ড্রাগনের দেশেঃ পুনাখা

Afsana Jeba
tripsharebd
Published in
6 min readNov 6, 2018

পুনাখা – খুব কাব্যিক নাম। শুধু নামই নয়, এই শহরটা আসলেই কবিতার মত। পুনাখার আবহাওয়াই নাকি সমগ্র ভুটানের মধ্যে সবচে’ চমৎকার। থিম্পুর আগে পুনাখাই ছিল ভুটানের রাজধানী। ফোবজিখা থেকে পুনাখার ল্যান্ডস্কেপের প্রধানতম পার্থক্য হল নদী। Puna Tsang Chhu এর দুপাশেই মনোরম হাইওয়ে। হাইওয়ে শব্দটা খুব বেরসিক। এরচাইতে রাস্তা বা সড়ক সুন্দর। যাই হোক পুনাখা যাবার সময় এই পুনা সাং নদী উপেক্ষা করা প্রায় অসম্ভবেরও অসম্ভব ব্যাপার। যতই সামনে আগাচ্ছি এই নদী ততই প্রশস্ত হচ্ছে। পান্না সবুজ রঙের মোহময় পানি দেখলেই আলিঙ্গন করতে ইচ্ছে করছে। কোথাও পাথুরে, কোথাও নীরব, কোথাও গর্জন করে এই নদী বয়ে যাচ্ছে আমাদের সাথে সাথে।

Wachy Zam ব্রিজের পাশে সুজা পানের জন্য থামা হল। ব্রিজের উপর নদীর মাঝ বরাবর দাঁড়াতে মনে হল ছোট্টবেলার কোন ছবির দৃশ্য দেখছি। দুপাশে সবুজ মাঝখানে পাথুরে নদীর বয়ে চলার তীব্র গান; তারপর পাহাড়, নদীটা মিলিয়ে গেছে একটা বাঁকে। পানির রঙ কোথাও হালকা সবুজ, কোথায় পাথরের বাঁধায় শতখান ভেঙে পরা সাদা। ছোটবেলায় কুমিল্লার একটা গ্রামের স্কুলে আমি পড়তাম, সেই স্কুলের পাশে বইয়ের দোকানে বহুকাল আগে আমি এমন একটা পাহাড়ী নদীর আঁকা ছবি দেখে ভেবেছিলাম- না, নদী এমন হতেই পারেনা। এটা পুরোপুরি কল্পনা! আমার ভান্ডারে তখন বাড়ির কাছের খাল, গোমতী এবং মেঘনা। এমন ছবিকে আমি কল্পনা ভাবব না তো কী করব? পরে ছবি দেখেই জেনেছিলাম এমন নদী হয়। আমার দেখা প্রথম পাহাড়ী নদী বিয়াস। নদীটা আমার এতই ভালো লেগে গিয়েছিল যে সবাই যখন rafting করতে চলে গেল, নদীর পাশে একটা বড় পাথরের উপর বসে কাটিয়ে দিলাম বিকেলটা। সত্যি বলতে বিয়াসের সাথে পুনা সাঙের বেশ মিল আছে কিন্তু! সবকিছু বাদেও দুটোর পানির রঙই পান্না সবুজ, দূর থেকে দেখে মন ভরে না, কাছে গিয়ে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করে।

Puna Tsang Chhu, view from Wachy Zam

পানির রঙ যখন গাঢ় থেকে গাঢ়তর তখন দুপুরের খাবারের জন্য একটা নদীর গা ঘেষা রেঁস্তোরায় থামা হল। এই রেঁস্তোরার খোলা বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হয় সবুজ মোহময় সুরা ঢেলে দেয়া পানির উপর দাