এক অসফল পরিচালকের আত্মকথা ~ রাবীন্দ্রিক রকবাজ

Scio
পুনশ্চ ফুটোস্কোপ
8 min readOct 12, 2010

[মুখবন্ধঃ একটি রাগের মাথায় লেখা ছোটগল্প]

সত্যি বলতে কি, মাঝেমধ্যে প্রচন্ড রাগ হয়। মনে হয় সব শালা ফালতু; তা সে আমার ঘরের দেওয়ালে টানানো মহান পরিচালক হোক, বা কিছুক্ষণ আগে যার সাথে হেসে হেসে আড্ডা মেরে আসলাম, সেই লোকটা।

লোকটা ফ্রি-তে মাল খাওয়াতে চাইল, আর আমিও চুপচাপ বসে গেলাম। গ্যাঁজাল শালা দেড় ঘন্টা ধরে। মাল-টা সিনেমা করবে, ‘অগ্নিপ্রেম’। কোন শালা একটা না-খেতে পাওয়া বা বেশি-খেতে চাওয়া ডিরেক্টর-কে নাকি যোগাড় করেছেঃ সে বানাবে বই, অথচ বই-এর প্রথমে ড্যাব-ড্যাবে লাল গ্রাফিক্সে নাম যাবে নাকি এই শালার। ভাল কথা, আমার কি? নিজের পয়সা নিজে ওড়াচ্ছে, নিজের নাম পর্দায় দেখার জন্যে আর্ট আর এথিক্সের ১০৮ দিয়ে একা একা হলে বসে সিনেমা দেখবে। আর ওই সিনেমা যদি হিট করে যায়, তাহলে তো কথাই নেই- পেট ফুলে আরো বড়লোক হয়ে চারটে মেয়ে নিয়ে বকখালি যাবে ‘লোকেশন দেখতে’। লোকেশন দেখবে না অন্য কিছু, তা ভালরকম জানা আছে!

ওদিকে আমায় দেখঃ আমি শালা ফুল ওরিজিন্যাল তিনখানা স্ক্রিপ্ট নিয়ে ফ্যা-ফ্যা করে তিন বচ্ছর ধরে সবার কাছে ঘুরে মরছি। যার কাছেই যাই, জিজ্ঞেস করে কি কাজ করেছি? আররে, তিন-তিনটে ডিরেক্টর-কে আসিস্ট করেছি, তা হতে পারে সে তিনটে সিনেমার নাম এক ওই সিনেমার ডিরেক্টর-দের ছাড়া কারুর মনে নেই; কিন্তু কাজ তো করেছি!

জিজ্ঞেস করে, নিজের কাজ কিছু আছে কিনা। টিভিতে কিছু করেছি কি? দূর শালা, তাও যদি স্টার জলশার কোন মহিলা (বা পুরুষ) এমপ্লয়ি-কে পটাতে পারতাম, তাহলেও অন্তত কটা টেলিফিল্ম নামাতে পারতাম। ফিল্ম স্কুল থেকে যারা পাঁচ বছর আগে পাসআউট করেছিল, তাদের অনেকেই এখন কিছু না কিছু করছে। তাদের হয় কোন বান্ধবীর সৎভাই বা কাকুর অবৈধ প্রেমিকার ‘কানেক্‌শন’ আছে কোন চ্যানেলে। কোন এক রগরগে মেগা চালিয়ে তারা বেশ মেগা-সুখে আছে, হয়ত বা মেগার ‘মেক-আপে মেগা সুন্দরী’ নায়িকা-দের সাথেই। ধুর শালা, আমার কি?

