সুইসাইড

Tasnim Rifat
Tasnim Rifat
4 min readAug 10, 2020

--

ফরাসি বিপ্লব হয় ১৭৮৯ সালের দিকে। বিপ্লবী সরকার ক্ষমতায় আইসা ক্যারিবিয়ান উপনিবেশগুলাতে দাসপ্রথা বাতিল করে। কিন্তু পরে যখন নেপোলিয়ন গদিতে বসে, ততোদিনে আবার দাসপ্রথা চালু হয়ে গেছে৷ ক্যারিবিয়ান উপনিবেশের একটা অঞ্চলের কিছু লোক নেতার অধীনে একত্রিত হয়ে দাসপ্রথা চালু নিয়া বিদ্রোহ শুর করলো। ফরাসি আর্মির সাথে ফাইট দিল৷ একসময় বুঝতে পারলো যুদ্ধ কইরা পারবে না। তো নারী-পুরুষ মিলায়ে ৪০০ জনের মতো মানুষ মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিল। তাদের গান পাউডারের স্টোরে আগুন লাগায়ে গণ আত্মহত্যা করবে। এর আগে যত পারে তত ফরাসি আর্মি মারার ট্রাই করবে। এই একই টাইপের ঘটনা ঘটে যখন কলম্বাস বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দাস নিয়া ইউরোপে বিক্রি করা শুরু করে। ওই সুইসাইডগুলার একটাই লক্ষ্য ছিল, দাস না হওয়া।

এই কাহিনী বললাম দুইটা কারণে৷ একটা হইলো, সুইসাইডরে যারা কেবল ব্যক্তিগত মানসিক ব্যাপার আকারে দেখাইতে চান, বা মনে করেন একজন আরেকজনের একটু কেয়ার বেশি করলেই সুইসাইড হবে না, সেটা যে সমাধানের ক্ষেত্রে খাটে না, তা দেখানোর জন্য।

সাইকোলজি নিজেও সোসাইটির সাথে যুক্ত৷ নৃবিজ্ঞানী ম্যালিনোওস্কি বলছিলেন 'সাইকোসোস্যাল' চাহিদার কথা। মানে ব্যক্তির এমন চাহিদা যেটা একইসাথে সোস্যাল আর সাইকোলজিক্যাল৷ ধরেন, আপনার বন্ধু নাই দেখে আপনে একাকীত্বে ভুগেন। 'বন্ধু' জিনিসটা একটা সোস্যাল ডোমেইন। কিন্তু বন্ধু না থাকার জন্য যে একাকীত্ব সেটা আবার অনেক বেশি সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার। যাই হোক,আরেকটা ব্যাপার হইলো- সুইসাইড অনেকরকম৷ এমনকি হাজারটা সুইসাইডের হাজারটা কনটেক্সট থাকতে পারে। উপরে দাস হওয়া থেকে বাঁচার জন্য যে সুইসাডের কথা বললাম, ডুর্খেইমের ভাষায় এটারে বলা যায় 'ফাটালিস্টিক সুইসাইড'। মানে আপনে যখন বুঝবেন, আর কোন পথ নাই এই সিস্টেমের দাস বানানি প্রকল্প থেকে বাঁচার, তখন আত্নহত্যা একটা নিয়তি হয়ে দাঁড়াইতে পারে। এটা হয় যখন সোসাইটি বা কোন সিস্টেম মানুষের উপর অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

সুইসাইড নিয়ে সবচেয়ে বড় কাজের একটা করছিলেন ডুর্খেইম। ডুর্খেইমের আগ্রহের জায়গা ছিল সোসাইটি । উনি সুইসাইডরে সাইকোলজিক্যাল ঘটনা আকারে না দেইখা একটা সামাজিক ঘটনা আকারে দেখা শুরু করেন। সুইসাইডের তত্ব তালাশ করতে গিয়ে উনি অর্থনীতির সংকট, ফ্যামিলি, সামাজিক আর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলার দশা, সামাজিক সংহতি আর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ - এ এইধরনের জিনিসগুলা নিয়া কাজ করেন। সুইসাইডরে চারভাগে ভাগ করছিলেন উনি৷ ইগোইস্টিক, আলট্রুইস্টিক,এনোমিক আর ফাটালিস্টিক সুইসাইড।

