কেন মাঝে মাঝে গোরস্থান থেকে ঘুরে আসা উচিত?
এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানের গান শুনে হাসি-ঠাট্টা করেনি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আচ্ছা, কখনো ভেবে দেখেছেন, বড় বড় দু’টি টিভি চ্যানেলের মালিক হয়েও তিনি কেন ভাঙ্গা গলা নিয়ে, বেসুরো গলায় গান গেয়ে গায়ক হওয়ার চেষ্টা করেছেন?
যারা বাংলাদেশের ফুটবল ২০০০ সালের পরে এক দশক ফলো করেছেন, তাদের মনে থাকতে পারে নিটোল টাটা জাতীয় ফুটবল লীগ তখন নিয়মিত আয়োজিত হতো। বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রাচারিত হতো সব ম্যাচ। তখন প্রত্যেক ম্যাচের আগে দুই দলের ম্যানেজারদের সাক্ষ্যাৎকার নেওয়া হতো। এক আসরে সিলেট অঞ্চল থেকে সিলেট চতুরাঙ্গ যুব সংঘ মূল আসরে স্থান করে নিলো। প্রথম দুই ম্যাচ যাওয়ার পর দেখা গেলো সিলেটের ক্লাবটির সভাপতি ম্যানেজারকে বাদ দিয়ে নিজে নিজেকে টিমের ম্যানেজার ঘোষণা করে পরের ম্যাচগুলোতে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে আসতে শুরু করেন। এ নিয়ে বেশ হাস্যরস হয়েছিলো সে সময়ে।
উঠতি বয়সের অনেক তরুণ-তরুণীকে দেখবেন রকস্টার হওয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। কেউ গিটার বাজানো শিখছে, কেউ গায়ক হওয়ার চেষ্টা করছে। ইউটিউব আর ফেসবুকে নিজের গাওয়া গান কিংবা নিজের গিটার সলো ভিডিও করে পোস্ট করছে। অথবা বিভিন্ন গানের রিয়েলিটি শোর বাচাইপর্বগুলো দেখবেন, প্রচুর তরুণ-তরুণী অডিশন দিতে যাচ্ছে। কিন্তু কেন? কেন সবাই উঠে-পড়ে লাগে এভাবে?
এখন বাংলাদেশের কিশোরদের বড় একটি অংশ ক্রিকেটার হতে চায়। শহরে অল্প বয়সী বাচ্চারাও ব্যাট-প্যাড ব্যাগে নিয়ে ক্রিকেট কোচিংয়ে চলে যায়। তাদের চোখে স্বপ্ন এক এক জন সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল হওয়ার। কিন্তু কেন? সবাই কেন ক্রিকেটার হতে চায়?
উত্তরটা সহজ। খ্যাতির জন্য, মিডিয়া অ্যাটেনশনের জন্য। মিডিয়ার স্পটলাইটে যেতে কার না ভাল লাগে? বারবার টেলিভিশনে, পত্রিকায় নিজের মুখ দেখবে, জনসম্মুখে অটোগ্রাফ-সেলফির হুড়োহুড়িতে নিজের স্টারডমকে উপভোগ করবে — বেশিরভাগের স্বপ্ন কিন্তু এমনই। তারা ভাবে একবার তারকা হয়ে গেলেই জীবন খুব উপভোগ্য হবে।
কিন্তু এমন ভাবনার পেছনের কারণটা কি? সবাই কি জেমস-আইয়ুব বাচ্চুর মতো তারকা সঙ্গীতশিল্পী বা রকস্টার হতে পারে? সবাই কি সাকিব-তামিমের মতো ক্রিকেটার হতে পারে? খোঁজ নিলে দেখা যাবে হাজার হাজার তরুণ অল্প বয়স থেকে চেষ্টা করেও জেমস-আইয়ুব বাচ্চু তো দূরের কথা, সাধারণ মানের সঙ্গীতশিল্পীও হতে পারেনি। তাদের নিয়ে কোনদিন পত্রিকায় দুই লাইন লেখা হয়নি। এমন অনেক অনেক তরুণ আছে যারা সাকিব-তামিমের মতো ক্রিকেটার হওয়ার চেষ্টায় দিনের পর দিন প্র্যাকটিস করেছে, স্থানীয় লীগে হয়তো খেলেছে, কিন্তু জাতীয় দলের পাইপলাইন ধরতে পারেনি। পারেনি ঢাকা প্রিমিয়ার লীগের কোন স্কোয়াডে জায়গা করে নিতে। বিকেএসপির অনেক ছাত্র আছে যারা বয়সভিত্তিক দলে খেলেও পরে ব্যর্থ হয়ে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও ক্যারিয়ার গড়ে নিয়েছে। কিন্তু মিডিয়া কি তাদের নিয়ে নিউজ করে? পত্রিকা বা টেলিভিশনে তাদের মুখ দেখা যায়?
