সংবাদমাধ্যমে সামরিক নিয়ন্ত্রন

Netra News
Netra News
Published in
3 min readJul 24, 2020

(২১ জুলাই ইংরেজিতে প্রথম প্রকাশিত।)

১৬ আগস্ট ২০১৫ তে ডেইলি ষ্টার এবং প্রথম আলো একটি খবর প্রকাশ করে যে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর হাতে ৫ জন নিহত হয়েছে। ডেইলি ষ্টার এর শিরোনাম ছিল: “গানফাইট ইন হিলস: ফাইভ কিল্ড বাই আর্মি” (পাহাড়ে বন্দুকযুদ্ধ: আর্মির হাতে নিহত পাঁচ)। প্রতিবেদনে বলা হয়: “গতকাল সকালের দিকে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি এলাকায় পাঁচজন আদিবাসী তরুণ সেনাবাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে।”

এতে সেনাবাহিনী ক্রুদ্ধ হয়। তবে সেনাবাহিনীর হাতে পাঁচজন নিহত হয়েছে সে খবর প্রকাশে নয়, বরং প্রতিবেদনে “আদিবাসী” শব্দটি ব্যবহারের কারনে, এবং নিহত তরুনদের পরিচয় “সন্ত্রাসী” হিসেবে না দেবার কারনে। সেনাবাহিনীর মিডিয়া বিভাগ আইএসপিআর পত্রিকা দুটির সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে সম্পাদদ্বয় কথা দেন পরের দিন প্রতিবেদনে প্রয়োজনীয় সংশোধন সহ প্রকাশ করা হবে।

ডেইলি স্টারের পরের প্রতিবেদনে ‘আদিবাসী’ শব্দ বাদ দেয়া হয় এবং মৃত তরুনদের ‘ফাইভ আর্মড ক্রিমিনাল’ (পাঁচজন সশস্ত্র অপরাধী) হিসেবে অভিহিত করা হয়। প্রথম আলো আরো এক ধাপ এগিয়ে একটি “ব্যাখ্যা” প্রকাশ ক’রে বলে, “শিরোনামে এবং প্রতিবেদনের শুরুতে ‘আদিবাসী’ লেখার অর্থ এই নয় যে, তারা নিরীহ যুবক।” সঙ্গে পত্রিকাটি একথাও লেখে যে নিহতরা প্রকৃতপক্ষে “সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য।”

এই একটি ঘটনাতেই প্রকাশ পায় সেনাবাহিনী দেশের সংবাদমাধ্যম কতখানি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু বিষয়টি এখানেই শেষ হয়নি।

সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) বাংলাদেশের প্রধান পাঁচ বিজ্ঞাপনদাতাদের হুকুম দেয় এই দুই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে। এই পাঁচ কোম্পানি হলো চার বিদেশী মোবাইল কোম্পানি গ্রামীণ, রবি আজিয়াটা, বাংলালিংক এবং এয়ারটেল, এবং বহুজাতিক ভোগপণ্য বিক্রেতা ইউনিলিভার। এরা প্রত্যেকেই অনতিবিলম্বে নির্দেশ মান্য করে এবং বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়। সাথে সাথে দুই পত্রিকার আয় এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পায়, পত্রিকার দুটির ভবিষ্যত হয়ে ওঠে অনিশ্চিত। ডিজিএফআইয়ের এ সিদ্ধান্ত কি শুধুমাত্র তাদের পক্ষ থেকেই এসেছে নাকি সরকার থেকে, কিংবা দুই তরফ থেকে একত্রে তা অজানা। তবে সরকার এই দুই স্বাধীন ও প্রভাবশালী পত্রিকাকে শাস্তি দেবার একটা সুযোগ খুঁজছিলো।

গত ১৪ জুলাই লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) সারওয়ার্দীর সাক্ষাৎকার বিষয়ে দেশের একটি মেইনস্ট্রিম সংবাদমাধ্যমও কোন খবর কেন প্রকাশ করেনি তা বোঝবার জন্য পাঁচ বছর আগের এ ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ। সাক্ষাৎকারে সারওয়ার্দী সরকারের সমালোচনা থেকে শুরু করে সেনাপ্রধানের নিন্দা সহ, বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব বিস্তার বিষয়ক প্রশ্ন তুলেছেন। ফলস্রুতিতে তিনি চাকরিচ্যুত হয়েছেন এবং বর্তমানে লুকিয়ে আছেন আইনরক্ষা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে যাবার ভয়ে। এতসব ঘটনার কোনো কিছুই দেশের কোনো সংবাদমাধ্য প্রকাশ করেনি।

