যা ভাবছি…
দেখা যায় কি, মাথায় সবসময়ই কিছু না কিছু ঘুরছে। ভাবছি আর ভাবছি, দিশা পাচ্ছি না। একটা চিন্তা যখন আসে, সেটা সবসময় সবাইকে বা বিশেষ কাওকে বলতেও ইচ্ছে করে না, মাথায় ঘুরপাক খেতে খেতে একসময় কোথায় যেন হারিয়ে যায়। হারিয়ে গেলে তো গেলোই, আর তো ফিরে আসে না।
আবার একটা ব্যাপার আছে, কিছু মানুষ আছে যারা মন উজাড় করে ফেবুতে বকর বকর করতে পারে। বন্ধু অয়ন সেদিন একটা কথা শোনাইলো, মাথায় পুরা আটকে গেছে, Opinion is like asshole, everyone has one. সবাই বলতে চায়, কেউ শুনতে চায় না। তার চিন্তা, তার এখন দেশ নিয়ে কি ভাবনা, ধর্ম নিয়ে মতামত, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, স্কুল, কলেজ, মিডিয়া, ব্লা ব্লা। আমি পারি না। আমার কিছু নিজস্ব ভাবনাকে আমি চাইলেই গনমানুষের সাথে শেয়ার করতে পারি না,এবং করা উচিতও না। আমার মাথায় কি ঘুরছে, এবং কেন ঘুরছে সেটা শুধুমাত্র আমার কাছের মানুষগুলিই বুঝতে পারবে, কেননা তারা আমাকে চিনে। তারা আমার ভেতরটা জানে, তারা জানে কোনটা আমার শো-অফ অংশ আর কোনটা আসল ‘আমি’… কোনটা আমি ভাব নেয়ার জন্য ফেবুতে বলছি, আর আমার মাথায় আসলে আছেটা কি !!
একটা ভাবনার পিছের ভাবনা থাকে, তারও পিছে ভাবনা থাকে। যেমন, হয়তো একটা ভালো সিনেমা দেখলাম, তারপর সেটার মিউজিকটা নিয়ে ভাবলাম, সেখান থেকে কোন এক আর্টিস্ট, তার ব্যাকগ্রাউন্ড… এভাবে চলতে চলতে কোথায় গিয়ে যে ঠেকবে তার কোন দিশা নাই। হয়তো ঠেকলো গিয়ে আমার সাথে কোন বন্ধুর কথোপকথনে। এখন শুধু শেষ কথা নিয়ে চাইলেই স্ট্যাটাস দেয়া যায়, ডিবেট, লাইক, কমেন্ট, কত কি। কিন্তু কেউ তো জানবে না কোথায় এর শুরু। আর শুরু না জানলে কেউ ‘আসল আমি’ ভাবছি কি জানবে না, শুধু জানবে ফলাফলটা। সিদ্ধান্তের পাশে পাশে সিদ্ধান্তে আসার পথটাও সমান দরকারী।
ফেসবুকের একটা নিজস্ব চরম মেকী ভাব আছে। এখানে কিছু বলার মধ্যে দিয়েও মানুষ নিজেকে জাহির করতে চায়। কথা সত্য, একজন হয়তো লিখলো, “এই ছুটি আর ভাল্লাগছে না, লাইফ ইজ সো বোরিং”… সে কিন্তু বোরিংনেস টা জানায়নি, এবং সত্যি বলতে জানানোর দরকারও নেই, তার কাছ থেকে তার মন ভালো, না খারাপ, না বিষন্ন, কেউ জানতে চায়নি। তোমার মন খারাপ এ আমার কি হে!! সে জানাতে চায়, তার হাতে অনেক ছুটি, অন্য কারো সেটা নেই। একটুখানি bragging ।
কেন যেন সবাই আজকাল খুব ব্র্যাগিং করে এবং করতে চায়। আমি ভয়ঙ্গকর ভাবে সৌভাগ্যবান যে আমি যে কলেজে পড়েছি সেখানে আমার চারপাশে এত কোয়ালিফায়েড মানুষ ছিলো, যে সেখানে ভাব নেয়াটাই হাস্যকর হত। কেউ পড়াশোনায় ভালো, তো কেউ চমৎকার গীটার বাজায়। কেও তুঁখোড় সাঁতারু, তো কেউ চমৎকার ফুটবলার। কেউই কারো সাথে ভাবটা নিত না, এজন্য সেটাতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
