আমার প্রিয় বাংলা
বাংলা ভাষার প্রেমে আমি সেই ছোটবেলা থেকেই পড়েছি, সম্ভবত বই পড়ার অভ্যেস থেকেই শুরুটা। স্কুল থেকে আসার পরে আমার প্রথম কাজটা ছিল গল্পের বই নিয়ে বসা। এখনকার বাচ্চাদের মত আমরা বোর্ডের নিত্য নতুন বই পেতাম না, সবসময় দোকান থেকে বোর্ডের বই কিনতাম, বার্ষিক পরীক্ষা শেষের পর এলাকার বইয়ের দোকানে হানা দিতাম আর উৎসুক হয়ে জানতে চাইতাম নতুন বই এসেছে কিনা। সত্যি কথা বলতে, অন্য সব বিষয়ের বইয়ের চেয়ে ‘আমার বই’ এর প্রতি আমার আগ্রহ থাকত সবচেয়ে বেশী। সিলেবাসে যাই থাকুক না কেন, কেনার পরপরই সব গল্প আর কবিতা পড়া হয়ে যেত। বাংলায় কবিতা আবৃতি করে যে আনন্দ আমি পেতাম তা বোধহয় অন্য কিছুতে পাওয়া যেতনা। আজও রূপকথার রাজকন্যা আর রাজপুত্র আমার সবথেকে প্রিয়, তারা এখনও আমার মনের গভীরে উঁকি দেয় সাদরে।
কোথায় জানি পড়েছিলাম- বাংলা ভাষার মত মিষ্টি ভাষা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। দুঃখের বিষয় হল এই মিষ্টি ভাষা নিয়ে আমার কিছু ভুল ধারণা ছিল। আমার প্রথম ভুল- যখন একদম বেশী ছোট ছিলাম, ভাবতাম পৃথিবীর সবাই বাংলায় কথা বলে, মনের ভাব প্রকাশের জন্য এটি ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু এরপরই ভুলটা ধরিয়ে দেয়া হল- না পৃথিবীতে বাংলা ছাড়াও আরও অনেক ভাষা আছে, আজকের দিনে আর না হলেও সাড়ে ছয় হাজার ভাষাতো আছেই।
এবার আসি আমার দ্বিতীয় ভুলে- আমি এরপর ভাবা শুরু করেছিলাম তাহলে বাংলাদেশের মানুষই বাংলায় কথা বলে এবং অন্য দেশী মানুষরা তাদের ভাষায় কথা বলে। এই ভুল বোঝাবুঝির অবসান হোলো পার্লারে গিয়ে, যে আপু সুন্দর করে হেসে চুল কেটে দিচ্ছিলেন সে অন্যরকম এক ভাষায় পাশের আপুর সাথে মতবিনিময় করছিলেন। জানতে পারলাম ওনারা বাংলাদেশী কিন্তু উপজাতী বিধায় ওনাদের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা আছে। এমনকি পাশের দেশ ভারতেও নাকি কলকাতা বলে একটা শহর আছে যেখানকার মানুষও বাংলায় কথা বলে।
এরপর আমি ভাবা শুরু করলাম তাহলে হয়তো ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশের মানুষ বাংলায় কথা বলে। নাহ এটাও ভুল- বাংলা ভাষা মিশে আছে আমাদের সাথে অনেক আগে থেকেই। স্বাধীনভাবে নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য এক ঝাঁক তরুণ নিজের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী। সালাম, রফিক, সফিকুর, বরকত এবং নাম না জানা শহীদের ত্যাগ বৃথা যায়নি সেদিন, শাসনকর্তারা সে সময় ‘বাংলা’-কে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করলেন। ভাষা আন্দোলনের সেই চেতনা আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল একটা স্বাধীন দেশের জন্য। মাতৃভাষার জন্য নিজের জীবনকে বিসর্জিত করার উদাহরণ এ বিশ্বের কোথাও নেই। শহীদদের এই ত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ, ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বরের ইউনেস্কোর প্রস্তাবে ২০০০ সাল থেকে প্রতি ২১ শে ফেব্রুয়ারী পালিত হয়ে আসছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। বাংলার সেই সাহসী মানুষের জন্য সবাই এখন ২১শে ফেব্রুয়ারী পালন করে এক বুক ভালবাসা নিয়ে নিজের ভাষার জন্য, যে ভাষায় সে মা-কে প্রথম ডাকে, প্রিয় মানুষকে মনের কথা বলে আর প্রথম বুলি শোনে সন্তানের মুখে।
আমাদের ভাষা অর্জনের এই বিরল দৃষ্টান্ত নিজের বাংলা ভাষার জন্য ভালবাসা বাড়িয়ে দিয়েছিল দ্বিগুণ। স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে কর্মজীবনে যখন ঢুকলাম তখন দেখতে পেলাম আশেপাশের বন্ধুরা যেসব কোম্পানিতে কাজ করছে নামগুলোও বিদেশী। একদিন এক কোম্পানি থেকে ডাক আসলো, নতুন কিছু নিয়ে কিছুদিনের ভিতরেই যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে তারা। ইন্টারভিঊতে জানতে পারলাম কোম্পানির নাম ‘হারিকেন’, বাংলায় প্রবাদই আছে ‘হারিকেন দিয়ে খুঁজা’ সেখান থেকেই নামটা নেয়া যাতে মানুষ তার শিকড় আঁকড়ে এই যুগেও ডিজিটালভাবে প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজে পায় খাবার বা খাবারের দোকানের। সত্য কথা বলতে নামটা শুনে খুব ভালো লাগলো, বাংলা নাম- কেউ জানে না , কখনও কেউ শুনেওনি। বেতন নিয়ে প্রথমদিন কোনও কথা বলা হলনা, কিন্তু মনে মনে ঠিক করলাম আমাকে যদি আবার ডাকে এই কোম্পানিতেই চাকরি করবো। মানুষ চেনা-জানা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির নাম যখন বলবে আমি তখন সবাইকে ‘হারিকেন’ এ আছি বলে ভড়কে দিব। অন্যদের সবাই যখন বলবে ‘ওয়াও’ আমাকে তখন জিজ্ঞেস করা হবে ‘এটা কেমন নাম?’, তখন আমি কায়দা করে বাংলার সেই চিরাচরিত প্রবাদ শুনিয়ে দিবো। চাকরিটা আমি আল্লাহর রহমতে পেয়েছি, সত্যি বলছি আজ পর্যন্ত যাদেরকে আমি আমার কোম্পানির বাংলা নামটা বলেছি, সবাইকে নামের পিছনের গল্পটাও বলেছি। জীবনের এই পর্যায়ে এসে বেশীরভাগ সময়ই দিতে হয় কর্মক্ষেত্রে, আমি ভাল আছি আমার হারিকেন নিয়ে- কারন এই নামটা যে আমাকে সবসময় মনে করিয়ে রাখে বাংলা আমার।
ভাষার প্রতি ভালবাসা আজ ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে, প্রতিটি মানুষের মনে। ভালো থাকুক সব ভাষার মানুষ, ভাষা হোক ভালোবাসার।