যে কারণে জবাবদিহিতা এড়াতে পারেন না হাসিনা
ইউটিউবে এখন পর্যন্ত ৬০ লক্ষাধিক দর্শকের কাছে পৌঁছানো আল জাজিরার তথ্যচিত্রটির শিরোনাম “অল দা প্রাইম মিনিস্টারস মেন” (ওরা প্রধানমন্ত্রীর লোক)। এই নামকরণের অনুপ্রেরণা এসেছে “অল দা প্রেসিডেন্টস মেন” নামক বিখ্যাত বই থেকে। গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিকতার জন্য বিশ্বখ্যাত এই গ্রন্থের রচয়িতা ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার দুইজন সাংবাদিক। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি তারাই ফাঁস করেছিলেন এবং পরবর্তীতে সে ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন এই বইতে। তাদের অনুসন্ধান প্রকাশের ফলে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন পদত্যাগে বাধ্য হন। আল জাজিরার তথ্যচিত্রে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ঘটবে তেমন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তথ্যচিত্রে যা প্রকাশ হয়েছে তার আলকে তিনি জবাবদিহিতা এড়িয়ে যেতে পারেন না কোন ভাবেই। এখন পর্যন্ত এমন জবাবদিহিতার মুখোমুখি হবার কোন ইচ্ছা তিনি প্রকাশ করেন নি।
তথ্যচিত্রে হাসিনা মূল চরিত্র নন। কিন্তু জেনারেল আজিজ আহমেদকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত হাসিনাই নিয়েছেন। জেনারেল আজিজের তিন ভাই খুনের দায়ে দণ্ডিত এবং দুজন আজ এখনো পলাতক (এছাড়া তার আরেক ভাই সন্ত্রাসী ছিলেন এবং সন্ত্রাসীদের দলীয় কোন্দলে খুন হয়েছেন বলে জানা যায়)। যেকোন স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষেরই এখানে ভাবার কথা যে কেন একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী এমন কাউকে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করবেন যার দুই ভাই পলাতক আসামী, খুনের দায়ে দণ্ডিত। শুধু তাই না, আজিজকে সেনাপ্রধান নিযুক্তের প্রয়োজনে তার তৃতীয় আরেক ভাই — যিনি একই খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেল খাটছিলেন — তার জন্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পাবার ব্যবস্থা করতে হয়েছে হাসিনার। তার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন ওঠে। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে কি এমন ঘটনা কল্পনা করা যায়?
আজিজ এবং তার দুই পলাতক ভাইয়ের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরো বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আছে।
২০১২ তে তিনি আজিজকে বিজিবি প্রধান নিযুক্ত করেন। ২০১৮ তে তাকে সেনাপ্রধান পদ প্রদান করেন। অতএব প্রশ্ন আসে, প্রধানমন্ত্রী এই নিয়োগ দুটির কোন পর্যায়ে জানতে পেরেছেন যে জেনারেল আজিজ তার ভাইদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করছেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, পলাতক ব্যক্তিরা কোথায় আছে তা হাসিনা নিজেও জানতেন কিনা এবং তাদের মধ্যে একজন ভুয়া পাসপোর্ট ব্যাবহার করে দেশে প্রবেশ করছেন তা জানতেন কিনা। জানলে তিনি কখন তা জানতে পেরেছেন?
২০১৮ তে অতি গুরুত্বপূর্ণ সেনাপ্রধান পদে নিয়োগের আগে — যদি তারও আগে না হয়ে থাকে — আজিজের ভেটিং (অতীত ইতিহাস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া) করতে যেয়ে তার ভাইয়ের তথ্য সামনে চলে আসার কথা, অতঃপর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হাসিনারও সে তথ্য জানার কথা। অন্য কিছু বিষয়ও হাসিনার জানবার বিষয়টি সমর্থন করে। হারিসকে যখন গোপনে ভিডিও করা হচ্ছিল তখন তিনি বলেছেন হাসিনা হারিসের ইউরোপে থাকার বিষয়ে জানেন। এছাড়াও, যে হুইসেলব্লোয়ারের দেয়া তথ্যে আল জাজিরা তাদের অনুসন্ধান শুরু করে সেই সামির ভাষ্যমতে, হাঙ্গেরিতে থাকাকালীন হারিস হাসিনার সাথে কথা বলতেন, তাকে “আপা” সম্বোধন করতেন। আল জাজিরার তথ্যচিত্র প্রকাশের পর নেত্র নিউজের সাথে এক সাক্ষাতকারে সামি জানান।
হয়তো বিষয়টা এমন না, হয়তো আজিজ এবং হারিস হাসিনাকে কিছুই জানান নি। কিন্তু যাই ঘটে থাকুক না কেন, এই বিষয়টি পরিষ্কার করার দায়িত্ব হাসিনার। তার পক্ষ থেকে কোন ব্যাখ্যা না আসলে এই অভিযোগ দৃঢ়তর হতে থাকে যে তিনি এসব বিষয় জেনেও চুপ ছিলেন এবং সম্ভবত খুনিদের পালিয়ে যাওয়াতেও সহযোগিতা করেছেন।
হারিসের গোপনে রেকর্ড করা কথা থেকেও অনেক প্রশ্নের উদ্ভব হয় যার উত্তর হাসিনার দেয়া উচিত।
- হারিস বলেছেন যে তার সরকারের ঠিকাদারি কাজ পাবার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী জানতেন এবং তাকে এ বিষয়ে “হেল্প” করবেন বলেছেন। এ কথা কতখানি সত্য?
- হারিসের মতো লোকেরা র্যাবকে নিজেদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী হিসেবে ব্যাবহার করছে তা কি হাসিনা জানেন?
- পুলিশের বিভিন্ন পোস্টে নিয়োগের ব্যবসা হিসেবে একটা ঘুষের সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে উঠেছে এবং তাতে পুলিশের প্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জড়িত আছেন বলে অভিযোগ রয়েছে তা কি হাসিনা জানেন?
আল জাজিরা তাদের তথ্যচিত্রে উত্থাপিত সব অভিযোগের বিষয়েই হাসিনার নিজের বক্তব্য জানাবার আহবান জানিয়েছিল এবং তার সুযোগ ও সময় দিয়েছিল। কিন্তু তা করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয়ে জানার কথা প্রকাশ্যে নাকচ করে দিবেন এটাই স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাশিত। কিন্তু তা তিনি করেন নি। ধরা যাক এসব কিছুই তিনি জানতেন না (যদিও এমন ধারনা করার খুব শক্ত কোন কারণ নেই)। সেক্ষেত্রেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। এসব অভিযোগের বিষয়ে এখন তিনি কি ব্যবস্থা নেবেন? আজিজের বিষয়ে তিনি কি করবেন? বেআইনি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা সত্ত্বেও কি আজিজ সেনাপ্রধান পদে বহাল থাকতে পারবেন?
(এই নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি ইংরেজিতে। তারপর থেকে এখন নিবন্ধের এই বাংলা অনুবাদটি প্রকাশের মধ্যকার সময়ে প্রথম আলো একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে যে সরকার ২০১৯ এর মার্চ মাসে হারিসের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড গোপনে মওকুফ করে দিয়েছিল। ফলে, সাজা লাঘবের নির্দেশ সংক্রান্ত যেসব প্রশ্নের জবাব হাসিনার দেয়া উচিৎ তা এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।)