মাঝরাতের প্রলাপ — ১

Riddhiman Adib
My Online Cafe
Published in
4 min readJan 6, 2014

এত বেশি আলসে হয়েছি আগের থেকে যে কষ্ট করে কোন কিছু লিখবো এটা ইচ্ছেই করে না। খুব বেশি বোর লাগলে কোন একটা গেম বা টিভি সিরিয়ালে ডুবে যাই। দিন দুনিয়ার কথা খেয়াল থাকে না। সে এক দিয়ে ভালো। কোন কিছু স্পর্শ করে না। বাইরের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ ডিটাচড। নেশাখোররা যেমন নেশা করে সমাজের বাইরে চলে যায়, অনেকটা ওরকমই, পার্থক্য কেবল নেশা টা।

ডুবে থাকার কারণও আছে। চারপাশ। কেমন যেন বেশি রকম অদ্ভুত। খুবই একঘেয়ে, বৈচিত্র্যহীন। এখন দেশে একটা অস্থিরতার সময়। অর্থনীতি ধ্বসে পড়ছে, রাজায়-রাজায় মারামারি, টুপটাপ পাতার মত মানুষের জীবন খসে পড়ছে। কিন্তু সেজন্য আমি হতাশ না। কোন দেশ বা সমাজ থাকলে তাতে অস্থিরতাও থাকবে, ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যাবে এ আর নতুন কি !! বাস্তবিকই আমাকে সেগুলো স্পর্শ করছে না। আমি কেয়ারও করি না। কে ক্ষমতায় এলো, আর কে কার গদিতে টান মারল, আমার এগুলো নিয়ে অর্থহীন তুমুল গবেষনা ভালো লাঘে না। অনেকটা এখনকার টক-শো গুলোর মত, খুব আলোচনা হচ্ছে, এটা করা উচিত, ওটা করা উচিত, কিন্তু পুরোপুরি ফলাফলহীন।

যেটা বলছিলাম, হতাশা, এর কারন একটাই, জীবন। আমাদের জীবন যে কতখানি ছোট, আর কতখানি মীনিংলেস এটা ভাবতে গেলেই আমার অবাক লাগে। আমরা প্রত্যেকেই ভাবি আমরা একটু আলাদা, একটু ভিন্ন। আমি একটু অন্যভাবে কথা বলি, একটু অন্যরকম গল্পের বই পড়ি, অন্যরকম ভাবে চলি, আমি অন্যদের মত না। আমি ইউনিক। অন্য দশ জনের সাথে আমার তুলনা চলে না।

পুরোটাই ঠিক আছে, সমস্যা কেবল এক জায়গাতেই। আমরা কেউই ইউনিক না। আমি যে সমস্যায় পড়েছি এটা আমার আগে লাখ লাখ মানুষ পড়েছে। আমি যেই গানটা শুনছি সেটা সারা পৃথিবীতে হাজার হাজার মানুষ শুনছে। আমি বইয়ের যে অংকটা করছি সেটা আগেও হাজার হাজার মানুষ করে গিয়েছে। কোন ভেরিয়েশন নেই, ইউনিকনেস নেই। স্বাদহীন। একটু দূর থেকে দেখলেই বোঝা যায় আমাদের জীবন কতখানি ঠুনকো আর অর্থহীন।

