অল্প একটু ইতালি

A weekend gateway around Bergamo-Brescia

Nowshad
tripsharebd
6 min readFeb 10, 2020

--

ইউরোপে অনেক ক্ষেত্রেই ট্রেন বা বাস জার্নির চেয়ে কম খরচে প্লেন এর টিকিট পাওয়া যায়। আমিও তাই গুগল ফ্লাইটে কোলন থেকে বেশ কিছু রাউটে সাবস্ক্রাইব করে রেখেছিলাম যে দাম কমলে টিকিট কিনে ফেলবো। দামও কমে-বাড়ে, কিন্তু আমি টিকিট কিনি কিনি করেও কিনি না। শেষমেশ একদিন ধুম করে ইতালির বারগ্যামোর টিকিট কিনে ফেললাম রাউন্ড ট্রিপ ২০ ইউরো দিয়ে। মাঝে মাঝে মাথায় খেলে না, কোন হিসেবে একটা দেড় ঘণ্টার ফ্লাইট ১০ ইউরোতে ব্রিক্রি করে। তবে মাথায় খেলুক না না খেলুক, আমার মতন হাজারো মানুষের কাছে এই কমদামে ফ্লাইট একটা আশীর্বাদের মতন সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

৭ ফ্রেব্রুয়ারি সকাল সকাল চলে গেলাম কোলন-বন এয়ারপোর্টে। জার্মানি আসলাম প্রায় ছয় মাস হয়ে যাচ্ছে, এর মধ্যে এই প্রথম প্লেন জার্নি। প্লেন যখন জার্মানি-সুইজারল্যান্ড বর্ডারের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, তখন থেকেই জানালা দিয়ে দেখার মতন দৃশ্য শুরু হল। তার মাঝে আকাশ একদম পরিষ্কার আর চকচকে রোদ থাকায় সুইস আল্পস দেখতে চমৎকার লাগছিল। বিশাল বড় বড় পাহাড়ের রেঞ্জ, শ্বেত শুভ্র বরফের আবরণে ঢাকা। মাঝে মাঝে পাহাড়ের মাঝে লেক, আর তা ঘিরে গড়ে উঠা জনবসতিগুলোও চোখে পড়ছিল। তো এই সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখে দেখে প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ফ্লাইট উত্তর ইতালির বারগ্যামো নামক শহরে ল্যান্ড করল প্রায় দুপুর ১২ টার দিকে।

আজকে আমার প্লান নেই তেমন কিছু, হেঁটে চলে এদিক সেদিক করে দিন কাটাব। শহরটা দেখার মতন, বিশেষ করে পুরানো স্থাপনাগুলোর গঠন ও কারুকার্য অবাক করার মতন।

পাহাড়ে ঘেরা একপাশ শহরের মাঝে একটা পুরানো শহর, ছোট্ট একটা পাহাড়ের উপরে। তবে দেখে মনে হয় পাহাড়ের উপর যুদ্ধ এবং আক্রমণ থেকে বাচার জন্য এইরকম পাথরের দেয়ালে ঘেরা শহর বানানো হয়েছে, নাম তার — সিটা আলটা। উপরে যাবার একটা ফানিকুলার আছে, তিন ইউরো উঠানামা। উপরে গিয়ে বোঝাই যায় না যে এই পুরো যায়গাটা পাহাড়ের উপর। পাথরের রাস্তা, দেয়াল, পুরানো চিপাচাপা হাটার রাস্তা, বিভিন্ন স্থাপনার গঠন দেখতে দেখতে হাটার সময় মনে হচ্ছিল কয়েক শতক পেছনের সময়ে চলে গেছি। প্যলেস, ফোর্ট, যুদ্ধের কামান, চার্চ, সেন্টার স্কয়ার, ওয়াইন শপ, পিজ্জারিয়া, কি নেই! প্রায় অনেকক্ষণ হাঁটাচলা করে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এল।