কলেজের বাইরের দুনিয়াটা আবার প্রচন্ড ভিন্ন। এখানে ছাত্র-লাইফে এক জাজমেন্ট, রেজাল্ট ভালো, তো ছেলে ভালো। আর জব-লাইফে স্যালারী কত, ইনকাম ভালো তো পাত্র ভালো। এ বাদেও একটা মানুষ যে “মানুষ”, তার বুদ্ধিবৃত্তি কেমন, জীবনধারা কেমন, অন্য কোয়ালিটি কেমন, নো ওয়ান গিভস এ ড্যাম এবাউট দ্যাট। ফলে কি হয়, সবাই বলতে চায়, সে কেমন জোস, সে কেমন হলিডে কাটালো, সে কেমন এ প্রোগ্রামে এটেন্ড করলো। সবাই হিট হতে চায়, আপ্রান চেষ্টা করে।আমি বলি কি, তোমার লাইফের প্রতিটা ছোট মূহুর্তের বর্ননা দিয়ে মানুষজনকে বিরক্ত করার চেয়ে, বেটার এঞ্জয় ইট।
এটা আমার টুইস্টেড চিন্তা না, আমাকে কেউ বলতে পারবে না, “তুই এভাবে ভাবিস বলে মনে হয়, কই আমি তো এমন করি না”… কিন্তু না, আমরা সবাই করি, কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে। একটা উদাহরন দিলে বোঝা যাবে, আমার বিদ্যালয়ে রং-খেলার প্রচলন বেশ। প্রতি বছরই এক-দুবার রঙ্গখেলা হয়। এখন যদি নিয়ম করে দেয়া হয়, যে রংখেলা করা যাবে, কিন্তু কেউ কোন ডিএসএলআর আনতে পারবে না, ফেবুতে ছবি দিতে পারবে না, আমি নিশ্চিত অর্ধেকের বেশি রং-খেলুড়ে কমে যাবে। কারন এ খেলায় যত না মজা, তারচেয়ে বেশি মজা রং-মাখা মুখে প্রোফাইল পিক দেয়ায়, অন্যদের দেখানো, আমি মজা করছি। মানে একটু ভাব নেয়া আর কি।
এবং সমস্যা এখানেই, দেখা যায় যে , আমি আমার জীবনের কিছু সবার কাছে বলতে পারি না, মনে হয় শুধু, আমিও কি brag করছি না তো !! এই ভাবতে ভাবতে এখন আর থাকিই না ফেবুতে তেমন। ফেবুতে শুধু মজা নিতে ঢুকি, আর বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে আসি।
একসময় ফেবুতে খুব নোট লিখতাম, পোলাপাইন দামও দিত খুব। ভাল হইসে, জোস হইসে। ভালও লাগতো, এবং লাগবেই, লাগা উচিত। হয়তো মেয়েদের নিয়ে কিছু একটা লিখেছি যেটাতে সবাই উচ্ছ্বসিত, আবার সাধারন একটা গল্প লিখেছি, যেখানে কোন সাড়াশব্দ নেই। হতেই পারে, গল্পের অবস্থা বেগতিক :D , এ পর্যন্ত স্বাভাবিক, কারো ভালো না লাগলে বলবে কেন। কিন্তু ঠিক যেদিন আবিষ্কার করলাম যে, আমার আর গল্প লিখতে ইচ্ছে করে না, ইচ্ছে করে ফাজিল ফাজিল জোক্স রিলেটেড নোটস লিখতে,তখন বুঝলাম, আমি গেছি। আমি ভয়ংকর ইনফ্লুয়েন্সড হচ্ছি মানুষ দ্বারা। সাথে সাথে লেখা বাদ দিলাম। দরকার নাই। যেটা আমি না, সেটাতে আমার কষ্ট করার প্রশ্নই আসে না।
হঠাৎ করে দীর্ঘদিন পর আমি জানতে পারলাম, ব্লগিং মানেই কম্যুনিটি ব্লগিং না, নিজের ব্লগ আলাদা লেখা যায়, এবং সবচেয়ে বড় সুবিধা, এটা আমার এলাকা। আমার যা ইচ্ছে হয় তাই বলবো। আমি কারো না, কেউ আমার না। যার ইচ্ছে হবে, পড়বে, যার ইচ্ছে নেই সে পড়বে না। আমি এতবড় ইডিয়ট কেন যে এতদিন পর ব্যক্তি-ব্লগের কথা জানলাম, জানি না।
তাই লিখতে বসা। এই “যা ভাবছি” পেজে আমি এখন যা ভাবছি, যা নিয়ে আমার মাথায় ট্র্যাফিক জ্যাম লেগে আছে, তা উজাড় করে বলে রাখবো। এটা হবে আমার অনলাইন ডায়েরী, আমার খোলা জানালা। যেখানে আমাকে bragging করতে হবে না আমার জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে, যেখানে আমি কারো দ্বারা প্রভাবিত নই, আমার দ্বারা কেউ নয়।
এ আমার খাতা, আমার নিজের খাতা।