চাইলে কি মেয়ে পটাতে পারতাম না নাকি? চেহারা-টা তো এক্কেবারে মন্দ ছিল না। ছিল না যেটা, সেটা হল পকেটের পয়সা। সদাগরি আপিস-টার চাকরি-টা দিয়ে ওই ছাতার ফিল্ম-স্কুলটায় গাঁদা-গাঁদা টাকা ঢাললাম। শিখলাম যত না, তার থেকে গাঁজা খেলাম অনেক বেশি। এমন ভাব দেখাত, যেন পাস করে বেরলেই শালা বাড়ির সামনে প্রোডিউসার আর নায়িকা-দের লাইন পড়ে যাবে। প্রোডিউসার-রা দান করবে ‘মানি’, শ্যুটিংয়ের শেষে নায়িকা-গুলি দূর করবে শরীরের ‘গ্লানি’।

কয়েকজন এঁচড়ে-পাকা তো কিছু না শিখেই ক্যামেরা-ট্যামেরা ভাড়া করে বাপের পয়সা বা নিজেদের অতিরিক্ত পয়সা খরচ করে প্রফেশনাল ক্যামেরা ভাড়া করে কি সব আঁতেলমার্কা শর্ট-ফিল্ম বানানো শুরু করে দিল। হুজুগে পড়ে ওদের সাথে সাথে ঘুরলাম কিছুদিন। ওঃ সে কি উৎসাহ ওদের। ফিল্ম ফেস্টুতে পাঠাবে, আর ওদের স্থির বিশ্বাস ফেস্টুতে ওদের ছবি এক্কেবারে ফার্স্ট প্রাইজ বাগাবেই। কোন শালা আটকাতে পারবে না! যে ক্যামেরাম্যান-টাকে হায়ার করত ওরা (সে শালা এখন কোন এক ‘সেন’ না ‘ঘোষ’-এর লেজুড় হয়েছে), সেই সুমন সাঁতরা-ও উৎসাহের সাথে বলে যেত, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ দাদা, আপনারা চালিয়ে যান। ওফ্‌ফ্‌ কি শট হচ্ছে এক-একটা। এক্কেবারে “কুর্‌সাওয়া-কুর্‌সাওয়া”’ কুরোসাওয়া কোন ছাড়, ওর থেকে ভাল কোয়ালিটির শট আমরা স্কুল পালিয়ে দেখা প্রদীপের সিনেমায় অবধি দেখেছি। কিন্তু এরা তখন সবাই ‘কুর্‌সাওয়া’ হবার লোভে অন্ধ।

আমাকেও কয়েকটা শর্ট ফিল্ম করতে বলেছিল ওরা। ‘আররে, এটা তো একটা ইনভেস্টমেন্ট’ অমর্ত্য বলেছিল, ‘লং-টার্মে দেখবি ফাটাফাটি রিটার্ন দেবেই’। অমর্ত্য এখন ফিল্ম-এর ভূত মাথা থেকে নামিয়ে ইন্সিওরেন্সের এজেন্ট হয়েছেঃ অবশ্য এটা ওর কথা শুনেই আমার বোঝা উচিত ছিল।
হুজুগে পড়ে প্রায় পনের হাজার টাকা খরচ করে একখানা হ্যান্ডিক্যাম কিনেছিলাম আমি। সেটা ওই ফিল্ম স্কুলে ভর্তি হবার মাস চারেকের মধ্যেই। টাকাটা দিয়েছিল মা। বাবার তো এসবে কোনদিনই মত ছিল না। তাও নিজের পয়সায় করছি দেখে কোনদিন খুব বেশি কিছু বলেননি। মাকে যেদিন বলেছিলাম, ‘ক্যামেরা কিনব, সিনেমা করব’, মা বেশ ভয়ার্ত চোখেই জিজ্ঞেস করেছিল, ‘সে তো অনেক টাকা, না?’