আজকে রাত থাকার ব্যবস্থা বারগ্যামো ইয়োথ হোস্টেলে। শহরের একপাশে পাহাড়ের ধারে একটা ছিমছাম সুন্দর হোস্টেল। এখন অফ সিজন বলে তেমন একটা ভিড় নেই বললেই চলে। হোস্টেলে চেকইন করে, হাতমুখ ধুয়ে আবার বের হলাম। হোস্টেলের একদম সামনে থেকেই সিটা আলটা যায় একটা বাস। চলে গেলাম আবারও সিটা আলটা। রাতের আর দিনের পরিবেশ বেশ আলাদা, বেশিরভাগই মধ্য অথবা বয়স্ক কাঁপল। সবাই ঘুরাফেরার পালা শেষ করে এখন ওয়াইন বা পিজ্জার দোকানগুলোতে জায়গা করে নিয়েছে। আমিও ভাবলাম, ইতালি এসে যদি পিজ্জাই না খাই তাহলে কিভাবে হয়! একটা বেশ ভাল দেখে পিজ্জারিয়াতে ঢুকে পিজ্জা খেয়ে পেট ভরে তারপর আস্তে ধীরে ফিরে এলাম হোস্টেলে।

অনেক ঘুমাতে হবে আজকের রাতে, যেহেতু পরের দিন ভোরের ফ্লাইটের জন্য রাতে এয়ারপোর্টে থাকার প্লান। রাত দশটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে হোস্টেলের ক্যন্টিনে ব্রেকফাস্ট করতে গেলাম। রাতে আগে ঘুমিয়ে পরায় রুমের কারো সাথে কথা হয়নি। সকালে নাস্তা খেতে খেতে এক পর্তুগিজ ট্রাভেলারের সাথে কথা হল, আলবেনিয়ার যাচ্ছে, এখানে এক রাতের লে ওভারে ছিল। একবার হোস্টেলের ছাদ থেকেও ঘুরে এলাম গল্প করতে করতে।

খাওয়া দাওয়ার পালা চুকিয়ে বারগ্যমো সেন্ট্রাল স্টেশনে গিয়ে দেখলাম, ট্রেন আরও দুই ঘন্টা পড়ে ব্রেসিয়া যাবার। তাই একটু অন্য রুট এর একটা বাসে উঠে বসলাম। প্রায় এক ঘণ্টার জার্নি, তবে পাহাড়ে ঘেরা রাস্তা এবং লেক দেখে দেখে পৌঁছে গেলাম লেক ইসেও। বাস স্টপের নাম ট্রাভারনোলা। অসাধারণ সুন্দর লোকেশন।

পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট টাউন, পাশে স্বচ্ছ পানির লেক, দুরে সাদা বরফে ঢাকা পাহাড়ও দেখা যাচ্ছে। একটু পরে ফেরি ঘাটে একটা ফেরি এসে ভিড়ল। উঠে পরলাম, লেকও দেখা হবে আর অপর পাড়ের ছোট্ট টাউন — ইসেও ও যাওয়া হবে। লেকের মাঝে একটা পাহাড় আছে বেশ বড়, নাম ইসেলো। সেখানেও ফেরি ঘাট, হোটেল আছে। প্রায় ২০ মিনিটের সুন্দর ফেরি জার্নি শেষে পৌঁছে গেলাম ইসেও।

সুন্দর লেকের ধারের ফুলেরগাছে সাজানো রাস্তা, পুরানো ধাঁচের বাড়িঘর, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, আর অসাধারণ ভিউ — সব মিলিয়ে চমৎকার লোকেশন। ক্ষুধা পেয়েছিল, একটু খুঁজতেই একটা পুরাতন পিজ্জারিয়া পেয়ে গেলাম। স্লাইস হিসেবে পিজ্জা বিক্রি করে নানান রকম। আমি দুই রকম দুইটা স্লাইস নিলাম, এত পারফেক্ট ব্যালেন্সড পিজ্জা, পিজ্জার হোমগ্রাউন্ড বলে কথা! পেটপূজো শেষে আবার ট্রেন এ চড়ে বসলাম লেকের অপর প্রান্তে যাবার জন্য। লেকের পাশ দিয়ে সুন্দর ট্রেন জার্নি, আর কম করে হলেও পাহাড়ের ভেতন দিয়ে দশটা টানেল পেরিয়ে প্রায় ২০-২৫ মিনিট পর পৌছালাম লেকের অপর প্রান্ত — পিজোগ্নে। এখানে পাথরের ছোট ছোট বিচ টাইপের খোলা যায়গা আর সবুজ ঘাসের মাঠ। বিকেলের রোদ পেয়ে গা একটু এলিয়ে দিলাম ঘাসের বিছানায়। উপরে নীল আকাশ, চারদিকে পাহাড়, নিচে সবুজ ঘাস আর লেকের ছোট ছোট ঢেউ ভাঙ্গার শব্দ, শান্তিতে কিছুক্ষণ পড়ে রইলাম একা একা।