কোন কিছুরই যে কোন অর্থ নেই, কোন তাৎপর্য নেই, কোন লক্ষ্য নেই, এটা কেউ ভাবতে চায় না। কষ্ট ছাড়া বাঁচার জন্য আমরা নিজেরাই একেকটা দাম দিয়ে নেই, অনেকটা প্রাইস ট্যাগের মত, সবকিছুতে। তারপর সেই দাম অনুযায়ী যে যেটা করতে পারে, তাকে তত বেশি সফল বলি আর মাথায় তুলে রাখি। অনেকটা ছোট বাচ্চাদের রান্না-রান্না খেলার মত। একজন রান্না করে, একজন পুতুল বিয়ে দেয়। তারপর নিজেরাই সেটার উপর মন্তব্য করে,তোর রান্নাটা খুব ভালো হয়েছে, তোর জামাইটা অনেক সুন্দর। ছোট বাচ্চাদের মত। আমাদের চারপাশটাকেও আমরা একটা বড়দের খেলাঘর বানিয়ে নিয়েছি। “ভালো কোথাও পড়ছো, বাব্বা, বেশ ভালো ছেলে।” “রান্না পারে না, মেয়ে কোন কাজের না।” “রুশ সাহিত্য পড়ছো, হুম, ছেলের রুচি আছে।” “ডেত মেটাল শুনছো, কি যে হয়ে গিয়েছে না আজকালের জেনারেশনের, গানকে আর গান মনে করে না।”

কোন কিছুরই যে কোন নিয়ম নেই, আমরা যে একটা কমপ্লিট chaos এর মধ্যে আছি, এটা কেউ ভাবতে চায় না।

বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে কোন কিছুর কোন পয়েন্ট নেই, কোন মীনিং নেই, কোন টার্গেট নেই। আমাকে ভালো করতেই হবে কোন কথা না, খারাপ হতেই হবে এটাও কোন কথা না। এটা একইসাথে খুবই কষ্টের এবং মজার।

তাহলে বেঁচে থাকার তাৎপর্য কি? উদ্দেশ্য কি?

নেই, কোন তাৎপর্যও নেই, উদ্দেশ্যও নেই।

এই চিন্তাটা মেনে নেয়া অনেক বেশি কষ্টের। এবং এটার ভয়ে একেকজন একেক রাস্তা বেছে নেয়। কেউ নিজেকে ধর্মের কোলে ঠেলে দেয়,যে আর যাই হোক, পরকাল তো আছে। আবার কেউ এগুলো নিয়ে চিন্তাই করে না। কেউ আবার ভাবে, সবাই যা করতেছে, আমিও তাই করি, কি দরকার এত রিস্ক নিয়ে।

আমি অনেক ভেবেছি এটা নিয়ে, পয়েন্টতা কি জীবনের? কেন আমি একটা মানুষ আর কেন আমি এমন? তখন একটা সময় আমি হঠাৎ অনুভব করলাম, না, পয়েন্ট আছে। আমাদের এই জীবনের, বা এই জগতের কেবলমাত্র একটাই পয়েন্ট আছে। কেবল একটা জিনিষই ইউনিক। কেবল একটা কিছুই সবার থেকে আলাদা।

সৃষ্টি।

সৃষ্টির ক্ষমতা প্রত্যেক জীবেরই আছে। সামান্য পিপড়াও অসম্ভব সুন্দর বাসা তৈরী করে। সামান্য বাবুইও তালগাছে বাসা বেধে ফেলে। আর আমরা মানুষ, এত সুন্দর একটা মগজ নিয়ে খাই-দাই আর ঘুরে বেড়াই। কেন ? কেন আমরা বুঝি না, একমাত্র সৃষ্টির এক্সপেরিয়েন্সটাই ইউনিক, আলাদা। এবং দুঃখের কথা হচ্ছে, এমন না যে আমরা পারি না, আমরা আসলে চেষ্টাই করি না।

খুব বেশি অদ্ভুত একটা ডিফেন্স মেকানিজম আছে আমাদের। আমরা সবাই ছোটবেলায় চেষ্টা করি। গান গাইতে, কবিতা লিখতে, ছবি আঁকতে। খুব বাজে একটা ছবি নিয়েও আমরা গর্ববোধ করি। কিন্তু যত বড় হই, তত লজ্জা আমাদের মাথায় চেপে বসে, আর সমাজের নিজস্ব প্রাইস্ট্যাগ গুলো আমাদের নজর কেড়ে নেয়। তখন আমরা নিজেদের বোঝাই, “ভাই আমি তো পারি না”,”আমি তোদের মত এত ক্রিয়েটিভ না”, “আমার এইগুলার টাইম নাই, ফ্যামিলি আছে, ইনকাম করতে হবে।”, ইত্যাদি ইত্যাদি নানাবিধ অজুহাত।

