অথাতঃ গীতাজিজ্ঞাসা — ২

Sreejit Datta
5 min readDec 19, 2023

--

দ্বিতীয়ঃ পর্বঃ

বরোদার কীর্তি মন্দিরে নন্দলাল বসু-কৃত দেয়ালচিত্র —কুরুক্ষেত্র সংগ্রাম আরম্ভের অব্যবহিত পূর্বে অর্জুনকে গীতোপদেশ প্রদানরত শ্রীকৃষ্ণ (ছবি সৌজন্যে: https://ramaarya.blog/2017/05/31/vadodara-kirti-mandir-nandalal-bose/)

অথাতঃ গীতাজিজ্ঞাসা

দ্বিতীয়ঃ পর্বঃ

শ্রীজিৎ দত্ত

(প্রথম পর্বের পর)

আনন্দবাজার পত্রিকায় ইং ১৭.১২.২০২৩ তারিখে প্রকাশিত উত্তর-সম্পাদকীয়তে দেখিতে পাই, চক্কত্তিমশয় আমাদিগের পানে মাথা নাড়িয়া কহিতেছেন — ওহে আনাড়ি ভক্তের দল! গীতা সমবেত পাঠের নিমিত্ত নহে, উহা “ব্যক্তিগত বুঝদারির বিষয়”। অথচ চক্কত্তির রচনায় তাঁহার আপন “ব্যক্তিগত বুঝদারি”র কিছু নমুনা দেখিতে পাইয়া আমাদিগের ন্যায় অজাতশ্মশ্রু পাঠকবর্গের ছিন্নবটিকা চক্ষুগুলি আরো খানিক বিস্ফারিত হইল। এই রচনায় চক্কত্তি বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের প্রধান প্রবক্তা শ্রীরামানুজাচার্যকে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী হিসাবে উপস্থাপিত করিয়াছেন! অহো বিড়ম্বনা। বোধ করি ডেভিস্‌ সায়েব-রোমিলা থাপর ইত্যাদি দিশী-বিলাতী নিগূঢ় পাণ্ডিত্যনিদর্শন সেবন করিতে ব্যস্ত থাকায় চক্কত্তিমশয়ের খেয়াল হয় নাই যে দ্বৈতাদ্বৈত ও বিশিষ্টাদ্বৈত নামধারী দুই দার্শনিক মত প্রকৃতপক্ষে বৈদান্তিক দর্শনের দুইটি বিভিন্ন শাখা। উহাদের মধ্যে পরস্পর মতপার্থক্য বিদ্যমান। সমুদায় বৈদান্তিক দর্শন ব্রহ্ম, ঈশ্বর, জগত ও জীবের পরস্পর-সম্পর্ক এবং তত্ত্ব নির্ণয় করিয়াছেন। তন্মধ্যে দ্বৈতাদ্বৈত মতাবলম্বী আচার্য শ্রীনিম্বার্ক বলেন, জীব, জগত এবং ব্রহ্ম একইসঙ্গে অভিন্ন ও ভিন্ন। যেহেতু জীব হইতেছে ব্রহ্মের চেতন অংশ এবং সর্বতোভাবে ব্রহ্মের অধীন, তাই জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। ব্রহ্মের আনন্দঘন রূপই জগতরূপে প্রকাশিত, তাই জগতও ব্রহ্ম হইতে ভিন্ন নহে। উপরন্তু, যেহেতু ব্রহ্ম জীবকে ও জীবের আধাররূপী জগতকে অতিক্রম করিয়াও বিদ্যমান, তাই ব্রহ্ম ঐ দুই হইতে এক অর্থে ভিন্নও বটেন। অপরপক্ষে, বিশিষ্টাদ্বৈত মতাবলম্বী আচার্য শ্রীরামানুজ বলেন, সগুণব্রহ্ম বা ঈশ্বরই একমাত্র স্বতন্ত্ররূপে সৎপদার্থ তথা নিত্যবস্তু, আর বাদবাকি দুই পদার্থ অর্থাৎ জীব ও জগতের স্বতন্ত্র, ভিন্ন অস্তিত্ব কিছু নাই — সগুণব্রহ্ম বা ঈশ্বরের সত্তাতেই উহাদের অস্তিত্ব। জীব ও জগত উভয়েই সগুণব্রহ্ম বা ঈশ্বরের প্রকারবিশেষ; ফলতঃ এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্ম এই দুই প্রকার বিশেষণের দ্বারা বিশিষ্ট হইয়া থাকেন, তাই তিনি বিশিষ্ট অদ্বৈত — অর্থাৎ বিশিষ্টাদ্বৈত। ইহাই উক্ত দুই বৈদান্তিক মতের পার্থক্য। ভারতীয় দর্শন ও অধ্যাত্মে এই দুই শাখার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সর্বজনস্বীকৃত ও সাধারণ জ্ঞান হিসাবে পরিগণিত।