বাবার থেকে গোপন রেখেই মার দুটি সোনার চুড়ি বেচে হ্যান্ডিক্যাম-টা কিনেছিলাম। মা সেদিন হেসে, দুঃখ না করেই বলেছিল, ‘তুই তোর এক বই-এ দেখাসঃ মা ছেলেকে চুড়ি বেচে ক্যামেরা কিনে দিচ্ছে। দেখবি, দর্শকের খুব ভাল লাগবে’। মুখের ওপর না হলেও সেদিন মনে মনে ভেবেছিলাম, ‘ধুর, এ তো একখানা কমার্শিয়াল সিনেমার প্লটলাইন হয়ে গেল। আমি কি থোড়েই কমার্শিয়াল সিনেমা বানাবো নাকি?’

যেদিন এক ফিল্ম স্কুলের বন্ধু, অমিত-কে বলেছিলাম যে হ্যান্ডিক্যাম নিয়ে শর্ট ফিল্ম করব, সে হেসে বলেছিল, ‘তুই পাগল নাকি? হ্যান্ডিক্যাম-এ প্রোজেক্‌শন করলে তো ছবি ফেটে একাকার হয়ে যাবে। ওতে কোন ‘প্রফেশনাল’ কাজ হয় নাকি? যদি তোর ফিল্ম-টা কোন ফেস্টুতে সিলেক্ট হয়, তাহলে কি করে ওরা সেটা দেখাবে বলত?’ অমিত এখন একটা বই করছে, ‘অশান্ত প্রেম’। জানি না সেটা কোন ফেস্টুতে সিলেক্ট হবে কিনা। আর কিছু না হোক, শালার-টা অন্তত ‘প্রফেশনাল’ ফিলিম হবে!

এই প্রফেশনাল কথাটা বুঝতেই আমার সময় লেগে গেল পাক্কা পাঁচ বছর। তাও বোধহয় এখনো পুরোপুরি বুঝিনি। নাহলে শালা কোন প্রোডিউসারের বউ-কে সপ্তাহে একদিন ‘এন্টারটেন’ করতে চলে যেতাম। তিনি তার স্বামীকে বলে একটা হিল্লে করাতেন।

মাঝে বম্বের একটা লোকের সাথেও আলাপ হয়েছিল। ফিল্ম স্কুল থেকে পাসআউট করেই দশদিনের জন্যে বম্বে যাই। সদাগরি আপিসের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে। সেখানে হাঁ-ভাতের মতন ক’দিন স্টুডিও পাড়া চক্কর মারার পর লোক-টার সাথে আলাপ হয়। সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম, লেখালেখি করতে ভাল লাগে শুনে শালা একদিন তার বাড়িতে দেখা করতে বলল। গোরেগাঁওন-তে মাল-টার বিশাল ফ্ল্যাট, একাই থাকে- তবে ঘরের ইতিউতি মহিলাদের পোষাকঃ প্রধানত ব্রা-প্যান্টি ছড়ানো। অবশ্য লোকটা মন্দ না। মাল খাওয়াল- এক্কেবারে ইম্পোর্টেড। প্রভূত আদর-যত্ন করল। আমার স্ক্রিপ্টের কিছু আইডিয়া শুনল, আর বলল বম্বে চলে আসতে পাকাপাকিভাবে। অবশ্যি এর দুদিন পরে কলকাতা থেকে খবর গেল বাবা মারা গেছেন। তারপরে আর বম্বে যাওয়া হয়নি। ওই মাল-টা এরপরে দুটো বই করে, যার মধ্যে প্রথমটার সাথে আমার একটা আইডিয়ার ভীষণ মিল। আর পরেরটা একটা ইংরিজি ছবির কপি। দুটোই মাঝারি মানের হিট করলেও শালা তার ক’দিন পরেই তার ১২ বছরের ঝি-কে সিনেমায় নামানোর নামে রেপ করার অভিযোগে শ্বশুরবাড়ি যায়। এরপর লোক-টা আর প্রোডিউসার পেয়েছে বলে জানি না।

