মোশাররফ হোসেনঃ পাকিস্তান পর্ব

MosharrafHossainJessore
9 min readNov 9, 2017

ভারত পর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে মোশাররফ হোসেনের বড় ভাই ভাষা সংগ্রামী হাবিবুর রহমানের কথা। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে “মুসলিম” বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁর অবদান উল্লেখ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বইতে-

আমরা এখনও জেলা কমিটিগুলি গঠন করতে পারি নাই। তবে দু’একটি জেলায় কমিটি হয়েছিল। চট্টগ্রামে এম.এ. আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এবং যশোরে খড়কীর পীর সাহেব ও হাবিবুর রহমান এডভোকেটের নেতৃত্বে। (পৃষ্ঠা-১৩০)

ভাই হাবিবুর রহমানের মতো মোশাররফ হোসেনও যশোর বারে যোগ দেন, হন আওয়ামী লীগেরও সদস্য। সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে ১৯৬৬ সালে তিনি যশোর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তবে এর আগেই বেসিক ডেমোক্র্যাসির অধীনে নির্বাচনে তিনি যশোর ইউনিয়ন কমিটির (পৌরসভার) চেয়ারম্যান নির্বাচিত (বিডি চেয়ারম্যান) হয়ে গিয়েছেন, ১৯৬৪ সালে।

সেনাশাসক আউয়ুব খানের বিরুদ্ধে কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিস-এর ব্যানারে ফাতেমা জিন্নাহ রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হন। সেই জোটের একটি ছিল আওয়ামী লীগ। ফাতেমা জিন্নাহ নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ১৯৬৪ সালের ১৯শে অক্টোবর যশোরে আসলে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যশোর টাউন হল ময়দানে জনসভার আয়োজন করেন মোশাররফ হোসেনসহ অন্যান্য নেতারা।

স্বাধীনতাপন্থী বাঙালী বিচারপতি ও সাবেক আইনমন্ত্রী মুহাম্মদ ইব্রাহিম, মোশাররফ হোসেন এবং অন্যান্যরা। যশোর, ১৯৬৬ সাল বা তার আগে কোন এক সময়

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপন করেন বাঙালীর মুক্তির সনদ ছয় দফা। দাবী উত্থাপনের পর খোদ আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই এর বিরোধিতা শুরু হয়ে যায়। শুরু থেকে ছয় দফার পক্ষে জনমত গঠনে একনিষ্ঠ থাকেন মোশাররফ হোসেন।

ছয় দফার বিরোধিতায় আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই এত প্রবল বিরোধিতা শুরু হয় যে তার রেশ দলত্যাগ পর্যন্ত গড়ায়। ১৯৬৬ সালে ছয় দফার বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগেরই নেতারা যোগ দিতে থাকেন নবগঠিত পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) নামক জোটে। পিডিএমে ছিল ন্যাশনাল ডেমক্র্যাটিক ফ্রন্ট, জামাত-ই-ইসলামী, নেজাম-ই-ইসলাম, কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও ৮ দফাপন্থী আওয়ামী লীগ। যশোর আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট মশিউর রহমান ও অ্যাডভোকেট রওশন আলীর মত নেতারা পিডিএমে যোগ দিলে শোচনীয় হয়ে পড়ে যশোর আওয়ামী লীগের অবস্থা। তখন দৃঢ় হাতে দলের হাল ধরে থাকেন মোশাররফ।

ছয় দফার বিরোধিতায় আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই এত প্রবল বিরোধিতা শুরু হয় যে তার রেশ দলত্যাগ পর্যন্ত গড়ায়। ১৯৬৬ সালে ছয় দফার বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগেরই নেতার যোগ দিতে থাকেন নবগঠিত পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) নামক জোটে। পিডিএমে ছিল ন্যাশনাল ডেমক্র্যাটিক ফ্রন্ট, জামাত-ই-ইসলামী, নেজাম-ই-ইসলাম, কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও ৮ দফাপন্থী আওয়ামী লীগ।

যশোর আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট মশিউর রহমান ও অ্যাডভোকেট রওশন আলীর মত নেতারা পিডিএমে যোগ দিলে শোচনীয় হয়ে পড়ে যশোর আওয়ামী লীগের অবস্থা। তখন দৃঢ় হাতে দলের হাল ধরে থাকেন মোশাররফ। যশোরে ছয় দফার পক্ষে আন্দোলন অব্যাহত থাকে মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে। ছয়দফার পক্ষে ছাত্রলীগের বাঙালী জাতীয়তাবাদী ছাত্রনেতার ঐক্যবদ্ধ হন মোশাররফকে কেন্দ্র করে।

