চিঠি সমাচার

Gateway to Truth
4 min readNov 13, 2018

--

Photo by John-Mark Smith from Pexels

১.
জনৈক মালিক, ফায়জুল সাহেব প্রায় ছয় মাসের জন্য কানাডা যাচ্ছেন। তার পরিবার ইতিমধ্যেই কানাডা প্রবাসী। ঢাকার বিশাল বাড়িতে তিনি আর তার একজন কেয়ারটেকার এবং ম্যানেজার থাকে। ব্যবসায়ী মানুষ ফায়জুল সাহেবের একাধিক ব্যবসা থাকার কারনে অনেক ধরনের দাায়িত্ব যা তিনি তার দুই কর্মচারী, কেয়ারটেকার আর ম্যানেজারের মধ্যে বন্টন করে বেশ বড় দুটি লিস্ট ও নির্দেশনামুলক চিঠি লিখেছেন। এতে বলা আছে কোন ব্যাংকে কত টাকা মাসিক কিস্তির লোন পরিশোধ করতে হবে, কোন ফ্যাক্টরিতে কি ধরনের নির্দেশনা দিতে হবে, অন্যান্য ব্যবসায়ী এ্যাসোসিয়েটসদের কি বলতে হবে, কোথায় কবে কি করতে হবে ইত্যাদি।

২.
আজ রাতে ফায়জুল সাহেবের ফ্লাইট। তিনি যাওয়ার আগে বিকেলে কেয়ারটেকার এবং ম্যানেজারকে ডেকে পাঠালেন। তাদের হাতে মুখ বন্ধ দুটো চিঠি ধরিয়ে ভালো করে নির্দেশনা দিলেন যে তিনি যাওয়ার পর দুইজনই যেন এই চিঠি খুলে পড়ে, কাজগুলো ভালো করে বুঝে নেয় এবং সেই অনুসারে দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে। দু’জনেই ফায়জুল সাহেবের সাথে দীর্ঘ ১২ বছরের বেশি ধরে কাজ করেছেন, উভয়েই প্রতিশ্রুতি দিলো যে তারা তা করবে। ফায়জুল সাহেব ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বললেন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।

৩.
কেয়ারটেকার কামাল উদ্দিনের প্রকৃতিটা হলো ভক্ত টাইপ। তিনি ফায়জুল সাহেবের খুবই অনুরক্ত এবং বস যে তাকে মুখবন্ধ চিঠি দিয়েছে এতে সে ভিষণ গর্বিত ও খুশিতে গদগদ। হাজার হলেও বসের স্পেশাল মুখবন্ধ চিঠি! সে পরেরদিনই স্টেশনারীতে গিয়ে খুব দামী একটা ফাইল কিনে আনলো, চিঠির খামটা সেই ফাইলে ঢুকিয়ে তার তালাওয়ালা আলমিরার সবচেয়ে উপরের তাকে খুব যত্ন করে, রেশমী কাপড়ে জড়িয়ে রাখলো। হাজার হোক, বসের চিঠি। বাইরে রাখলে খাম যদি ধুলো বালিতে ময়লা হয়ে যায়!

প্রায় দু’একদিন পরপরই কামাল উদ্দিন আলমিরা খুলে কাপড় ভাঁজ সযত্নে সরিয়ে চিঠিটা দেখে, খামে কেমন একটা সুন্দর গন্ধ আছে সেটাও নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নেয়, তারপর আবার আগের চাইতেও যত্ন নিয়ে সুন্দর করে কাপড়ের ভাঁজে চিঠি রাখে। তার মনে পড়ে কেউ একজন তাকে বলেছিলো যে দামী জিনিস যত্ন আর ভক্তি করে রাখতে হয়! তার আশা চিঠিটাকে খুব যত্ন করে আগলে রাখলে মালিক খুব খুশি হবে এবং একদিন তার অনেক প্রশংসা ও পুরস্কার মিলবে নিশ্চই তার এই ডেডিকেশনের জন্য। চিঠিটা ধরার আগে সে হাত ভালো করে লিকুইড সোপ দিয়ে ধুয়ে প্রথমে ড্রায়ারে শুকায়, তারপর পরিস্কার টাওয়ালে হাত মোছে। বাইচান্স হাতের ময়লা যদি সাদা শুভ্র খামে দাড় বসিয়ে দেয়।

হাজার হোক, বসের চিঠি !

৪.
ম্যানেজার রাজীব আহমেদ অতটা অন্ধ ভক্ত নয়। সে প্র্যাক্টিক্যাল বা বাস্তবাদী। ফায়জুল সাহেব চলে যাওয়ার পরের দিন সে চিঠিটা খুললো এবং মনোযোগ দিয়ে দুইবার পড়লো; তার ডায়েরীতে প্রত্যেকটা বিষয়ে কি কি করতে হবে, কাকে ফোন দিতে হবে, কোন ব্যাংক বা অফিসে কি কাজ তার লিস্ট করে সে অনুসারে কাজ শুরু করে দিলো।

৫.
ছয় মাস পরে কানাডা থেকে ফিরে কোন কর্মচারীর প্রতি বস বেশি খুশি হবে?