আমরা বুঝ দেই নিজেদের যে, আমাদের মধ্যে কিছু নেই, আমরা টিপিক্যাল হিউম্যান। এবং সেতা নিজ্যে লজ্জা পাবারও কিছু নেই। টিপিক্যাল হিউম্যান হওয়ার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই। খাবো, পড়বো, ইনকাম করবো, বিয়ে করবো, বাচ্চা হবে, বাচ্চা বড় করবো, তাদের নিজেদের জীবন হবে, এক সময় আমার আশেপাশের সবাই মারা যাবে। আর বৃদ্ধ আমি সেইদিন হুইলচেয়ারে বসে পিছন ফিরে জীবনের দিকে তাকিয়ে আবিষ্কার করবো, আমার জীবনের একমাত্র কাজ ছিলো, ৬০-৭০বছর কাটানো, আর একমাত্র ফলাফল ছিলো, মারা যাওয়া।

না, it’s not ok to be typical. আমাদের যেটা আছে, চিন্তাশক্তি, এত লাখলাখ লিভিং অরাগানিজমের সেটা নেই। এত সুন্দর একটা ক্ষমতা এভাবে নষ্ট করা ঠিক না।

অথচ আমরা সবাই পারি। যে গান গাইতে পারে সে চাইলে সুরও করতে পারে, হোক না সেটা বাজে, হোক না সেটা কারো গানের মত, সমস্যা কি, সৃষ্টির আনন্দটা তো সে পেয়েছে। যে শুধু পড়াশোনাই পারে, সেও পারে কিছু একটা ডিজাইন করে ফেলতে, নিজের মত কিছু একটা বানাতে। তোমার যে সবাইকে দেখাতেই হবে এটাও কোন কথা না, কিছু একটা সৃষ্টি কর, হোক না সেটা শুধুই নিজের জন্য। সেটাই বা মন্দ কি !

সৃষ্টির আনন্দ অপূর্ব, অসামান্য। যে মানুষ এর আনন্দ ছাড়া জীবন শেষ করে, সে নিজেও বোঝে না, কত অসামান্য একটা জিনিস, একটা জীবনকাল এবং সৃষ্টির ক্ষমতা, সে নষ্ট করলো। সত্য বলতে আমাদের আশপাশের মানুষের মধ্যে চিন্তা করার প্রবনতাটাই কম। সবাই আর্মির সৈনিক। উপরওয়ালা বলেছেন, এটা কর, ইয়েস স্যার, স্যালুট। বলেছেন, সুন্দরী দেখে বিয়ে কর, ইয়েস স্যার, স্যালুট। বলেছেন, ভালো স্যালারীর চাকরী নাও, ইয়েস স্যার, স্যালুট।

হোয়াট দ্য হেল !!!

এই জীবনের মানেটাই বা কি, আর উদ্দেশ্যটাই বা কি!!

একবার, স্রেফ একবার চেষ্টা করে দেখ, যা পারো সেটাতেই চেষ্টা করে দেখ, নিজে থেকে পুরোপুরি নতুন কিছু একটা করে ফেলার। শেষ বয়সে যেয়ে আমি এই ভেবে আফসোস করতে চাই না, ইশ, ওটা করতে পারতাম, এটা করতে পারতাম।

তাই প্রত্যেক বছরের মত এবারেরও রেজোলুশন আমার, নতুন কিছু করা। এসো, নতুন কিছু করি।

--

--

Riddhiman Adib
My Online Cafe

Postdoctoral Researcher. Tech Enthusiast. Occasional Blogger. Self-proclaimed Musician. more at: adib2149.github.io