সেন্সরশিপের টেস্ট কেস: উচ্চ আদালত থেকে কনক সরওয়ারের চ্যানেল বন্ধের সিদ্ধান্ত

Netra News
Netra News
Published in
4 min readDec 24, 2020
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ এডিটরস কাউন্সিলের মানববন্ধন। ‘স্বাধীনতা বিরোধী ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট’ বাতিলের দাবিতে এই মানববন্ধন করে এডিটরস কাউন্সিল। ছবিটি ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর তোলা। আলোকচিত্রী: মামুনুর রশিদ/এ্যাল্যামি লাইভ নিউজ

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি সাংবাদিক কনক সরওয়ারের ফেইসবুক এবং ইউটিউব চ্যানেল ব্লক করতে বাংলাদেশ সরকারকে পদক্ষেপ নিতে বলেছেন হাইকোর্ট। গত ৮ ডিসেম্বর হাইকোর্টের একটি সিদ্ধান্তে (রুলিং) এ নির্দেশ দেয়া হয়। কনক সরওয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি চ্যানেলগুলো থেকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী, বিকৃত কনটেন্ট’ প্রকাশ করছেন। হাইকোর্টের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশিদের বাকস্বাধীনতার উপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে সিদ্ধান্তটির প্রভাব ঠিক কতখানি গুরুতর হতে পারে, এ বিষয়ে সঠিক ধারনা পেতে প্রথমেই দৃষ্টিপাত করতে হবে বাংলাদেশে সরকারের সমালোচনা করার পরিবেশ কেমন, সে বিষয়টির উপর।

দেশে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্যদিয়ে সরকার অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে তাকে সমালোচনার পথ বন্ধ করে চলেছে। সমালোচনা থামিয়ে দিতে সবচে কার্যকরভাবে সরকার যে উপায়গুলো ব্যবহার করছে সেগুলো হলো, ওয়েবসাইট ব্লক এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট (ডিএসএ) ব্যবহার করে অনলাইনে প্রকাশিত লেখার জন্য যে কাউকে গ্রেপ্তার করা। এমনও দেখা গেছে যে এসব হয়ত কোনো প্রকাশিত খবর বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত কোনো পোস্ট। এগুলো যদি সরকার বা সরকার সমর্থক কারও অপছন্দ হয়, তাহলে তাদের এই অপছন্দই ডিএসএ-র অধীনে কেউ গ্রেপ্তার হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

দেশে সমালোচনার ক্ষেত্র অতিমাত্রায় সংকুচিত হওয়ায় অনেক বাংলাদেশি নাগরিকই এখন দেশের বাইরে থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি সংবাদ মাধ্যমগুলো ফলো করছেন বা পড়ছেন/দেখছেন/শুনছেন। ফলে এখন বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতার নতুন লড়াইটা হচ্ছে বিদেশ-ভিত্তিক বাংলাদেশি সাংবাদিকতাকে ঘিরেই। দেশে সরকার যেভাবে গায়ের জোরে সব বন্ধ করে দেয়, বিদেশে অবস্থানরতদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ক্ষমতাই প্রয়োগ করতে চায় সরকার। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই এসব পদ্ধতি দেশে যতখানি কার্যকর, বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ততখানি নয়।

নেত্র নিউজের কথাই ধরা যাক। পুলিশ নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিলের বিরুদ্ধে ডিএসএর অধীনে মামলা দায়েরসহ নেত্র নিউজের ওয়েবসাইটটি দেশে ব্লক করে দিয়েছে। তবে তাসনিম খলিলকে এখনো পুলিশ গ্রেপ্তার করতে না পারার একমাত্র কারণ, তিনি সুইডেনে থাকেন। বাংলাদেশ থেকে শুধুমাত্র মিরর সাইটের মাধ্যমে নেত্র নিউজ দেখা যায়।

এ অবস্থায় চূড়ান্ত হেনস্তা এড়াতে এবং পাঠকের কাছে পৌঁছার বিকল্প পথ খুঁজে নিতে পারলেও নেত্র নিউজকে যথেষ্ট ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। মূল সাইট ব্লক থাকায় নেত্র নিউজের পাঠক সংখ্যাও স্বাভাবিক গতিতে বাড়তে পারছে না। সম্পাদক তাসনিম খলিলেরও দেশে ফিরলেই গ্রেপ্তার হওয়ার ঝুঁকি রয়ে গিয়েছে।

এদিকে যে বিকল্প মিরর সাইট দিয়ে নেত্র নিউজ পড়া যেত, সেটিও সরকারের পক্ষে ব্লক করা সম্ভব। এক পর্যায়ে তা করেছিলও সরকার। কিন্তু মিরর সাইট ব্লক করার কিছু অসুবিধা থাকায় সরকার পক্ষে তা আর বাস্তবসম্মত হয়নি। মিরর সাইটটি গুগলের একটি ক্লাউড প্লাটফর্মে অবস্থিত। ফলে সাইটটি বন্ধ করতে চাইলে গুগলের আরও অনেকগুলো প্রয়োজনীয় সাইট বন্ধ করে দিতে হবে। শুধুমাত্র মিরর সাইট ব্লক করার কোনো উপায় নেই। তাই এই মুহূর্তে সরকার মিরর সাইটটি ব্লক না করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এখন আলোচ্য বিষয় হলো, কনক সরওয়ারের ক্ষেত্রেও কী এ ধরনের সমস্যায় পড়েছে সরকার।

