নেসলের জাপান জয় ও একজন বিতর্কিত মার্কেটিয়ার

Shad Iqbal
ডিজাইন বাংলা
3 min readFeb 1, 2019

সত্তরের দশকে নেসলে বেশ একটা সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল। সেই সময় জাপানের অর্থনীতির দুর্দান্ত গতিকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে ব্যবসা করা যায়, তারা সেটার একটা উপায় খুঁজছিল।বলাই বাহুল্য, তারা একটাই উপায় খুঁজে পেলো—কফি বিক্রি!

কিন্তু এদিকে জাপানীদের সর্বজন বিদিত চায়ের প্রতি ভালবাসা অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। তাই নেসলে খুব সাবধানে বাজার যাচাই করতে শুরু করল। তাদের রিসার্চার টিম একের পর এক ফোকাস গ্রুপ করে সববয়সী কাস্টমারদের থেকে জানতে চাইলো, তারা নেসলে কফি সম্পর্কে কি ভাবছে।

Oishi! | Unsplash

অবাক ব্যাপার, সবাই খুবই পছন্দ করল! সব ফোকাস গ্রুপ রিসার্চ থেকে একই ফলাফল আসলো- জাপানী ভোক্তারা কফির স্বাদ খুব তারিফ করছে।

অবস্থা দেখে নেসলের কর্তারা বেশ উদ্দীপ্ত হলেন— সামনে দারুন ব্যবসার হাতছানি! তারা পূর্ণ উদ্যমে জাপানীদের টেবিলে টেবিলে কফি পৌঁছে দেবার মহা পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামলেন। ব্যাপক মার্কেটিং, দেশব্যাপী ডিস্ট্রিবিউশনে বিপুল খরচ করে নেসলে মার্কেটে আসলো ঝলক দেখাতে।

এবং তারপর... কিছুই না।

নেসলে কফি জাপান বাজারে স্রেফ মুখ থুবড়ে পড়ল।

সব আছে, শুধু কাস্টমার নেই কফিশপে! Unsplash

এর কোন মানে হয়?! প্রতিটা রিসার্চ রিপোর্ট বলছে নেসলে কফি হবে জাপানের নেক্সট বিগ থিং, কিন্তু জাপানীরা চায়ের স্বাদেই মজে থাকল, কফিকে পাত্তা দিলনা। তারা কফির স্বাদ পছন্দ করছিল, কিন্তু টাকা খরচ করে কেনার কথা উঠলেই মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছিল।

এই ভীষণ চক্করে পড়ে, নেসলে তৎকালীন মার্কেটিং দুনিয়ার এক বিতর্কিত সুপারস্টার, ক্লোটেয়ার রাপাইল (Clotaire Rapaille)-কে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিল।

ক্লোটেয়ার কোন সাধারণ মার্কেটিয়ার ছিলেন না। তার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা-কাজ সংশ্লিষ্ট মহলে প্রচুর বিতর্কের সূচনা করেছে। শুরুতে তিনি একজন শিশু মনোবিদ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে কাজ করছিলেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি একটা বিষয় বুঝতে পেরেছিলেন — মানুষ আসলে যা চায়, তা তারা বলতে পারে না।

তিনি বিশ্বাস করতেন, যে স্পৃহাগুলো মানুষকে পরিচালনা করে সেগুলো আসলে অচেতন মনের। এবং খুব কম মানুষই সেটা বোঝার মত, প্রকাশ করার মত যথেষ্ট আত্মসচেতনতা রাখে। ক্লোটেয়ার এই ব্যাপারটাকে বলতেন রেপ্টালিয়ান ইন্সটিঙ্কট।

জীপ (Jeep) কোম্পানির সাথে ক্লোটেয়ারের কাজের উদাহরণ দেয়া যাক- জীপের লেটেস্ট মডেলগুলো কেন যেন বাজারে একেবারেই বিকোচ্ছিল না এবং কোম্পানি এর কোন কারণও খুঁজে পাচ্ছিল না। তখন ক্লোটেয়ার এসে একটা উদ্ভট পরামর্শ দিলেন — "আপনারা বরং আবার গোল হেডলাইট ফিরিয়ে নিয়ে আসুন"।

আগে এবং পরে

কেন? ক্লোটেয়ার উপলব্ধি করেছিলেন যে, আমেরিকান ব্যবহারকারীদের জন্য জীপ মানে হল স্বাধীনতা। তাদের কাছে এটা বুনো পশ্চিম, মুক্তভাবে ছুটে চলা এবং... ঘোড়ার প্রতীক।

আমেরিকানদের জন্য জীপ ছিল আধুনিক ঘোড়া। যখন জীপ তাদের হেডলাইট গোল থেকে চৌকো করে ফেলল, তখন তারা সেই যোগসূত্রটা হারিয়ে ফেলল, কারণ হেডলাইটগুলো আর ঘোড়ার চোখের মত দেখাচ্ছিল না

জীপ আবার হেডলাইট আগের মত গোলাকৃতির করে ফেলল এবং বিক্রিও বেড়ে গেল। দারুণ ব্যাপার সন্দেহ নেই!

এখন আবার নেসলে এবং জাপানে ফিরে যাই।

ক্লোটেয়ার পৌঁছে কাজ শুরু করে দ্রুতই একটা বিষয় বুঝতে পারলেন, জাপানী ভোক্তাদের কফির সাথে কোন বন্ধন নেই, আরো নির্দিস্ট করে বললে, কোন শৈশব স্মৃতি নেই। জাপানী শিশুরা মা-বাবাকে চা খেতে দেখতে দেখতে বেড়ে উঠেছে, চায়ের গন্ধমাখা পরিবেশে বড় হয়েছে এবং নিজেও চায়ের সাথে নাস্তা খেয়েছে। বড় হয়ে তারা কফির বদলে চা’ই বেছে নেবে এতে আশ্চর্য হবার কি আছে?

তাহলে ক্লোটেয়ার কি সুপারিশ করলেন?

কফি ক্যান্ডি!

বিংগো! Japanese Meiji Candy

হঠাৎ করে জাপানী শিশুর দল হরেক রকম ক্যান্ডির মাধ্যমে কফির স্বাদ আবিষ্কার করতে লাগল। সেখান থেকে তারা ধীরে ধীরে কফি-ফ্লেভারড কোল্ড ড্রিঙ্কের দিকে ঝুঁকে পড়ল। পরের ধাপে শুধুই কফি। এবং তারপর তারা বোঝার আগেই তাদের হাতে মগভর্তি ধূমায়িত নেসলে কফি

এই প্রজন্ম যখন বেড়ে উঠল কফির স্বাদ নিয়ে, তখন নেসলের অন্যান্য প্রডাক্টের জন্যও মার্কেট একদম তৈরি হয়ে গেল।

একটা পুরো প্রজন্মকে টার্গেট করে দশকব্যাপী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলাফল এখানে। যারা এমনকি ৪০ বছর আগেও কফি কিনতো না, তাদের জন্য সংখ্যাটা মন্দ নয়, কি বলেন?

--

--

Shad Iqbal
ডিজাইন বাংলা

UX Lead at 10 Minute School, Contributor at UX Bangladesh, Focusing on edtech, user research, product psychology, UX strategy and design ops