কয়েকটা ওই চোলাইয়ের ঠেকের মতন গজিয়ে ওঠা প্রোডাকশন হাউসেও যাই। ওখানে আবার মাল খাওয়ায় না, ‘সোডা’ দেয়। মেক-আপ মারা সুন্দরী সুন্দরী রিসেপশনিস্ট-রা বসে বসে টেলিফোনে ইংরিজি ঝাড়ে। এসি ঘরে বসে পয়সা ভিক্ষে চাওয়ার একটা আলাদাই মহিমা আছে। দাদা, ৭৫ লাখ দিনঃ মাইরি বলছি লস খাওয়াব না। এক্কেবারে ছেঁড়া জুতোটার দিব্যি।

কিন্তু ওই ছেঁড়া জুতোকে কেউ কখনো ৭৫ লাখ দেয় নাকি? হলও বা তোমার ওয়ান-লাইনার ‘রিভেটিং’, বা সিনপ্সিস, ‘ইন্ট্রিগিং’। ইংরিজি প্রশংসা ভুয়োসি এলেও, ওইসব হাউসে ছেঁড়া জুতোয় গেলে শিকে ছেঁড়া অসম্ভব। তবে ওই সব ছেঁড়া জুতো পর্দায় দেখালে লাখ-টাকা। ড্যানি বয়েলের শ্বশুর এসে হাত ধরে কান, ভেনিস নিয়ে যাবেঃ তাও বিজনেস ক্লাস-এ। যেখানে নাকি এয়ার হোস্টেস-দের পেছনে চিমটি কাটলেও তারা হেসে বলে, ‘উড ইউ লাইক সামথিং, স্যার?’

প্লেনে আমিও চড়েছি। দু’বার। প্রথম যেবার ওই মনোজ বাড়ুজ্যের সঙ্গে হায়দ্রাবাদ গেলাম একটা ৭০ হাজারের গান শ্যুট করার জন্যে। আর দ্বিতীয়বার গেছিলাম দার্জিলিং, মানে ওই বাগডোগরা। ‘জন্ম-মৃত্যু’ বই-য়ের একটা গান এবং তিনটে সিন শ্যুট করার ছিল। ডিরেক্টর ছিল শ্যামল দাস। মাল-টা আউটডোরে রোজ রাত্রে সিনেমার নতুন নায়িকা-কে নিয়ে শুতে যেত। আমাকে একদিন নেশার ঘোরে বলেছিলঃ ‘তুইও করবি রে শালা, চিন্তা করছিস কেন? মাল ফেলবিঃ তোকে শালা পুরো পোর্টফোলিও আলবাম বের করে দেবে। যাকে ইচ্ছে চুজ্‌ করবি, নো চিন্তা! শালা কি ছবি একেকটা, মাইরি… কি বলব… দেখলেই অর্ধেক কাজ হয়ে যাবে’

দার্জিলিং-এই আমার আলাপ হয়েছিল ওর সঙ্গে। মেয়েটার নাম-টা ঠীক মনে পড়ছে না… এখন মোটামুটি নামকরা নায়িকা হয়েছে। আমি আমার হ্যান্ডিক্যামে মেঘে-ঢাকা লাজবতী কাঞ্চনজঙ্ঘা-কে মনের জোরে বে-আব্রুর চেষ্টা করায় সে প্রতিবাদ করে বলেছিল, ‘ক্যামেরা দিয়ে বুঝি আপনারা আজকাল মেঘ-ও সরিয়ে দিতে পারেন?’

অন্য কেউ হলে হয়ত আমি মনে মনে উত্তর দিতাম, ‘ফটোশপে যদি আপনার জামা-কাপড় সরিয়ে দিতে পারি তো এই মেঘ কোন ছাড়?’