কামাল উদ্দিন, যে বসের প্রতি অতি ভক্তির ঠ্যালায় চিঠিটা আলমিরার উঁচু তাকে রেখে, মাঝে মাঝে বের করে নেড়েচেয়ে আহাউহু করে কাপড়ে মুড়িয়ে রেখে দিতো, সেই কামালকে?

নাকি, রাজীব আহমেদ যে ঐ চিঠি যে উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে সেটা বুঝে, পড়ে, সে অনুসারে কাজ করতো?

৬.
মানুষের স্রষ্টাও আমাদের জন্য একটা চিঠি পাঠিয়েছে। সেটার নাম তিঁনি নিজেই দিয়েছেন হুদা (সঠিক পথের দিশারী), কালামাল্লাহ ও কাওল (আল্লাহর কথা), মুবিন (আলোকময়), ফুরকান (সত্য মিথ্যার প্রভেদকারী), মাউইযা (সতকর্তা), মুসাদ্দিক (সত্যায়নকারী), হিকমা ও হাকিম (প্রজ্ঞাময়), আহসান হাদীস (শ্রেষ্ঠ বার্তা), নাবাউন আজিম (সুপ্রিম বার্তা/ খবর), বাসাইর (চোখে খুলে দেওয়ার মতো প্রমান), তাযকিরা (স্মরণ করিয়ে দেওয়ার বার্তা), আমর আল্লাহ (স্রষ্টার নির্দেশ), বুশরা (সুসংবাদদানকারী), বালাগ (যথেষ্ট বা পরিপূর্ণ বার্তা), নাযির (সতর্ককারী)।

অথচ বাস্তবে এটা এখনো কাপড়ে মুড়িয়ে ঘরের সবচেয়ে উপরের তাকে রাখা অবহেলিত একটা চিঠি। কিছু ধর্মের ঠিকাদার যারা শয়তানের এজেন্সি নিছে তারা বিভিন্ন অযুহাতে এটা যেন পড়া না হয়, পড়লেও যেন না বুঝে, বোঝার এ্যাটেম্পটও যেন না নেয় তার যাবতীয় কাজ করে সেটাকে ভক্তির বিষয় ও ধর্ম পালনের মোড়ক লাগিয়ে দিয়েছে (কেউ এটা করেছে বুঝে, কেউ না বুঝে, কিন্তু ফলাফল একই)।

৭.
ছয়মাস পরের কথা, ফায়জুল সাহেব কানাডা থেকে ফিরে কামাল উদ্দিনের উপর বেজায় ক্ষিপ্ত। কামালের কারনে তার প্রায় কোটি টাকার কাছাকাছি লস। কামালের চাকরি নট। ম্যানেজার রাজীব ডাবল প্রোমোশন পেয়ে ফ্যাক্টরির জি.এম.।

৮.
আমাদেরও একদিন এ দুনিয়া ও মহাবিশ্বের সব কিছুর মালিকের সাথে এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। তিনি আদম ও তার সন্তানদের যে পৃথিবীতে তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি করে পাঠালেন, সেই প্রতিনিধিত্বের কি কি কাজ আমরা করেছি তার হিসাব একদিন আমাদের দিতে হবে। তার দেওয়া নির্দেশনামূলক চিঠি আমরা কে কে পড়েছি ও সে অনুসারে সচেতন হয়েছি, এবং সবচেয়ে বড় কথা যেটা, তা হলো প্রয়োগ করেছি; আর কে সেটিকে রেশমি কাপড়ে মুড়িয়ে তাকের শেষ থাকে তুলে রেখেছি অথবা সহীত ও সুললিত কন্ঠে পড়ার অর্থহীন প্রতিযোগিতা করেছি সেটার হিসাব হবে যেদিন — সেদিন বড় কঠিন দিন।

স্রষ্টা আমাদেরকে যেন তাঁর অসীম অনুগ্রহের মাধ্যমে তাঁর পাক কালামের সাথে সম্পর্ক আরো বাড়িয়ে দিক!

হে মানবজাতি! তোমাদের পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট সনদ পৌঁছে গেছে। আর আমি তোমাদের প্রতি প্রকৃষ্ট আলো অবতীর্ণ করেছি। — আল কুরআন ৪:১৭৪

তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? — ৪৭:২৪

আমি কোরআনকে বোঝার জন্যে সহজ করে দিয়েছি। অতএব, কোন চিন্তাশীল আছে কি? — ৫৪:৩২

# অন্যান্য লেখা:

পড়ি কিন্তু আসলে পড়ি কী?

--

--

Gateway to Truth

Freedom from sectarianism, schism, half-truth or distortions and journeying towards clarity and whole truth