বিকেল চারটার দিকে আবার ট্রেন এ উঠলাম, এই ট্রেন লাইনের একদম শেষ স্টেশন এডোলো পর্যন্ত। এই রাস্তাটা একদম দেখার মতন সুন্দর। ট্রেন জার্নির দুই দিকেই পাহাড়। একটু পরপর পাহাড়ি গ্রাম। দুরের শুভ্র সাদা পাহাড়গুলোও দৃশ্যমান। প্রায় ৫ টার দিকে পৌছালাম এডোলো। সুর্য প্রায় ডুবি ডুবি অবস্থা, আর ফেরার ট্রেনও ৪০ মিনিট পর, তাই খুব বেশি ঘুরে দেখার সময় নেই। আশে পাশে হেঁটে চলে দেখলাম ইতালিয়ান পাহড়ি ছোট্ট শহর। প্রায় চারদিকেই সাদা বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়াগুলো শেষবিকেলের আলো পেয়ে জ্বলজ্বল করছিল সোনালি আভায়। খুব জলদিই সন্ধ্যা নেমে এল পাহাড়ের বুকে, আর জ্বলজ্বল করে জোনাকির মতন জেগে উঠল পাহাড়ের গায়ের বাড়িঘরগুলো। ওদিকে আমার যাবার ট্রেনেরও সময় হয়ে এল, তাই স্টেশনে ফিরে ট্রেনে উঠে পড়লাম।

এখনের গন্তব্য ব্রেসিয়া, প্রায় দেড় ঘণ্টার ট্রেন জার্নি। বারগ্যামোর মতই আরেকটা শহর। একেতো ছুটির দিন, তার মধ্যে সন্ধ্যার পরে, তেমন একটা ভিড় কোথাও চোখে পড়ল না। ট্রেনগুলোরও বেশিরভাগই ফাকা। হেঁটে হেঁটে শহরের মূল স্কয়ারে গেলাম, তার পর এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে স্টেশনের কাছে একটা তুর্কিশ দোকানে রাতের খাবার খেয়ে ব্রেসিয়া থেকে বারগ্যামোর ট্রেন ধরলাম।

৪০ মিনিট পরে এসে পরলাম বারগ্যামো। সারাদিনের ঘুরাফেরাতে একটু ক্লান্ত হয়ে ঘুম ঘুম একটা ভাব। তাই স্টেশনের সামনেই কফি শপ থেকে কফি খেয়ে একটু চাঙ্গা হয়ে নিলাম। তারপর রাত ১২ টার দিকে চলে গেলাম এয়ারপোর্ট। বাজেট এয়ারপোর্ট হওয়ায় অনেক মানুষ, কিন্তু সেই তুলনায় সুযোগ সুবিধা কম। কোন মতে ফ্লোরে বসে দেয়ালে ভর দিয়ে কানে হেডফোন গুজে সময় কাটানোর চেষ্টা করলাম, মাঝে উঠে ভেতরে বাইরে হাটাহাটিও করলাম। তো এমন করেই একসময়য় ৩ঃ৩০ বেজে গেলে সিকিউরিটি পার হয়ে ইমিগ্রেশন এ ঢুকে গেলে ভিড় কমে গেল। ফ্লাইট ৬ঃ১৫ তে, তাই সকালের হাল্কা কিছু খেয়ে নিলাম। তারপর প্লেনে চড়ে বসলাম। আর ঘুমঘুম চোখে ভরা পুর্নিমায় সুইজারল্যন্ডের লেকে চাঁদের আলোর প্রতিফলন দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে গেলাম নিজের শহরে, তারপর নিজের বাসায়, এরপর নিজের প্রিয় বিছানায় গা এলিয়ে সুন্দর স্মৃতির দিবাস্বপ্ন নিয়ে ঘুম…

--

--