ইগোইস্টিক সুইসাইড হইলো মানুষ যখন সোসাইটির কালেক্টিভিটির বাইরে নিজেরে আলাদা ভাবে এবং মইরা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়৷ আলট্রুইস্টিক সুইসাইড ঘটে যখন সোসাইটির কোন প্রথা মাইনা নিতে বা সোসাইটির ভালোর জন্য (সে মনে করে) কাউরে সুইসাইড করতে হয়৷ অনেক ট্রাইবে যেমন দেখা যায় কোন লোক খুবই অসুস্থ হইয়া পড়লে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়৷ এনোমিক সুইসাইড খুব ইম্পর্টেন্ট। মানুষের চাওয়া-পাওয়া, চাহিদা, মোরাল ইস্যুগুলা দেখার জন্য বিভিন্ন সোস্যাল ইন্সটিউটিউশন থাকে। এই ইন্সটিটিউশনগুলা যখন ফেইল করে, বা এদের কাজ বদলাইতে থাকে- তখন তার চাপ পড়ে মানুষের উপর। এনোমিক সুইসাইডের মতো ঘটনা তখনোই ঘটে। ফাটালিস্টিক সুইসাইডের কথা তো আগে বললামই। এখানে মেইনলি আমি ইগোইস্টিক আর এনোমিক সুইসাইড নিয়াই আলাপ করমু।

সুইসাইড যে সামাজিক জিনিসপাতির উপর নির্ভরশীল সেটা দেখানোর জন্য ডুর্খেইমরে অনেককিছু করতে হইছে। ডেনমার্ক,জার্মানি, ইংল্যান্ড এমন অনেক দেশের সুইসাইডের সংখ্যার তুলনা করে দেখাইছিলেন একেকদেশে সুইসাইডের সংখ্যা একেকরকম। আবার ১৮৪১-১৮৭২ পর্যন্ত ওই দেশগুলার সুইসাইডের সংখ্যা হিসাব কইরা দেখান, কোনদেশেই নাটকীয় কোন পরিবর্তন ঘটে নাই। ডুর্খেইম সিদ্ধান্তে আসছিলেন, প্রত্যেকটা দেশের সোসাইটি, ফ্যামিলির ধরণ, সমাজের একে অপরের সম্পর্কের চেহারাসহ সব সেটিংসই একেকরকম, আর এইজন্যই সুইসাইডের রেটও এসবের উপর নির্ভর করে একেকরকম।

তো ডুর্খেইম সোসাইটির ফেনোমেনাগুলারেই বাইছা নিছিল সুইসাইডের কলকব্জা বুঝার জন্য। এইজন্য ডুর্খেইম বলছিলেন সোস্যাল ইন্টিগ্রেশন বা সামাজিক সংহতির কথা। যে জিনিসের জন্য কোন মানুষ একটা বৃহত্তর সমাজের সাথে এক হয়, সমাজের সাথে নিজেরে যুক্ত করে, তারেই ডুর্খেইম বলছে সামাজিক সংহতি৷ এভাবে বৃহত্তর সমগ্রের মধ্যে সে অংশ নেয়। ফ্যামিলি, সমাজ, রিলিজিয়াস গ্রুপ বা জাতীয়তার ভিত্তিতে গইড়া উঠা গ্রুপও এইসবক্ষেত্রে কাজ করে। কিন্তু এই সামাজিক সংহতির সুতা যখন ছিড়তে থাকে, তখনোই ইগো সে জায়গা দখল করতে থাকে৷ মানুষ নিজেরে আলাদা ভাবতে থাকে। ইগোইস্টিক সুইসাইডের ক্ষেত্রে নিজেরে গ্রুপ বা কম্যুনিটির থেকে আলাদা কইরা দেখার ব্যাপারটাই ঘটে। এসব ক্ষেত্রে কাজ করে পলিটিক্যাল ঝামেলাও। রোমে এপিডেমিক বা অটোমান সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক ভাঙ্গনের সাথে সাথে বহু মানুষের সুইসাইডের ঘটনাও দেখি আমরা।

