জেনারেল আজিজের বিদায় ও কিছু রয়ে যাওয়া প্রশ্ন

David Bergman
Netra News
Published in
3 min readJun 17, 2021
২০১৮ সালে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন জেনারেল আজিজ আহমেদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (ছবিটি আল জাজিরার “অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টার’স ম্যান” নামক অনুসন্ধানী তথ্যচিত্র থেকে নেয়া)

জেনারেল আজিজ আহমেদ আর সেনাপ্রধান থাকছেন না। এ খবরে আওয়ামী লীগের অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল আজিজের তিন বছরের মেয়াদ এই জুন মাসে শেষ হচ্ছে। গুজব শোনা যাচ্ছিল যে প্রধানমন্ত্রী হয়ত সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল আজিজের মেয়াদ বাড়াতে যাচ্ছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। গত সপ্তাহেই নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে পদ হস্তান্তর ঘটবে ২৪ জুন।

ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আজিজের উত্তরণ বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অত্যন্ত বাজে নিদর্শন। যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়; প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাপ্রধান পদে আজিজকে নিয়োগ দিতে আমলে নিয়েছিলেন ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক আনুগত্য। অবশ্য এ ধরনের নিয়োগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিয়মিতই চর্চা হয়ে থাকে। তারপরও জেনারেল আজিজ আহমেদকে ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটেছে এবং তিনি যেসব কাজে জড়িয়েছেন, সেগুলোর তুলনায় রাজনৈতিক নিয়োগের বিষয়টা যেন অনেকটাই মামুলি হয়ে যায়।

আজিজকে সেনাপ্রধান পদে নিয়োগ দিতে ২০১৮ সালের জুনে হাসিনা (এবং রাষ্ট্রপতি) বিরল এক রাষ্ট্রীয় ক্ষমার ঘোষণা দেন। এর মধ্যদিয়ে আজিজ আহমেদের এক ভাইয়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মওকুফ করা হয়। আজিজ আহমেদের এই আপন ভাই তখন খুনের দায়ে যাবজ্জীবন কারাভোগ করছিলেন। স্পষ্টতই, এমনকি হাসিনারও মনে হয়েছিল যে খুনের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির ভাইকে এভাবে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়াটা চোখে পড়ার মতো বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে! তাই এই রাষ্ট্রীয় ক্ষমা।

এরপর আজিজ যখন সেনাপ্রধান, তখন ২০১৯ এর মার্চে সরকার আরেকবার নজিরবিহীন এক নির্লজ্জ উদ্যোগ নেয়। এবার আরেকটি ফৌজদারি আইন প্রয়োগ করে আজিজের আরও দুই ভাইয়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মৌকুফ করে হাসিনা সরকার। এই দুই ভাই একই খুনের দায়ে দণ্ডিত ছিলেন। নিঃসন্দেহে শাস্তি মওকুফের ঘটনা হাসিনার জ্ঞাতসারেই ঘটেছে; ধারনা করা যায় যে শেখ হাসিনার হুকুমেই এসব হয়েছে।

শাস্তি মওকুফের এ দুটি ঘটনাই আইনের শাসন ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার অবিশ্বাস্য লঙ্ঘন, যার পেছনে ছিল প্রধানমন্ত্রী এবং তার সরকার। নিজেদের স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহারের স্পষ্ট দৃষ্টান্ত এ ঘটনা।

এছাড়াও রয়েছে দুই পলাতক ভাই — হারিস ও আনিসকে সেনাপ্রধান আজিজের বেআইনি সহায়তা। শাস্তি মওকুফের আগে হারিস ও আনিসকে যেসব সহায়তা দেওয়া হয়েছে, তার সবই ফৌজদারি অপরাধ হিসেবেই গণ্য হবে এবং যিনি দিয়েছেন, তিনি ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। আল জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিটের তৈরি অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টারস মেন তথ্যচিত্রে দেখা গিয়েছে, আজিজ তার ভাই হারিসকে মিথ্যা পরিচয়ের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে হারিসকে হাঙ্গেরিতে গিয়ে এবং সেখানে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সহায়তাও করেছেন। আজিজের দ্বারা সংঘটিত এরকম ফৌজদারি অপরাধের সংখ্যা একাধিক এবং এর কিছু বাংলাদেশের সীমানার বাইরেও ঘটেছে।

শেখ হাসিনা এসব জানতেন না ভাবাটা প্রায় অবিশ্বাস্য। কিন্তু যদি ধরেও নেওয়া হয় যে শেখ হাসিনা জানতেন না, সেক্ষেত্রে আজিজের ভাইদের বিষয় ও অন্যান্য দুর্নীতির অভিযোগগুলো যখন আল-জাজিরা প্রকাশ করে দিলো, তখন তিনি কী করেছেন? কিছুই না। পৃথিবীর অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশ হলে জেনারেল আজিজ সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা হারাত। কিন্তু বাংলাদেশে তিনি এরপরও হাসিনা এবং হাসিনা সরকারের পূর্ণ সমর্থন পেয়ে গেছেন এবং এতো মারাত্মক অভিযোগের চাক্ষুষ প্রমাণ জনসমক্ষে প্রকাশের পরও চার মাস নিজের পদে দিব্বি অধিষ্ঠিত থেকেছেন।

এখন কী হবে আজিজের?

বাংলাদেশে অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধানও যথেষ্ট ক্ষমতাবান একজন ব্যক্তি হিসেবেই গণ্য হন। এখন প্রধানমন্ত্রী তার বিশ্বস্ত এই সহচরকে বিশ্বস্ততার জন্য আর কোনো পুরষ্কার দেবেন না, এমন কোনো লক্ষণও দেখা যায়নি। হয়ত এই সেনাপ্রধানকেই পরবর্তীতে শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ কোনো কূটনীতিক পদ উপহার দেবেন! আজিজ প্রথমে বিজিবি প্রধান ও পরে সেনাপ্রধান থাকাকালীন তার পরিবার অনেক ব্যবসায়িক মুনাফা হাতিয়ে নিয়েছে। এখন দেখার বিষয় হবে, আজিজ ও তার ভাইদের বিরুদ্ধে এসব বিষয়ে শেখ হাসিনা কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেন কিনা।

শেষ কথা হচ্ছে, আজিজের মতো মানুষের এত উঁচু পদে উন্নতি এবং তার সত্যিকার চেহারা ফাঁস হওয়ার পরও সেই অবস্থানে টিকে থাকাটা আসলে বাংলাদেশের রাজনীতির কদর্য রূপেরই প্রকাশ। এ ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশ্বস্ত থাকাটাই সব; সততা আর নৈতিকতা অবিবেচ্য।

//ডেভিড বার্গম্যান

--

--