কিন্তু আমি সে উত্তর চিন্তা করতে পারিনি। কেমন একটা বাধো বাধো ঠেকেছিল। ওই অনেকসময় অন্যদের বলা ‘ভাল ছবি’ দেখতে গেলে যা হয় আরকি! প্রবল ইচ্ছেতে ভাল লাগাবার চেষ্টা করলেও যেমন ভাল লাগানো যায় না, তেমনি তার সম্বন্ধে কোন কুরুচিকর মন্তব্য মাথায় আনতে গিয়েও আমি আনতে পারিনি। অবশ্য এখন পারি। মেয়েটি শ্যামল দাসের বই-তে সাপোর্টিং থাকলেও ডিরেক্টরের বেডরুমে কিছুদিন পরেই জায়গা করে নেয়। সেই প্রসঙ্গে ওকে পরে জিজ্ঞেস করাতে খুব সোজা একটা উত্তর দিয়েছিল, ‘তুমি ডিরেক্টর বা প্রোডিউসার হলে তোমার ঘরেও যেতাম’

গত বছর যখন মা-র শরীর খারাপ হয়, আমি সুশান্ত রক্ষিতের সঙ্গে দেখা করি। মাল-টার সঙ্গে আমার ‘বসে মাল খাই’ গোছের বন্ধুত্ব না থাকলেও লোক-টা একসময় আমার একটা ইউনিটের প্রোডাকশন ম্যানেজার না কি যেন ছিল। দেখা দিতেই চিনতে পারল। কানাঘুষোয় শুনেছিলাম লোকটা একজন ভাল স্ক্রিপ্ট-রাইটার খুঁজছে। গিয়ে তাকে একটা স্ক্রিপ্টের আইডিয়া শোনাতে বেশ উৎসাহও দেখাল। বিকেলে তার বাড়িতে দেখা যখন করতে গেলাম, সে সরাসরি জিজ্ঞেস করল আমি কত চাই।

মাল-টা আমার স্ক্রিপ্ট নিয়ে ছবি করবে, আর শালা আমারই নাম দেবে না। বলবে নাকি সে নিজে লিখেছে। যখন মনে মনে ওকে কত রকমের কাঁচা খিস্তি দেওয়া যায় চিন্তা করছি, কেমন একটা ঝাড়া কমার্শিয়াল-মার্কা সিনেমার টার্নিং-পয়েন্টের মতন মা-র মুখটা মনে পড়ে গেল। ব্যাকগ্রাউন্ডে যেন বেজে উঠল সেই আদ্দিকালের বস্তাপচা সানাই-এর করুণ সুর, যেগুলো শুনে স্বপন সাহার সিনেমার দর্শক হল-এ চোখের জল মুছত। কেমন একটা প্রসেনজিৎ-মার্কা স্টাইলে করুন মুখ করে সেদিন চল্লিশ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। মা’কে সুস্থ করে ঘরে আনার পর যদিও তাকে এই গপ্পো-টা শোনানো হয়নি; হলে নির্ঘাত বলত ‘এই নিয়ে ছবি কর। দর্শক খুব পছন্দ করবে’ আর আমিও মনে মনে মুচকি হেসে বলতাম, ‘ধুর, এ তো পাক্কা কমার্শিয়াল সিনেমার প্লটলাইন হয়ে গেল। আমি কি থোড়েই ওই বস্তাপচা কমার্শিয়াল সিনেমা বানাবো নাকি?’

