বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের পারিবারিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক

Netra News
Netra News
Published in
4 min readOct 14, 2020
হোয়াইটবোর্ড ওয়েবসাইটের স্ক্রিনশট। সাথে ম্যাগাজিনের সম্পাদক রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির ছবি।

সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাগ্নে। নিজেদের নিরপেক্ষ ও স্বাধীন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচয় দিলেও প্রকৃতপক্ষে এর কাজ আওয়ামী লীগের পক্ষে সফট প্রোপাগান্ডা চালানো। এছাড়াও, গোঁড়া আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মাঝে আধুনিক বা স্মার্ট যেসব লোকজন রয়েছে, তাদের বিভিন্ন পদ হাতিয়ে নেওয়ার ও সরকারি ক্ষমতার কেন্দ্রে যাবার একটি মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান। শাহ আলী ফরহাদের কথাই ধরা যাক। সিআরআইয়ে সিনিয়র এনালিস্ট হিসেবে ঢুকেছিলেন তিনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরপরই প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী পদে নিয়োগ পেয়ে যান ফরহাদ।

গত কয়েক মাসে সিআরআইয়ে বেশ কিছু লক্ষণীয় ঘটনা ঘটেছে।

ক্ষমতাসীনদের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক থেকে ক্ষমতাসীন দলের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে সিআরআই। ববি এখানে একজন ট্রাস্টি — এবং খুব সম্ভবত চেয়ার ছিলেন দীর্ঘদিন। এ বছর ববির খালাতো বোন ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল সিআরআইয়ের ভাইস-চেয়ার হয়েছেন। গত মাসে ববির আপন বোন আজমিনা সিদ্দিক সিআরআইয়ের একটি নতুন ম্যাগাজিন হোয়াইটবোর্ডের সম্পাদকীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হয়েছেন। এতে করে ক্ষমতাসীন পরিবারের তিনজন সদস্য সিআরআইয়ের সাথে যুক্ত হলেন।

আজমিনা এই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে পা দিলেন। এর আগে তিনি টনি ব্লেয়ারের ইন্সটিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জ এ কাজ করেছেন এবং বর্তমানে চিলড্রেনস্ সোসাইটিতে কাজ করেন। আজমিনার বোন ব্রিটিশ সাংসদ টিউলিপ সিদ্দিক ২০১১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন, এবং দলের মুখপাত্রের ভূমিকায় কাজ করেছেন (যদিও তিনি এ সংক্রান্ত সব তথ্য তার ওয়েবসাইট থেকে এখন সরিয়ে ফেলেছেন)। আওয়ামী লীগের সাথে তার কোন সম্পর্ক বর্তমানে বজায় আছে বলে অস্বীকার করলেও ব্রিটেনে গত নির্বাচন পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগ যুক্তরাজ্য শাখার সাথে যুক্ত ছিলেন বলেই সুবিদিত এবং ডিসেম্বর মাসে নির্বাচনে তার পুনরায় বিজয়ে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। তাই সিআরআইতে আজমিনার প্রবেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রবেশের প্রাথমিক পদক্ষেপ কিনা তা দেখার বিষয়।

অরাজনৈতিক কিন্তু আওয়ামী-ঘেঁষা এমন সামাজিক ব্যক্তিত্বদের নিজেদের বলয়ের মাঝে নিয়ে আসতে আওয়ামী লীগ সবসময়ই আগ্রহী। গত মাসে এর হোয়াইটবোর্ড ম্যাগাজিনের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় যে লক্ষণীয় ঘটনাটি সিআরআইতে ঘটেছে তা ঠিক এই কাজটি করার একটি কৌশলী পদক্ষেপ বলেই মনে হচ্ছে। আজমিনাকে বাদ দিলে হোয়াইটবোর্ড ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় উপদেষ্টা পরিষদে বেশ কয়েকজন অপ্রত্যাশিত ব্যক্তি সংযুক্ত হয়েছেন, যার মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সম্ভবত ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদের জামাতা এবং এনজিওটির নতুন নির্বাহী পরিচালক (এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর) আসিফ সালেহ।

ব্র্যাক শুধু বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের মাঝে শীর্ষস্থানীয় এনজিও। বাংলাদেশে রাজনীতিকরণের সর্ববিস্তৃত পরিবেশে এ অর্জন অসামান্য। এমন পরিবেশে ব্র্যাক টিকে থেকেছে কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করে: সরকারের সাথে কখনো কোনো দ্বন্দ্বে না জড়িয়ে; বিতর্কিত কোন মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে কখনো কথা না বলে; এবং, যখন যে দল বা গোষ্ঠী ক্ষমতায় থেকেছে তাদের এজেন্ডার সীমায় থেকে কাজ করার মাধ্যমে। এর ফলে মানবাধিকার কর্মীরা অনেক সময় রুষ্ট হয়েছেন, ব্র্যাকের উল্লেখযোগ্য প্রভাব তাদের পক্ষে দাঁড়াবে এমন আশা করে নিরাশও হয়েছেন। ব্র্যাক জানে তার টিকে থাকা ও বড় হওয়া নিশ্চিত করতে অন্যতম প্রধান কৌশল হিসেবে কাজ করেছে বিতর্কিত বিষয়ে কখনো জড়িত না হওয়া।