পৃথিবীতে ব্যর্থদের নিয়ে কেউ আলোচনা করে না। তাই সফল ক্রিকেটার কিংবা সফল গায়ক-নায়কদের নিয়েই মিডিয়া সবসময় আলোচনা করে। তাদের কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনা করে। আর আমাদের সাধারণ মানুষের মনে ধারণা জন্মে যায়, চেষ্টা করলেই এসব আলোচিত তারকাদের মতো হওয়া যাবে। তাই স্বাভাবিক জীবনকে একপাশে রেখে তারকাদের ধ্যান-জ্ঞান করে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়কে তারকা হওয়ার পেছনেই ব্যয় করে অনেক কিশোর-তরুণ। হয়তো প্রতি হাজারে কয়েকজন সফল হয়, বাকীরা সাধারণ জীবনে ফিরে আসে। এরা আসলে সারভাইভরশিপ বায়াস-এর শিকার।
সারভাইভরশিপ বায়াস এমনভাবে মনের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি করে যে আমরা সফলদের বারবার মিডিয়ায় দেখে তাদের মতো হতে চাই। কিন্তু এ জন্য যে চড়াই-উতরে যেতে হয় সে সম্পর্কে আমাদের কোন ভাবনা কাজ করে না। তারকা হতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়া হাজার হাজার মানুষের কথা মিডিয়ায় কখনো আসে না, আমরাও সে চিন্তা করি না। যে কারণে খুব সহজে সারভাইভরশিপ বায়াস সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা থাকে না।
খুব সাধারণভাবে চিন্তা করলেও দেখা যায় আমরা অনেক সময় একটি কাজ আজ না করে কাল করবো ভাবি। এভাবে হয়তো ভবিষ্যতে করবে ভেবে অনেক মানুষ কাজটি শেষ না করে মৃত্যুবরণ করে। গোরস্থানে গেলে দেখা যায় শত শত মানুষের কবর। প্রতিদিন বিভিন্ন বয়সী মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। আমাদের হয়তো সবার মৃত্যুর খবর কানে আসে না, কিন্তু কবরস্থানে গেলে বোঝা যায় কত মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। কত কত স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে!
ফেব্রুয়ারী মাসে একুশে বইমেলা এলে দেখা যায় প্রচুর মানুষ বই লিখে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। কিন্তু কয়জনের বই শ’খানেক পাঠক পড়ছে? হয়তো অর্ধেকের বই-ই কয়েক’শ কপি কিনছে না পাঠক। কিন্তু প্রায় সবারই স্বপ্ন থাকে তার বই হিট হবে, হুমায়ূন আহমেদ কিংবা ইমদাদুল হক মিলনের মতো হিট হবে। অথবা হালের সাদাত হুসাইনদের মতো পাঠকপ্রিয় হবে। আসলে ব্যর্থতার কথা ভেবে কেউ চিন্তা করে না, সফল হবেই ভেবে নিজের মতো লিখে যায়।
এমন আরো অনেকেই আছে যাদের পান্ডুলিপি দেখে প্রকাশকরা বই প্রকাশ করারই সাহস করে না। আবার অনেকেই গল্প কিংবা উপন্যাস লেখার কথা ভেবে রাখে কিন্তু কখনো লিখতেই বসে না! অথচ দেখুন, নামী লেখকদের নিয়ে উচ্চ্য-বাচ্য দেখে লেখক হওয়ার প্রত্যাশিরা ভুলেই যায় হাজার হাজার লেখকসত্ত্বা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে! এসব মৃত লেখকসত্ত্বাগুলোর গোরস্থান দেখানোর ব্যবস্থা থাকলে হয়তো সবাই সফল লেখক হওয়ার আগে উপযুক্ত পরিশ্রমের চিন্তা করতেন আগে!