এক্ষণে মার্কিন মুল্লুক হইতে খাল কাটিয়া বিদ্যাবারিধির জল ভারতবর্ষে অনবরত সরবরাহ হইতেছে। রাজপথ-গলিপথের ধারে ধারে উপচীয়মান সেই জল বিশ্ববিদ্যালয়-নামক কল খুলিলেই মিলিয়া থাকে। জাহ্নবীকে ডাকিয়া আনা সকলকার সাধ্য কর্ম নহে, তথাপি কালাপানির নোনাজল টানিয়া আনিয়া ভগীরথ হইবার বাসনা বাম হইতে দক্ষিণ, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের কর্ণধার হইতে ইউজিসি — সকলেই মনে পোষণ করিয়া থাকেন। ইতোমধ্যে সেই বারিধারায় জেএনইউ সেঁচিয়া রোমিলা থাপর প্রমুখ অধুনা প্রোথিত-যশা[1] হিস্ট্রিবেত্তা উদ্ভিন্ন হইয়াছেন, অর্থাৎ কিনা তাঁহারা মৃত্তিকা ভেদ করিয়া আবির্ভূত/ভূতা হইয়াছেন। এহেন লবণাম্বুরাশি ও তদ্দ্বারা উর্বরীকৃত মৃত্তিকায় উপজাত পণ্ডিতদিগের বিদ্যা হজম করিয়া অথবা না-করিয়া (সম্ভবতঃ বদহজম করিয়া) শ্রীগীতার মধ্যে ‘লুক্কায়িত’ দুই ‘ভিন্নস্বরা’ গ্রন্থমধ্যে একটিকে দর্শনসংগ্রহগ্রন্থ বলিয়া যিনি চিহ্নিত করিতে পারিয়াছেন, সেই চক্কত্তিমশায়ের জানা উচিত ছিল বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও দ্বৈতাদ্বৈতবাদ অভিন্ন নহে, এবং বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী শ্রীবৈষ্ণব মাত্রেই নিম্বাচার্যপন্থী দ্বৈতাদ্বৈতবাদী নহেন। কিন্তু উহা না-জানিয়া চক্কত্তি একটিকে অপরটির স্কন্ধে চাপাইয়াছেন। “ব্যক্তিগত বুঝদারি”র নমুনা যদি এই হইয়া থাকে, তবে তদপেক্ষা না-বুঝিয়া গীতাগ্রন্থ সমবেত পঠন ও গীতাকার বিষয়ে তদ্গতচিত্ত হইয়া সঙ্ঘবদ্ধ শ্রবণ ঢের শ্রেয়। চক্কত্তি “প্রবচনকাররাই এখন ইতিহাসবিদ” এমত উক্তি করিয়া প্রবচনকার অথবা কথকঠাকুর এবং ইতিহাস — উভয়েরই প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করিয়াছেন। কথকতা ভারতীয় জ্ঞানপ্রবাহ-পরম্পরার অন্যতম স্তম্ভ বলিয়া সুবিদিত। গণতান্ত্রিক এই প্রথা যুগপৎ কলা ও লোকশিক্ষার বাহন। ইহার মাধ্যমেই বঙ্গদেশে তথা ভারতবর্ষে চিরকাল আপামর জনসাধারণের লোকশিক্ষা প্রদানকার্য সাধিত হইয়া আসিতেছে। বঙ্গীয় সাহিত্যে আধুনিক যুগের উদ্বোধক ও বন্দেমাতরম্‌ মন্ত্রের উদ্গাতা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র প্রাচীন প্রথা কথকতার প্রশংসা পঞ্চমুখে করিয়া গিয়াছেন। এই প্রথার উপর তাঁহার নিবিড় অনুরাগের কথা তিনি সজোরে উচ্চারণ করিয়াছেন। রামায়ণ-মহাভারত ইত্যাদি ইতিহাসগ্রন্থ, ভাগবত ইত্যাদি পুরাণগ্রন্থ ও বিবিধ শাস্ত্রগ্রন্থ হইতে প্রবচন পাঠরূপী কথকতাই যে লোকশিক্ষার প্রধান বাহন ছিল সেকথা বঙ্কিম স্পষ্টাক্ষরে লিখিয়া গিয়াছেন —

“গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে বেদী-পিঁড়ির উপর বসিয়া ছেঁড়া তুলট না দেখিবার মানসে সম্মুখে পাতিয়া, সুগন্ধি মল্লিকামালা শিরোপরে বেষ্টিত করিয়া, নাদুস-নুদুস কালো কথক সীতার সতীত্ব, অর্জুনের বীরধর্ম, লক্ষ্মণের সত্যব্রত, ভীষ্মের ইন্দ্রিয়জয়, রাক্ষসীর প্রেমপ্রবাহ, দধীচির আত্মসমর্পণ-বিষয়ক সুসংস্কৃতের সদ্ব্যা‌খ্যা সুকণ্ঠে সদলঙ্কার-সংযুক্ত করিয়া আপামর সাধারণ সমক্ষে বিবৃত করিতেন। যে লাঙ্গল চষে, যে তুলা পিঁজে, যে কাটনা কাটে, যে ভাত পায় না পায়, সেও শিখিত — শিখিত যে, ধর্ম নিত্য, ধর্ম দৈব, যে, আত্মান্বেষণ অশ্রদ্ধেয়, যে, পরের জন্য জীবন, যে, ঈশ্বর আছেন, বিশ্বসৃজন করিতেছেন, বিশ্বপালন করিতেছেন, বিশ্বধ্বংস করিতেছেন, যে, পাপপুণ্য আছে, যে, পাপের দণ্ড পুণ্যের পুরস্কার আছে, যে, জন্ম আপনার জন্য নহে পরের জন্য, যে, অহিংসা পরম ধর্ম, যে, লোকহিত পরম কার্য — সে শিক্ষা কোথায়? সে কথক কোথায়? কেন গেল? বঙ্গীয় নব্যযুবকের কুরুচির দোষে।”

চক্কতিমশয় নব্যযুবাবয়স্ক কিনা সে সংবাদ আমাদিগের নিকট নাই বটে, কিন্তু একটি বিষয় আমরা অনুমান করিতে সাহস করিয়া থাকি। চক্কত্তি তাঁহার রচনায় যে তাচ্ছিল্যের সুরে প্রবচনকারী কথকঠাকুরদিগকে ভর্ত্স‌না করিয়াছেন, তাহা হইতে আমরা অনুমান করি যে, চক্কত্তি যে বিশেষ চিন্তাধারার প্রতিভূ,সেই শ্রেণীর লেখকদিগের রুচির প্রতি লক্ষ্য রাখিয়াই বঙ্কিম উপরি-উদ্ধৃত তিরস্কারটি প্রয়োগ করিয়াছেন!

এহেন লোকশিক্ষার বাহন কথকতার প্রতি চক্কত্তিমশয়ের মনের ভাব এমনধারা বিরূপ হইলে কী প্রকারেই বা তিনি জানিবেন যে কথামৃতে কথকঠাকুরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়া স্বয়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁহার শ্রীমুখে বলিয়াছেন “শুধু পাণ্ডিত্যে কিছু নাই। তাঁকে পাবার উপায়, তাঁকে জানবার জন্যই বই পড়া।” ঐ একই প্রসঙ্গে পরমহংসদেব আরো বলিয়াছেন, “গীতার অর্থ কি? দশবার বললে যা হয়। ‘গীতা’ ‘গীতা’, দশবার বলতে গেলে ‘ত্যাগী’ ‘ত্যাগী’ হয়ে যায়।” বাঙ্গালী পাঠককে গীতা-বিষয়ে উপদেশ প্রদান করিবার অগ্রে চক্কত্তিমশয়ের এই বিষয়ে কিঞ্চিৎ খবরাখবর লইয়া রাখা উচিত ছিল। অন্ততপক্ষে তাঁহার জানিয়া লওয়া উচিত ছিল বাঙ্গালী-মানসের সহিত ওতপ্রোতভাবে জড়িত দুই পুণ্যচরিত্র মহাপুরুষ — শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব গীতা সম্পর্কে কী শিক্ষা দিয়াছেন। চক্কত্তিমশয়ের জানা উচিত ছিল যে ত্যাগ ভক্তি ও ধ্যান — অর্থাৎ নিষ্কাম কর্ম, তদ্গতভাব উপাসনা ও ঈশ্বরজ্ঞান — এই তিনটিমাত্র সুরের তন্ত্রীতে বাঁধা এক ও অদ্বিতীয় রাগিণীতে সপ্তশত শ্লোক-সমন্বিত গীতা তথা সমগ্র মহাভারতগ্রন্থরূপী সঙ্গীত রচিত রহিয়াছে, যে মহাসঙ্গীত শুনিবার নিমিত্ত মার্কিন মুল্লুকেও পাড়ি দিবার প্রয়োজন নাই, জেএনইউ-তেও ছুটিবার দরকার নাই; যে সঙ্গীতের আলাপন মূর্চ্ছনা তান সকলই মধ্যযুগ হইতে ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের আধুনিককাল অবধি এই বঙ্গদেশে লোকমুখে মহাজনমুখে বঙ্গভাষাতেই কীর্তিত হইয়াছে।