অপরদিকে আবার, ব্র্যাক কোনো সরকারের সাথেই বেশি ঘনিষ্ঠ হয়নি। সরকারের সাথে সবসময়ই গঠনমূলকভাবে কাজ করে গিয়েছে, কিন্তু বিরোধী দল বা অন্য কেউ যেন তাদেরকে বিরুদ্ধপক্ষ না ভাবে সেদিকে খেয়াল রেখেছে, যেন সরকার পরিবর্তন হলেও ব্র্যাক বিঘ্ন ছাড়াই কাজ চালিয়ে যেতে পারে।

ফলে আসিফ সালেহের মতো একজন চৌকস ব্যক্তির দলীয় ও সরকার পক্ষীয় একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় উপদেষ্টা পরিষদে যোগ দেওয়াটা অবাক হবার মতো বিষয়। নেত্র নিউজ এই বিষয়ে মন্তব্য চাইলে আসিফ তাতে সাড়া দেন নি। তবে হোয়াইটবোর্ড ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় উপদেষ্টা পরিষদের অন্য একজন উপদেষ্টা সিআরআইয়ে আসিফের সংশ্লিষ্ট হবার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন:

“হোয়াইটবোর্ড তরুণদের উদ্দেশ্যে গঠিত একটি নীতি-নির্ধারণী বিষয়ক ম্যাগাজিন এবং দলীয় প্রোপাগান্ডা, প্রচার এই ম্যাগাজিনের উদ্দেশ্য নয়। পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ভালো পলিসি তৈরিতে ভূমিকা রাখা। নাগরিক সমাজ থেকে এই কাজটি করা হয়ে থাকে এ্যাডভোকেসি, এ্যাক্টিভিজম এবং নীতিনির্ধারকদের সাথে কাজ করার মাধ্যমে, তারা যে দলেরই হোক না কেন — এই কাজ নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিয়ে করা হয় না। তরুণদের এই পরিবর্তনের অংশ হওয়া প্রয়োজন যেন তারা এসকল আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করে তাদের ভবিষ্যতের উপর পলিসির কি প্রভাব তা বুঝতে পারে। বর্তমানে এ উদ্দেশ্যে চালিত প্লাটফর্ম খুব বেশি তিনি (আসিফ) দেখছেন না। হোয়াইটবোর্ডে অবৈতনিক উপদেষ্টার ভূমিকা যেটা হবে তা হলো প্রয়োজনীয় পলিসি ইস্যু গুলো নিয়ে যেন আলোচনা হয় তাতে সহায়তা করা, যেসব আলোচনায় তরুণরা অংশগ্রহণ ও চ্যালেঞ্জ করতে পারবে এবং পলিসি সংক্রান্ত বিষয়গুলো বুঝতে পারবে। তার প্রত্যাশার প্রতিফলন যদি তিনি দেখতে না পান, কিংবা তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে তিনি এ পদ থেকে সরে যেতে কোনো দ্বিধা করবেন না।”

সন্দেহ নেই, আসিফ হোয়াইটবোর্ডে এ সংযুক্ত হয়েছেন মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই। কিন্তু “দলীয় প্রোপাগান্ডা প্রচার এই ম্যাগাজিনের উদ্দেশ্য নয়” বলা হলেও এতে কোন ভুল নেই যে ম্যাগাজিনটি প্রকাশ করছে দলীয় প্রোপাগান্ডা প্রচারের উদ্দেশ্যে গঠিত একটি প্রতিষ্ঠান, যাতে ক্ষমতাসীন পরিবারের তিন সদস্য যুক্ত। ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যার বিষয়বস্তু — শেখ মুজিব — দেখেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা।

হয়তো ব্র্যাক প্রধান ভাবছেন দৃশ্যমান ভবিষ্যতে যেহেতু সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার এবং অতঃপর সরকার পরিবর্তন হওয়ার কোন আশংকা নেই, তাই সব হিসাব-নিকাশ করলে, ক্ষমতাসীন পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়াতে বোধ হয় তার প্রতিষ্ঠানের উপকার বৈ অপকার হবেনা। তার উপর, হোয়াইটবোর্ড এর মতো অবান্তর একটা ম্যাগাজিন, যা কিনা আবার ইংরেজিতে প্রকাশিত হবে, তার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা পরিষদে কে থাকলো বা না থাকলো তা নিয়ে কে বা মাথা ঘামাতে যাবে? হয়তো আসিফ এর চিন্তা সঠিক। কিন্তু ক্রমবর্ধমান স্বৈরশাসনের আলোকে, ব্র্যাক এর রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা এখন দুর্বলীকরন নয়, জোরদার করা প্রয়োজন।

আপাততঃ বিশ্বের বৃহত্তম এনজিওর চেহারা খুব একটা আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে না।

//ডেভিড বার্গম্যান

নেত্র নিউজের মূল ওয়েবসাইট দেখুন
বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য
বাংলাদেশের বাইরের পাঠকদের জন্য
ইউটিউব চ্যানেল

--

--

Netra News
Netra News

Netra News - a new independent and impartial online media platform publishing investigations, analysis, and opinion on Bangladesh politics and society