে বা একপাশে তাদের সর্বাধিক পড়িত সংবাদের হেডলাইন থাকে, যা দেখে আপনি পড়ার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আসলে বেশিরভাগ হেডলাইন হয় ক্লিকবেইট। হেডলাইনগুলোর ধরণ এমন: ‘এ কি করলেন অমুক তারকার স্ত্রী’, ‘গোপন তথ্য ফাঁস করলেন তমুক অভিনেত্রী’।
দ্বিতীয়ত, ভুল সংবাদে ভর্তি এসব অনলাইন নিউজে। বিভিন্ন নাম-দামহীন বিদেশী সংবাদে ভর্তি থাকে এ সব অনলাইন পোর্টাল। গত কয়েক বছর ধরে বিশ-পঁচিশটি অনলাইন পোর্টালে এই নিউজ হেডলাইনটি দেখেছি: ‘ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন সু কি’। এ সংবাদটি পুরোপুরি ভুয়া। কোন রেফারেন্স ছাড়া বানানো নিউজ। এসব সংবাদপত্রের আজগুবি নিউজেই শুধু জানতে পারবেন কাকে চাঁদে দেখা গেলো, কার ঘর ভাঙ্গলো অন্য কার কারণে, অমুক ধর্মে দীক্ষিত হলেন তমুক তারকা প্রভৃতি। অনেক বড় প্রতিষ্ঠিত মানুষও এসব নিউজ পড়ে বিশ্বাস করে শেয়ার করেন, যা তাদেরকে হাসির পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করে। কাজেই রেফারেন্স ছাড়া এসব পড়া ও শেয়ার করতে সাবধান থাকাই শ্রেয়।
তৃতীয়ত, অপ্রয়োজনীয় সংবাদে ভর্তি এসব পোর্টাল। পেঁপে খেলে এই দশটি উপকার হবে, কলা খেলে এই অদম্য শক্তি আপনি আজকেই পাবেন — প্রভৃতি হাস্যকর ও অপ্রয়োজনীয় সংবাদ পাবেন এসব পোর্টালে।
চতুর্থত, সংবাদগুলো পড়ার মানে সময়ের অপচয়। এসব সংবাদ পড়তে খুব মজাদার, রসালো এবং অবিশ্বাস্য। আপনি মিথ্যে জেনেও হয়তো এসব পড়েন। তাতে আপনারই সময় নষ্ট হচ্ছে।
এসবের চেয়ে বরং অনলাইন নিউজ না পড়াই ভালো। পারলে অনলাইন নিউজ পোর্টালের পেজ লাইক দেওয়া থাকলে আনলাইন বা আনফলো করে দিন। পারলে সংবাদও পড়বেন না। সময় বাঁচবে।
একবারে দিনের শুরুতে একটি ভালো সংবাদপত্র পড়তে পারেন, অনেক তথ্য ভাল ভাবে দেওয়া থাকে। অনলাইনে ব্রেকিং নিউজ না পেলেও আপনার খুব একটা ক্ষতি নেই। চিন্তা করুন আজ থেকে পনের-বিশ বছর আগে কিন্তু মানুষ একদিনের সংবাদ পরদিন পত্রিকায় পড়েই জানতো, তাতে কারো জীবনে কোন ক্ষতি হতো না।
আর কোন বিষয়ে জানার জন্য অনলাইন নিউজ পেপার কিংবা কোন সংবাদ পত্রের ওপর নির্ভর করবেন না। প্রতিষ্ঠিত বড় বড় সংবাদ সংস্থা বা পত্রিকাগুলোও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পক্ষে বা বিপক্ষের সংবাদ দেবে। ধরুণ, আমার দেশের মতো পত্রিকা পড়লে আপনি হয়তো যুদ্ধপরাধীদের সম্পর্কে সিম্প্যাথিসম্পন্ন নিউজ পেতেন। আবার শুধু জনকন্ঠের মতো পত্রিকা পড়লে আপনি শুধু আওয়ামী ঘরণার সংবাদ বেশি পাবেন। আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি আসল ঘটনা কিভাব জানবেন। আসল ঘটনা জানার জন্য বই বা প্রতক্ষদর্শীদের বর্ণনার বিকল্প নেই।
ধরুন, ইরান সম্পর্কে জানতে চান আপনি। অথচ আপনি এখনকার সংবাদপত্র পড়লে ভাববেন ইরান খুব ইসলামী ভাবধারার দেশ। আমিও তাই ভাবতাম। অথচ, আমি ইরানের এক সাবেক রানীর লেখা বই পড়তে গিয়ে অবাক হয়ে যাই! ইরানকে আমরা এখন যেমন দেখছি, চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও এমন ছিলো না। কিংবা খালেদ হুসাইনির উপন্যাস পড়ে আফগানিস্তান সম্পর্কে আপনি যতটুকু জানবেন, আমেরিকান কোন পত্রিকা পড়ে তার চেয়ে ভুলভাল জানবেন বেশি। তাই কোন কিছু ভালভাবে জানার জন্য বইয়ের কোন বিকল্প নেই। যে সময় আপনি অনলাইন নিউজ পড়ে বা ইউটিউব চ্যানেলগুলোতে রসালো সংবাদ দেখে কাটান, সেই সময়টা কোন বই পড়ে কাটালে আপনি গভীরভাবে কোন বিষয় জানতে পারবেন।
এতকিছু পড়ে আপনি হয়তো প্রশ্ন করবেন, অনলাইন নিউজ পেপার না পড়ার হেডলাইন লিখে আপনি প্রচলিত সংবাদপত্র পড়তেও নিষেধ করছেন কেন? আসলে সংবাদপত্র ব্যাপারটাই বায়াসড। আপনি নিরপেক্ষ বলে কিছু পাবেন না। কারণ সংবাদ প্রকাশনা সংস্থারও কিছু নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি বা পক্ষপাত থাকে। তাই সবকিছু নিরপেক্ষ পাওয়ার আশা করাটা বোকামি। তাই কোন বিষয়ে জানার জন্য সে বিষয়ে ভাল বই পড়া বা অনলাইনে থাকা ভালো আর্টিকেল পড়াই উত্তম। আর যে হেডলাইন লিখেছি, তা-ও আপনাকে এই লেখাটি পড়ার জন্য আকর্ষিত করতে লেখা!