সংগ্রামমুখর সেই দিনগুলো প্রলম্বিত হয়। আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করা হলে সারা দেশের মতো যশোর অঞ্চলেও প্রবল গণআন্দোলনের সূচনা হয়, যশোর অঞ্চলে যার নেতৃত্ব দেন মোশাররফ হোসেন। সংগ্রামে আপোষহীন থেকে মোশাররফ হোসেন সেই সময় পার করার পর পিডিএম থেকে আবার আওয়ামী লীগে ফেরেন চলে যাওয়া নেতারা। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি লাভের পর শেখ মুজিবুর রহমান যশোরে এলে দলত্যাগী নেতারা ফিরে আসেন আওয়ামী লীগে।

যশোরে শেখ মুজিবুর রহমান ও মোশাররফ হোসেন (এমপিএ), ১৯৬৯। ছবিতে আরও যাঁদেরকে নির্দিষ্ট করা গিয়েছে- মশিউর রহমান (এমএনএ), মইনুদ্দিন মিয়াজী (এমপিএ), আব্দুস সালাম, জলি, বীণা, রিনা, মেরি (আশরাফুন্নেসা বেগমের মেয়ে), আলেয়া আফরোজ (পরবর্তীতে এমপি) ও রওশন জাহান সাথী (পরবর্তীতে এমপি)।
যশোরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবীতে মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে মিছিল, ১৯৬৮

আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি লাভের পর শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তান সফরে গেলে তাঁর সঙ্গী হন মোশাররফ হোসেন। ১৯৭০ সালে যশোর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন মোশাররফ হোসেন। একই সাথে হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যশোর সদর আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

নিজ বাসভবনের সামনে নির্বাচনে জয়ী মোশাররফ হোসেনকে ঘিরে কর্মী-সমর্থকরা, ১৯৭০। ছবিতে আরও যাঁদেরকে নির্দিষ্ট করা গিয়েছে- মশিয়ার রহমান, বীণা, জাকিয়া সুলতানা ইতি, মঞ্জু, আফরোজ জাহান বিথী, রিনা, ও রওশন জাহান সাথী।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে যশোর অঞ্চল থেকে নির্বাচিত এমপিএ ও এমএনএদের সংবর্ধনা সভায় এমপিএ মোশাররফ হোসেন। ছবিতে আরও যাঁদেরকে নির্দিষ্ট করা গিয়েছে- এস এম জামালউদ্দিন আহমেদ, মশিউর রহমান এমএনএ ও রওশন আলী এমএনএ।

নির্বাচনে জিতে আসাই শেষ কথা ছিলনা মোশাররফের জন্য। স্বাধীনতার জন্য জনমত গঠন করা ও প্রয়োজনে সশস্ত্র যুদ্ধের সম্ভাবনার কথাও তাঁর মাথায় ছিলো। স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী সমাজতন্ত্রে অনুরক্ত সদস্যদের নিয়ে গঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ (নিউক্লিয়াস) যা মুক্তিযুদ্ধের সময় বি.এল.এফ (মুজিব বাহিনী) নামে যুদ্ধ করেছে তাদের সাথে মোশাররফ হোসেনের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।

বঙ্গবন্ধু ছাড়াও যাঁদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা বিপ্লবী পরিষদের সদস্যরা পেয়েছিল তাঁরা হলেন এম.এ আজিজ (চট্টগ্রাম), এম.এ হান্নান (চট্টগ্রাম), মোশাররফ হোসেন (যশোর), আবদুল হাকিম, ইউসুফ আলী (দিনাজপুর), সোহরাব হোসেন (মাগুরা) ও তাজউদ্দীন আহমদ। (বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র — কাজী আরেফ আহমেদ — পৃষ্ঠা ৫৬)

(যশোরে) আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের গরিষ্ঠ অংশের নেতৃত্বদান করতেন মোশাররফ হোসেন। মূলতঃ ওই অংশ তিনিই এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। ছাত্রলীগের ওই অংশটি ছিল নিউক্লিয়াস সেলভুক্ত। তারা একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। যতদিন না স্বাধীনতা অর্জিত হয় ততদিন আন্দোলন চালিয়ে যাবার পক্ষে ছিলেন তারা। (মুক্তিযুদ্ধে যশোর — রুকুনউদ্দৌলাহ — পৃষ্ঠা ৪৮)