এত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার পর সকল সংবাদমাধ্যম একত্রে নিশ্চুপ থাকাটা নিঃসন্দেহে হতবাক হবার মতো। দেশের সংবাদমাধ্যম জগতে বর্তমানে সর্বাধিক আলোচিত এ ঘটনা। তারপরও কেন এ নিয়ে কোন প্রতিবেদন প্রকাশ হলোনা তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় পাঁচ বছর আগে প্রথম আলো ও ডেইলি ষ্টার এর অভিজ্ঞতা আমলে নিলেই। সবাই জানে সেনাবাহিনী অসন্তষ্ট হয় এমন কিছু দেখানো বা লেখা মানে সীমা লঙ্ঘন। এর ফল হতে পারে তাদের অস্তিত্বের উপর হুমকি।

এ ঘটনাচক্রের শুধু একটি বিষয় দেশের সংবাদমাধ্যম প্রকাশে সক্ষম হয়েছে। তা হলো স্বয়ং সেনাবাহিনী থেকে প্রকাশিত একটি সংবাদ বিবৃতি, যাতে সারওয়ার্দীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তারা প্রকাশ করেছে। সেখানে রয়েছে সারওয়ার্দীর “অনৈতিক” সম্পর্কের বৃত্তান্ত এবং তার স্ত্রীকে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য।সংবাদমাধ্যমগুলো তার স্ত্রীর দেয়া বিবৃতিও প্রকাশে বিরত থেকেছে। সারওয়ার্দীর স্ত্রী, প্রখ্যাত উপস্থাপিকা ফারজানা ব্রাউনিয়া আইএসপিআর এর প্রকাশিত বিবৃতিকে “নারীর প্রতি অবমাননাকর” ও “সহিংস” অভিহিত করে বিবৃতি দিয়েছেন।

সেনাবাহিনী কি অসীম কর্তৃত্ত্বের অধিকারী তা সুস্পষ্ট। সারওয়ার্দীর দেয়া সাক্ষাৎকার নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কোনো আলোচনা হোক তা সেনাবাহিনী এবং জেনারেল আজিজ কোনক্রমেই চাইবে না। বিশেষ করে আজিজ এর ভাই জোসেফ বিষয়ক কোন কথা। এটা বুঝতে কষ্ট-কল্পনার প্রয়োজন নেই।

আজিজ যেদিন সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন, সেদিন জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল bdnews24.com একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি প্রথম যেভাবে প্রকাশিত হয় তাতে লেখা হয়েছিল “[আজিজের] নাম সম্প্রতি মিডিয়ায় এসেছে তার ছোট ভাই তোফায়েল আহমেদ জোসেফ এর জেরে, যিনি ৯০ এর দশকে সন্ত্রাসী হিসেবে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন এবং যার মৃত্যুদন্ড লাঘব করা হয় ও শেষপর্যন্ত রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়ে তিনি কারাবাস থেকে মুক্তি লাভ করেন।”

ডিজিএফআইয়ের নির্দেশে, বিটিআরসি বিডিনিউজের ওয়েবসাইটটি তৎক্ষণাৎ বন্ধের আদেশ দেয়। প্রতিবেদনের এই লেখাগুলো মুছে দিলে কয়েক ঘন্টা পর আবার সাইট খুলে দেয়া হয়।

এটা সহজেই অনুমেয় যে বাংলাদেশে কোন সম্পাদক সেনাবাহিনীকে রাগিয়ে তুলতে পারে এমন কিছু প্রকাশে কতখানি অপারগ। কিন্তু, এই ভীতি কাটিয়ে ওঠার একটি উপায় রয়েছে। তা হলে সামষ্টিক উদ্যোগ। যদি সবাই যুগ্মভাবে এসব খবর প্রকাশ করে তাহলে এ ভীতি অতিক্রম করা সম্ভব। সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্ন একটি সংবাদমাধ্যকে বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু সবাইকে একসাথে বন্ধ করে দেয়া সম্ভব হবে না।

///ডেভিড বার্গম্যান

--

--

Netra News
Netra News

Netra News - a new independent and impartial online media platform publishing investigations, analysis, and opinion on Bangladesh politics and society