প্রত্যেকটা সোসাইটির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকার কথাও বলছিলেন ডুর্খেইম। সোস্যাল আর কালচারাল ইন্সটিটিউশনগুলা মানুষের চাহিদা, সম্পর্ক ইত্যাদির একটা বিধান তৈরি করে৷ কিন্তু মানুষের সামাজিক চাহিদাগুলার (যেমন সম্পদ) যখন অতিরিক্ত লেভেলে চইলা যায়, আর সোস্যাল ইন্সটিটিউশনগুলা কোনোকারণে কাজ করা বন্ধ কইরা দেয়, তখন ঘটে এনোমিক সুইসাইডের ঘটনা৷ এই সোস্যাল ইন্সটিটিউশনগুলা ভাইঙ্গা পড়ার অন্যরকম কারণ ইকোনমিক আর পলিটিক্যাল। শিল্প বিপ্লবের পর ইকোনমিই মানুষের সব ইন্সটিটিউশন আর সত্তারে দখল কইরা নিতাছে, এই কথা আমরা ডুর্খেইমের মারফতে জানতে পারি। এখনো এই কনজিউমারিজমের যুগে এই কথা আরো সত্য। আমরা তো নিজের সাথে অপরের বা নিজের সাথে সমাজের সম্পর্কের বিধান কি হবে তার একটা সুস্থ বাস্তবায়ন সোসাইটিতে আর দেখতে পারি না। আমাদের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই বিভিন্নভাবে এই ব্যাপারে ব্যর্থ। ফলে, সুইসাইড একটা বড় ঘটনা আকারে থেকেই যাইতেছে।

কাম্যু বলছিলেন সুইসাইড একটা সিরিয়াস দার্শনিক সমস্যা। সে তো অবশ্যই। তবে সামাজিকও।

তলস্তয়ের উপন্যাস আন্না কারেনিনায় আমরা একই ধরনের ঘটনা দেখি৷ আন্নার ফ্যামিলি থাকে। জামাই আর বাচ্চা থাকে। এরপর সে প্রেমে পড়ে আরেক লোকের,পরকীয়া প্রেম। ওই প্রেমরে স্বীকৃতি দিতে গিয়া ফ্যামিলি ছাড়তে হয়, সোসাইটি থেকেও বিচ্ছিন্ন হইতে হয় তারে। শেষে আন্না যখন আত্নহত্যার আগে ট্রেন স্টেশনের দিকে যায়, তখন তলস্তয় যে বর্ণনা দেন, এইটা মনে হয় লিটারেচারের হিস্টরিতে বিরল৷ আন্নার চিন্তায় প্রলাপের মতো বিভিন্ন জিনিস আসতে থাকে৷ তখন আন্না আর সমাজের থাকে না, তার পরিবারের,বাচ্চার বা প্রেমিকার থাকে না। সে সবকিছু বিচ্ছিন্ন হইয়া যেন একক আন্না কারেনিনায় পরিণত হয় । একটু পরেই ট্রেনের চাকার নিচে পড়ে আত্মহত্যা করবে আন্না কারেনিনা।

কেউ কেউ বলে, তলস্তয়ের এই উপন্যাসে ট্রেনের চাকা হইলো সিস্টেমের প্রতীক। সিস্টেম বা সমাজ বা পলিটিক্স বা আপনার আশেপাশের অবস্থা। এই চাকা কিন্তু এখনো আছে, সুইসাইডও আছে৷ সুতরাং পাশের লোকটির প্রতি আরেকটু কেয়ারই তারে সুইসাইড করা থেকে বাঁচানো যাইতে পারে, এইটা কোন কার্যকরী সমাধানই না। সুইসাইড একটা বড় ঘটনা,আপনার আমার চারপাশের অনেক ঘটনার সাথেই কানেক্টেড। এরে দেখতে হবে এমনে৷ এর নিদানও এগুলার মধ্যেই আছে।

দোহাইঃ

Marx, Durkheim, Weber. Formations of Modern Social Thought, Ken Morrison

Suicide, Emile Durkheim.

--

--