১৯৭০ সালে সাংগঠনিক কাজে যশোরে মোশাররফের বাসায় আসেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসম আব্দুর রব। একই সময়ে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের গোপন সাংগঠনিক কর্মসূচীতে যশোরে আসেন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি কাজী আরেফ আহমেদ। মোশাররফ হোসেনের বাসাতেই নিউক্লিয়াসের গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালে মোশাররফের বাসায় আসেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী। যশোরে ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী ছাত্রনেতাদের রাজনৈতিক কর্মসূচীতে মোশাররফের নিরবিচ্ছন্ন সমর্থন তাঁর বাসস্থানটিকে পরে পাকিস্তানী হানাদারদের প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করতে টালাবাহানা শুরু করে। ততদিনে ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতির স্বাধিকারের প্রত্যাশা সার্বভৌমত্বের দাবী হয়ে উঠেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের দাবী তখন প্রগতিশীল বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের কাছে অপরিবর্তনীয় এক দফা। সারা দেশের স্বাধীনতাপন্থী নেতা-কর্মীদের মত যশোরে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন মোশাররফ হোসেন।

পাকিস্তানী সেনাদের তাক করে রাখা বন্দুকের গুলিকে চ্যালেঞ্জ করে মিছিল থেকে ছুটে যেতে থাকে স্লোগানের বুলেট- জয় বাংলা। এক অনন্য ঘটনা ঘটে তখন। বাবা মোশাররফ হোসেনের সাথে জয় বাংলার মিছিলে একই সাথে দেখা যায় তাঁর তিন মেয়ে সাথী, বিথী ও ইতিকে। বাবার সাথে তাঁর মেয়েরাও স্লোগানে মুখরিত করেন যশোরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, স্বাধীনতার দাবীতে।

যশোরে স্বাধীনতার দাবীতে মিছিলে বাবা মোশাররফ হোসেন ও তাঁর তিন মেয়ে সাথী, বিথী ও ইতি, ১৯৭১। ছবিতে আরও যাঁদেরকে নির্দিষ্ট করা গিয়েছে- মইনুদ্দিন মিয়াজী (এমপিএ), মশিউর রহমান (এমএনএ), আব্দুল হাই (পরবর্তীতে এমপি), এস এম জামালউদ্দিন আহমেদ, রবিউল আলম, রিনা, মশিয়ার রহমান, বীণা, মঞ্জু ও জাহানারা বেগম দোলন।

১৯৭১ সালের সে মিছিলই রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সাথী-বীথি-ইতির প্রথম অংশ গ্রহণ নয়। যশোর ছাত্রলীগে তারা আরও আগে থেকে জড়িত। বড় বোন রওশন জাহান সাথী তখন যশোর ছাত্রলীগের নেত্রী। বাবার সাথে সাথে আরও আগে থেকে রাজনীতিতে তার সরব উপস্থিতি। সাথী ছাত্রলীগের ভেতর স্বাধীনতাকামীদের নিয়ে গঠিত গোপন সংগঠন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্য। তিনি ১৯৬৮-১৯৭১ সময়কালে যশোর মহাকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং একই সময়কালে যশোর জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

অন্যদিকে ১৯৭০ সালে নিন্দিত পাকিস্তানের কৃষ্টি ও সভ্যতা নামের বইটি পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করলে তার প্রতিবাদ করে ছাত্র সমাজ। যশোর জেলা স্কুল, সম্মিলনী স্কুল, মমিন গার্লস স্কুল ও মধুসূদন বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তিনজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধির নেতৃত্বে যশোর শিক্ষাবোর্ডে স্মরকলিপি জমা দেন। সেই তিনজনের একজন ছিলেন আফরোজ জাহান বিথী।

মিছিলে মোশাররফের তিন মেয়ে রওশন জাহান সাথী, আফরোজ জাহান বিথী ও জাকিয়া সুলতানা ইতি। ছবিতে আরও যাঁদেরকে নির্দিষ্ট করা গিয়েছে- আব্দুস সালাম, গোপাল, ফিরোজা, ডরোথি দাস হিয়া, বীণা ও মঞ্জু।
যশোরে স্বাধীনতাকামী নারীদের পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লাঠি মিছিল। ছবিতে যাঁদেরকে নির্দিষ্ট করা গিয়েছে- রাণী, আফরোজ জাহান বিথী, ফিরোজা, জাকিয়া সুলতানা ইতি, আশরাফুন্নেসা বেগম (যশোর আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা)। মিছিলে অগ্রবর্তী রওশন জাহান সাথী ফ্রেমের বাইরে।