আজকাল অনেকে স্টার্টআপ আইডিয়া নিয়ে ইনভেস্টরদের কাছে যায়, এমনভাবে উপস্থাপন করে যেন মনে হয় পরবর্তী গুগল হতে যাচ্ছে এই প্রজেক্ট-টিই। অথচ বাস্তবতা হলো, এই স্টার্টআপ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। হয়তো দুই-তিন বছরের মাথায় এই স্টার্টআপটির অস্তিত্ব থাকবে না। অথবা দেখা যাবে বছর তিন-চার পরেও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারী সব মিলিয়ে দশজনের বেশি হবে না! ইনভেস্টর তাহলে কি দেখে টাকা ঢালবে? স্টার্টআপ আইডিয়া দারুণ হলেও প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের দক্ষতা-প্রচন্ড আগ্রহ ও হৃদয় দিয়ে সফল হওয়ার বা লাভ উঠিয়ে আনার আকাক্ষাই হতে পারে টাকা ইনভেস্ট করার মূল প্যারামিটার।
একইভাবে একটা কিশোরকে তার বাবা-মা ক্রিকেটার হিসেবে দেখতে চাইলেই, সাপোর্ট দিলেই সে ক্রিকেটার হয়ে উঠবে না। ক্রিকেটার হওয়ার জন্য সবকিছু বিসর্জন দিয়ে নিজেকে ফিট রাখা, অধ্যবসায় ও হৃদয় থেকে প্রচন্ড আগ্রহই মূল বিষয়। গানের ক্ষেত্রে সাধনা হতে পারে বড় গায়ক হওয়ার মূল ভিত্তি।
সাধনা ছাড়া, তাল-লয় না জেনে গায়ক হতে গেলে হাসিঠাট্টা হবে। অনেক টাকার মালিক হলে আর প্যাশন থাকলেই ফুটবল ম্যানেজার হওয়া যায় না, পরিশ্রম ও ঠেকে ঠেকে শেখাটাও বড্ড প্রয়োজন।
মিডিয়া কখনোই ব্যর্থদের জয়গান গায় না। ব্যর্থরা কখনো তাদের ব্যর্থতা নিয়ে বই লিখে না। তাই কোন কিছু হতে চাইলেই মিডিয়ায় সফল মানুষ দেখে অন্ধের মতো তেমনটা হতে না চেয়ে ওই একই মানুষের মতো যারা হতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিলো, তাদের ব্যর্থতার গোরস্থানটার কথাটাও ভেবে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বলছি না ব্যর্থ হওয়অর ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিতে, বরং ব্যর্থ না হওয়ার জন্য ব্যর্থরা কেন সফল হয়নি তা জেনে রাখা উচিত।
আজকের কাজ কাল করবো না ভেবে গোরস্থানের আশেপাশে নিয়মিত ঘুরে আসলে আলসেমী মনে জায়গা করবে না সহজে। এভাবে ‘সারভাইভরশিপ বায়াস’-কে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। সোজা কথায়, সারভাইভরশিপ বায়াস হলো, মানুষ কোন কাজে তার সফল হওয়ার সম্ভবনাকে ওভার-এস্টিমেট করে, মানে ধরেই নেয় সে খুব সহজে সফল হবে। আসলে এ ভাবনই একসময় কাল হয়ে দাঁড়ায়। তাই কোন কাজে সফল হবো ভাবার আগে সেই কাজে যারা ব্যর্থ হয়েছে তাদের নিয়ে ভাবা উচিত, তারা কেন ব্যর্থ হয়েছে সেটি নিয়ে ভাবা উচিত। পারলে চোখবন্ধ করে ব্যর্থতার গোরস্থানে একবার হেঁটে আসা উচিত। হয়তো ক্ষণিকের জন্য দুঃখী পথচলা হবে এটি, তবে এ পথচলাই সফলতার রাস্তাটা পরিষ্কারভাবে দেখাবে!