দেশের শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার সাথে এক দণ্ডপ্রাপ্ত খুনির সাক্ষাৎ
তিনি একজন দণ্ডিত খুনি। অতীতে অপরাধ চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তার নাম বহুলপরিচিত। মিডিয়ায় তাকে “নব্বইয়ের দশকের শীর্ষ তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের” একজন হিসেবে আখ্যা দেওয়া হতো। এই ধরণের একজন ব্যক্তি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ঘরোয়া কোন সামাজিক আড্ডায় তার সঙ্গী হিসেবে আপনি কার কথা সবার পরে ভাববেন?
যার কথা বলা হচ্ছে তিনি তোফায়েল আহমেদ জোসেফ। নব্বইয়ের দশকে দেশের রাজধানীতে একটি কুখ্যাত অপরাধ চক্রের সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালে মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার দায়ে তিনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। ২০১৫ সালে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়। আর ২০১৮ সালের মে মাসে তিনি রাষ্ট্রপতির বিরল ক্ষমা পান। এরপরই তিনি কারাগার থেকে মুক্ত হন।
পাঠকরা জেনে থাকবেন যে, নেত্র নিউজ সম্প্রতি জোসেফকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে যে, কারাগার থেকে মুক্তির পর তিনি জাল জন্মসনদ ও অন্যান্য ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে ভিন্ন নামে ভুয়া জাতীয় পরিচয় পত্র ও পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছেন। এই বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হতে পুলিশের কোন সময়ই লাগার কথা নয়। কিন্তু আমাদের জানা মতে, তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন তদন্ত শুরু হয়নি।
জোসেফ হলেন সেনাকর্মকর্তা আজিজ আহমেদের ভাই। এটা বোঝা কঠিন কিছু নয় যে, জোসেফের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ ও তার বিরুদ্ধে তদন্ত না হওয়ার পেছনে তার ভাইয়ের সেনাপ্রধান হিসেবে নিযুক্তিই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। উল্লেখ্য, জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পাওয়ার এক মাস পরই আজিজ আহমেদ সেনাপ্রধান হন।
তবে ইদানীং জোসেফ অন্যান্য জ্যেষ্ঠ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদেরও সান্নিধ্য ভোগ করছেন। এই কর্মকর্তাদের অবস্থানই এমন যে তারা জোসেফকে তদন্ত বা অনুসন্ধানের আওতার বাইরে রাখতে সক্ষম।
এ ধরণেরই একজন কর্মকর্তা হলেন বেনজির আহমেদ, যিনি ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে আইজিপি (ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ) পদমর্যাদায় দেশের পুলিশ বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগের ৪ বছর তিনি দেশের এলিট ও ভীতিজাগানিয়া বাহিনী র্যাবের (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। র্যাবের হাতে এখন পর্যন্ত যতগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সেগুলোর এক-তৃতীয়াংশই হয়েছে বেনজির আহমেদ দায়িত্বে থাকাকালে। আর এজন্য তাকে কখনওই জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি। বরং, তাকে পদন্নোতি দিয়ে দেশের পুলিশ বাহিনীর প্রধান করা হয়েছে।
আমাদের হাতে এমন একটি ছবি এসেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে এই দুই ব্যক্তি — অর্থাৎ, বেনজির ও জোসেফ — এক ঘরোয়া আড্ডায় মিলিত হয়েছেন। বেনজিরের পরনে বাসায় পরার পোশাক। দৃশ্যত, ছবিটি তার নিজের বাসায়ই তোলা।
একই সামাজিক অনুষ্ঠানের আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে জোসেফ ও বেনজিরের পাশে আরও দুইজন ব্যাক্তি বসে আছেন। এই দুই ব্যাক্তি জোসেফের বাল্যবন্ধু বলে সনাক্ত করেছি আমরা। তবে তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় তাদের চেহারা আমরা ঢেকে দিয়েছি।
এই ছবিগুলো তোলা হয় জোসেফ কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর। তবে আমরা নিশ্চিত নই, ওই সময় বেনজির কি পুলিশ প্রধান হয়ে গেছেন, নাকি তখনও র্যাব প্রধানই ছিলেন। তবে বেনজির তখন যেই পদেই থাকুন না কেন, তার সঙ্গে জোসেফের ওই বৈঠক গুরুতর কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়।
একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা, যার দায়িত্ব হল আইন-শৃঙ্খলা সমুন্নত রাখা, তিনি কেন খুনের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত একজন ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন (যদিও তাকে পরবর্তীতে ক্ষমা করা হয়েছিল), যিনি ওই খুন করার আগেও ঢাকার অপরাধ চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে দুর্নাম রয়েছে?
বাংলাদেশে অপরাধী ও পুলিশ অনেকক্ষেত্রেই আঁতাতে লিপ্ত হয় বলে যে ব্যাপক একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে, এসব কি তাহলে সেই ধারণারই যথার্থতা প্রমাণ করে? বেনজির আহমেদের সাথে জোসেফের এই ব্যক্তিগত খাতিরের কারণেই কি জাল ও ভুয়া সরকারি নথি প্রস্তুতের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে কোন তদন্ত হচ্ছে না?
এই প্রশ্নগুলোর জবাব জানতেই নেত্র নিউজের পক্ষ থেকে বেনজির আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হয়, তবে তিনি কোনো জবাব দেননি।
//ডেভিড বার্গম্যান
আপডেট: এই পোস্টটি ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ নতুন সম্পাদনাসহ আপডেট করা হয়েছে।
নেত্র নিউজের মূল ওয়েবসাইট দেখুন
বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য
বাংলাদেশের বাইরের পাঠকদের জন্য
ইউটিউব চ্যানেল