এটি সর্বজনবিদিত যে ছয় দফার মতো স্বাধীনতার প্রশ্নেও আওয়ামী লীগের ভেতর দ্বিমত ছিল। কিন্তু মিছিলের স্লোগানকে যে যুদ্ধের বুলেটে রূপান্তরিত করতে হবে সে বিষয়ে আগেই নিশ্চিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মোশাররফ হোসেন। বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা জাহিদ হোসেনের সহায়তায় বিশ্বস্ত ছাত্র-যুবকদের জন্য সমরাস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয় তাঁর তত্ত্বাবধানে। যশোরের শংকরপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় সে প্রশিক্ষণ চলত। এমন কী তাঁর গুরুদাশ বাবু লেনের বাসার পাশের মাঠেও সন্ধ্যার পর চলত গেরিলা প্রশিক্ষণ।

যশোর আওয়ামী লীগের মধ্যে দুটি দল ছিল। একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন এ্যাডভোকেট মসিয়ুর রহমান, রওশন আলী, সোহরাব হোসেন। অপর দলটির নেতৃত্বে ছিলেন এ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন। চিন্তার ক্ষেত্রে দুটি দলের মধ্যে দুই ধরনের ছিল মতবাদ। (রণক্ষেত্রে সারাবেলা — হোসেনউদ্দিন হোসেন — পৃষ্ঠা- ১৩)

মশিউর রহমান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত কাছের মানুষ। তিনি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন। এ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও তাঁর ধারণা ছিল দেশকে স্বাধীন করতে হলে প্রয়োজন হবে সশস্ত্র লড়াইয়ের। তাই আগে ভাগে উপলব্ধি করেছিলেন দেশের পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নিচ্ছে। এই কারণে নিজের দলের মধ্যে একটি সচেতন বিপ্লবী গ্রুপ তৈরী করেছিলেন। মশিউর রহমান, রওশন আলী দুজনে ছিলেন স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে। তখনও পর্যন্ত তাঁরা স্বাধীনতার বিষয়টির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেননি। কিন্তু অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন স্বাধীনতাকে মূল লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। (রণক্ষেত্রে সারাবেলা — হোসেনউদ্দিন হোসেন — পৃষ্ঠা ১৪)

অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন ছিলেন আওয়ামী লীগ যশোর জেলা শাখার শীর্ষস্থানীয় একজন রাজনীতিক। আওয়ামী লীগের ব্যানারে রাজনীতি করেও তিনি স্বতন্ত্র মনোভাব পোষণ করতেন। তিনি তার দলের এ অঞ্চলের প্রথম নেতা, যিনি মনে করতেন বাঙালিদের জন্য আলাদা একটি আবাসভূমি দরকার- দরকার স্বাধীনতা। (মুক্তিযুদ্ধে যশোর — রুকুনউদ্দৌলাহ -পৃষ্ঠা ৪৮)

জেলা ন্যাপ নেতা আলমগীর সিদ্দিকীর সাঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেনের একটা গোপন বৈঠক হয়। এই বৈঠকে উভয় নেতা সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য একমত পোষণ করেন। দুই নেতার সিদ্ধান্তটি ‘৭১-এর ৮ই ফেব্রুয়ারিতে নিজ নিজ কর্মিদের মধ্যে প্রকাশ করা হয়। (রণক্ষেত্রে সারাবেলা — হোসেনউদ্দিন হোসেন — পৃষ্ঠা ১৩)

১৯৭১ সালের ৩রা মার্চের মিছিলে প্রথমে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে পাকিস্তানীরা। প্রথমে ছত্রভঙ্গ হলেও মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করে মিছিল চলতে থাকে। মিছিলের একটা অংশ টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কাছে পৌঁছালে আবার গুলি শুরু হয়। তখন তখন উপায়ন্তর না দেখে আর সামনে যাওয়ার জন্য মোশাররফ সবাইকে অনুরোধ করেন। মিছিলের অনেকে তখন সমাবেত হন মোশাররফের বাড়ির আঙিনায়। কিন্তু সেদিন আর চা-পানি খাওয়ার সুযোগ হয়নি। মোশাররফের গুরুদাস বাবু লেনের দোতলা বাসার এক পাশের খোলা ছাদে অবিরাম গুলি করতে থাকে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ছাদে অবস্থান নেয়া পাকিস্তানীরা। সেই গোলাগুলির এক পর্যায়ে প্রাণ হারান চারুবালা কর। চারুবালা করের মৃত্যুতে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে যশোর। হত্যার প্রতিবাদে আবারও মিছিলে-স্লোগানে মুখরিত হয় যশোর।