আমি তো বানাবো ভাল সিনেমা। যেগুলোতে থাকবে অসাধারণ সব সাবলিমিনাল মেসেজ, যা ইন্টেলেকচুয়াল দর্শক ছাড়া ধরতেই পারবে না। যেগুলোর শ্যুটিং-এর সময়ে ডিরেক্টর-কে খুশি করতে তার হোটেল রুমের সামনে নায়িকা-দের লাইন পড়ে যাবে। যেগুলোর ভাবনায় থাকবে ফ্রয়েডিয়ান এবং সুরিয়ালিজমের অনন্য সঙ্গম, যেখানে ড্রিম এবং রিয়ালিটির বিবাদ ঘটিয়ে সিনেমা-জগতে রেভোলিউশন এনে দেব আমি। যার শ্যুটিং-এর প্রতি রাতে ড্রিঙ্ক করে বাওয়ালি করে পরদিন সকালে বলব, ‘সব মহান ডিরেক্টর ও অভিনেতারাই ড্রিঙ্ক করত’। যার ভাবনা এত ইন্টেলেকচুয়াল হলেও এন্টারটেইনমেন্ট-ও থাকবে ষোল-আনা। যাতে কমার্শিয়াল এবং ক্রিটিকাল — দু’ধরনের বাহবাই পাওয়া যায়। পাম ডি-ওরের সাথে আনন্দলোক পুরস্কার পেয়ে রেকর্ড করবে আমার সিনেমা। আর কোন নামী ফিল্ম ম্যাগাজিনে আমার ছবি-তে দেখানো নগ্নতার ‘এস্থেটিসিজ্‌ম্‌’ নিয়ে ইয়াব্বড় একখানা ক্লাস টেনের ইতিহাসের উত্তর লিখবে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, বা ম্যানোলা ডার্গিস।

এক্কেবারে প্রফেশনাল হয়ে যেতে পারলে লাইফে শালা কোন সমস্যা থাকবে না আর। কিন্তু প্রফেশনাল হওয়া-টা যে এত পার্সোনাল একটা ব্যাপার, সেটা বোঝার পর থেকেই ওই শব্দটা কেমন একটা খিস্তির মত শোনায়। প্রফেশনালি রামের পেছনে লক্ষণ-কে ‘মাতৃমাত্রায়’ খিস্তি মারতে হবে। মাতাল হয়ে বাওয়ালি করতে হবে ওই ছোঁকছোঁকে লোকগুলোর সঙ্গে। কয়েকটা এ-মার্কা জোক্‌স্‌ বলতে পারলে তো কথাই নেই! প্রোডিউসারকে ছলে বলে কৌশলে, বা নিতান্তই মাছ ধরার টোপ গিলিয়ে তাদের সিন্দুক ফাঁক করতে হবে! আঁতেল প্রোডাকশন হাউসে স্যুট-বুট পড়ে, বার্গম্যান, কুরোসাওয়ার দোহাই দিয়ে গোছাতে হবে জাল। পারব… কোনদিন কি পারব না? নিশ্চয়ই পারব। হয়ত একটু সময় লাগবে। কিন্তু বেঁচে থাকতে তো পয়সা চাই… সে শূয়োরের বাচ্চা তো প্রোডিউসারের মতোই বেপাত্তা। নাহয় দু একটা বই ওই ঘোস্ট-ডাইরেক্ট করেই কাটিয়ে দেব। না খেতে পেলে তো এমনিতেই মরে ভূত হয়ে যাব। গিল্ডের কার্ড-টা যে খেটেখুটে করিয়েছিলাম, সেটার তো দাম আছে! জ্বলজ্বলে গ্রাফিক্সে নাম না হয় শালা ওই অকম্মা ঢেঁকিটার-ই গেল। আমার কি? আমার তো পয়সা পাওয়া নিয়ে কথা। তারপর সবার সাথে ‘মাল-খাওয়া বন্ধু’ হয়ে যাওয়ার পর সবাই যখন আমায় চিনে যাবে, সবাই যখন যেচে কাজ দেবে… তখন তৈরি করব আমার মনের মতো ছবি। দেখব শালা কোন ব্যাটা প্রাইজ না দিয়ে থাকতে পারে!

শুধু তদ্দিন মা বেঁচে থাকলে হয়। মা মাঝেমধ্যেই বলে, ওই হ্যান্ডিক্যামে করা বই তাকে কবে দেখাবো… কিন্তু ওই সিনেমা তো আবার শালা প্রফেশনাল হবে না!

(বলাই বাহুল্য, গল্পের সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক, যদিও তাদের বেশ কিছু সত্যিকার নাম-না-জানা চরিত্র থেকে অনুপ্রানিত।)

--

--