এই তিনটি মূল সুরে বাঁধা মহাসঙ্গীত শ্রবণ করিবার ও সে গানের রসগ্রহণ করিবার মত পাকা কান চক্কত্তিমশয়ের আছে বলিয়া আমাদিগের ভরসা হয় না। কারণ, তাহা থাকিলে চক্কত্তি ঊনবিংশ শতাব্দীর দক্ষিণেশ্বরস্থ ঐ চাটুজ্জে বামুনের কথকতা শুনিতে পাইতেন, যিনি পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের শ্রীচৈতন্যদেব সম্পর্কে প্রচলিত একখানি কাহিনী-কথন করিয়া শ্রীগীতার মাহাত্ম্য গল্পচ্ছলে আরো ভাঙ্গিয়া বুঝাইয়াছেন। শ্রীম-রচিত কথামৃতে দেখিতে পাই, ১৮৮২ খৃষ্টাব্দের ৫ই অগস্ট তারিখে সপার্ষদ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব বিদ্যাসাগর-সকাশে গমন করিয়াছিলেন; এবং ঐ সাক্ষাৎ উপলক্ষ্যে বার্তালাপ করিতে করিতে স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয়কে পরমহংসদেব এই গল্প বলিয়াছেন —

“চৈতন্যদেব যখন দক্ষিণে তীর্থভ্রমণ করছিলেন — দেখলেন, একজন গীতা পড়ছে। আর-একজন একটু দূরে বসে শুনছে, আর কাঁদছে — কেঁদে চোখ ভেসে যাচ্ছে। চৈতন্যদেব জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এ-সব বুঝতে পারছ? সে বললে, ঠাকুর! আমি শ্লোক এ-সব কিছু বুঝতে পারছিনা। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তবে কেন কাঁদছো? ভক্ত বললে, আমি দেখছি অর্জুনের রথ, আর তার সামনে ঠাকুর আর অর্জুন কথা কচ্চেন। তাই দেখে আমি কাঁদছি।”

এহেন পরমহংসদেব, যিনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়ি হইতে আলিপুরস্থ চিড়িয়াখানা পর্যন্ত নানাস্থলে যাইবার বায়না প্রায়শই জুড়িয়া দিতেন, এবং ভক্তদের সহিত ঐসকল স্থলে আসিয়া উপস্থিতও হইতেন, তিনি আজিকার দিনে শরীরধারণ করিয়া থাকিলে এবং গীতাজয়ন্তী উপলক্ষ্যে তাঁহার কালীবাড়ির অনতিদূরে কলিকাতাস্থ ব্রিগেড ময়দানে লক্ষ মানুষের কণ্ঠে গীতাপাঠ হইতে চলিয়াছে এ-সংবাদ পাইলে হয়তো জেদাজেদি করিয়া দক্ষিণেশ্বর হইতে নৌকাযোগে সদলবলে উক্ত স্থলে আসিয়াই উপস্থিত হইতেন!

(ক্রমশঃ)

[1] শ্লেষ অভিপ্রেত

--

--

Sreejit Datta

Educator, researcher, and social commentator writing / speaking on subjects critical to rekindling the Indic consciousness in a postmodern, neoliberal world.