চারুবালার লাশ নিয়ে সমগ্র শহর প্রদক্ষিণ করা হয়। এদিন মিছিলের নেতৃত্ব দেন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর মশিয়ুর রহমান, মোশাররফ হোসেন, রওশন আলীসহ অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। ( মুক্তিযুদ্ধে যশোর — আসাদুজ্জামান আসাদ — পৃষ্ঠা ৬)

স্বাধীনতার এক দফা দাবীর বাস্তবায়ন ততদিনে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। অসহযোগ আন্দোলনে বেকায়দায় পড়া যশোর সেনানিবাসের রসদ সরবরাহের নিশ্চয়তার অনুরোধ ছিল যশোর সেনানিবাসের। পাকিস্তানী কর্নেল তোফায়েল ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সকালে চা-চক্রের অনুরোধ করে যশোর আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে, যাতে করে খাদ্য-পানীয়ের সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়।

যশোর সেনানিবাসে থাকা বাঙালী সদস্যদের কথা মাথায় রেখে সকালের চা-চক্রে যেতে সম্মত হন নেতারা। কিন্তু যেভাবে তাঁরা গেলেন সেখানে তা পাকিস্তানীদের কাছে অভাবিত। তারা দেখে যে আওয়ামী লীগ নেতাদের বহনকারী গাড়িতে লাগান বাংলাদেশের পতাকা! সে মিটিং থেকে ফেরার সময় দেখা গেল গাড়িতে লাগান বাংলাদেশের পতাকা খুলে ফেলেছে পাকিস্তানীরা। আরও বড় বিস্ময়ের মুখোমুখি হতে হয় পাকিস্তানী কর্নেল তোফায়েলকে নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের পতাকা ছাড়া ফেরত যেতে অস্বীকৃতি জানানোয়! মোশাররফ হোসেনসহ উপস্থিত অন্য নেতাদের দৃঢ়তায় পাকিস্তানী কর্নেল তোফায়েল গাড়ি থেকে খুলে নেয়া বাংলাদেশের পতাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়।

ঘটনা সেখানেই শেষ নয়। কর্নেল তোফায়েল হাজির করে নতুন আবদার। রাতে আলোচনার জন্য ডিনারে যেতে হবে আবার। কিন্তু ততক্ষণে নানান দিক থেকে খবর আসতে শুরু করেছে মোশাররফ হোসেনের কাছে। যশোরের সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর কাছে খবর পাঠিয়েছেন যশোরে পাকিস্তানীদের সামরিক প্রস্তুতির বিষয়ে। ঢাকা থেকেও আসে খবর, “পরিস্থিতি যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে”।

ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) -এর সেক্টর কার্যালয় তখন যশোরের ভোলা ট্যাংক রোডে। সেখান থেকে ইপিআরে কর্মরত সেকেন্দার আলী নিয়ে এলেন ভেতরের খবর। সব মিলিয়ে তখন আর আলোচনা নয়, যুদ্ধ প্রস্তুতিই একমাত্র কর্তব্য হয়ে উঠেছে। রাতে ডিনারে যাওয়ার বিষয়ে আলাপ হলে মোশাররফ দৃঢ়ভাবে তার বিরোধিতা করেন। তাঁর বক্তব্য হল যে যদি তাঁরা সেখানে যান, তাহলে পাকিস্তানীরা আর তাঁদের ফিরতে দেবেনা। ওখানেই সব শেষ হয়ে যাবে। তিনি জোর দিয়ে মশিউর রহমানকে বললেন যে আর যাওয়া যাবেনা। ডিনারে গেলে তারা আমাদের সবাইকে আটক করবে। যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে মতভিন্নতার সমাধান করতে ছাত্রনেতারা স্পষ্টভাবে মোশাররফের পক্ষ নিলেন। যুবনেতাদের ভেতর আলী হোসেন মনি, রবিউল আলম, শেখ আব্দুস সালাম, মশিয়ার রহমান প্রমুখ যুদ্ধপ্রস্তুতির পক্ষে এবং সেনানিবাসে যাওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেন।

এরপরও মশিউর রহমানের সাথে মোশাররফের কথা হয় ফোনে। তাঁকে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে পরামর্শ দেন বাসা ছাড়তে। কিন্তু মশিউর রহমান শেষ পর্যন্ত বাসাতেই থাকেন। মশিউর রহমানকে বাসা থেকে আনতে ছাত্রনেতা আব্দুস শহীদকে পাঠান মোশাররফ। কিন্তু বাসা ছাড়েননি তিনি। ২৬ শে মার্চ পাকিস্তানী আর্মি তাঁকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে।

এর পরের ঘটনা প্রবাহ থাকছে বাংলাদেশ পর্বে।

--

--