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক কনক সরওয়ার ফেইসবুক ও ইউটিউবে ভিডিও প্রকাশ করেন। এরইমধ্যে ভিডিওগুলো যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কনক সরওয়ারের ভিডিওগুলো সাধারণত সরকার সমালোচক বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার ভিত্তিক ভিডিও। ভিডিওগুলোতে প্রকাশিত অনেকগুলো সাক্ষাৎকারই সরকারের জন্য অত্যন্ত অস্বস্তিকর। কনক সরওয়ার দেশে থাকলে এসব সাক্ষাৎকার প্রকাশের জন্য এতক্ষণে অবশ্যই গ্রেপ্তার হয়ে যেতেন বা তাঁর এসব ভিডিও প্রকাশ বন্ধ করতে বাধ্য হতেন।

তো এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার তাহলে কেন এখনো তাঁর এসব ভিডিওগুলো ব্লক করছে না? উত্তর, এর কারণটাও নেত্র নিউজের সাইট ব্লক করতে না পারার মতোই। সরওয়ারের ভিডিও বন্ধ করার একমাত্র উপায় হলো, ইউটিউব ও ফেইসবুক পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া। বাংলাদেশে এ ধরনের পদক্ষেপ অসম্ভব। কেননা দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ ফেসবুক ও ইউটিউব প্লাটফর্ম দুটি ব্যবহার করে এবং এই দুটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ব্যবসা।

এ অবস্থায় এসব ভিডিও বন্ধ করতে ভিন্ন কৌশল নিয়েছে সরকার। ফেইসবুক এবং ইউটিউবকে দিয়েই কনক সরওয়ারের পেজ বা চ্যানেল বন্ধ করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। মিথ্যা কপিরাইট অভিযোগ দিয়ে বা সে সব প্লাটফর্মের নিজস্ব কোনো নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগ তুলে সরওয়ারের মতো সমালোচকদের এ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে প্রচুর সময় ব্যয় করছে বাংলাদেশ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

এতে তারা আংশিক সফলও হচ্ছে। পুরো বন্ধ করতে না পারলেও তারা অন্তত ভালো রকম অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারছে। যেমন, এ বছরের শুরুর দিকে মিথ্যা কপিরাইট অভিযোগে কনক সরওয়ারের এ্যাকাউন্ট বন্ধ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে তাঁকে আরেকটি নতুন এ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। এতে সময় নষ্ট হওয়াসহ আরও কিছু সমস্যা পোহাতে হয় কনক সরওয়ারকে। তবে সরকার শেষ পর্যন্ত তাঁর ভিডিও প্রকাশনা বন্ধ করতে সমর্থ হয়নি।

এজন্যই হাই কোর্টের সিদ্ধান্তটি তাৎপর্যপূর্ণ। সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে আদালতের এই সিদ্ধান্ত সরকার পুরোপুরি কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে এবং এর মাধ্যমে ফেইসবুক ও ইউটিউবকে দিয়ে সরওয়ারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়াতে চাইবে।

যদি তাতে সফল হয়, তবে সরকার আদালতকে ব্যবহার করে এমন আরও অনেক ইউটিউব ও ফেইসবুক এ্যাকাউন্ট ব্লক করে দিবে। যেহেতু বাংলাদেশে আদালতের উপর সরকারের শক্ত নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তাই এর মাধ্যমে ভিন্নমত ও পথের প্রবাসী সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দেয়াটা সরকারের জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।

কনক সরওয়ার যেমন বলেছেন, ‘যদি সরকার আমার চ্যানেল ব্লক করে দিতে পারে, তাহলে সরকার সমালোচক প্রতিটা ইউটিউব চ্যানেল ব্লক করে ছাড়বে। আমার কেসটা একটা টেস্ট কেস।’

এ অবস্থায় আশা শুধু এটুকুই, হয়ত ফেইসবুক ও ইউটিউব পরিস্থিতির প্রকৃত গুরুত্ব বিবেচনা করে তাদের সিদ্ধান্ত নিবে এবং ভিডিও ব্লক করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের আবেদনে সাড়া দেবে না। তাদের এটা পরিষ্কারভাবে বোঝা জরুরী, কোন ভিডিও তাদের প্লাটফর্মের নিয়ম ভঙ্গ করছে আর কোনটা বাংলাদেশ সরকারের সহিষ্ণুতার সীমা লঙ্ঘন করছে। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে তারা সরকারের দাবি মেনে নিয়ে ভিডিও ব্লক করলে তার মারাত্মক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতার উপর।

/ডেভিড বার্গম্যান

[১০ ডিসেম্বর ইংরেজি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত।]

নেত্র নিউজের মূল ওয়েবসাইট দেখুন
বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য
বাংলাদেশের বাইরের পাঠকদের জন্য
ইউটিউব চ্যানেল

--

--

Netra News
Netra News

Netra News - a new independent and impartial online media platform publishing investigations, analysis, and opinion on Bangladesh politics and society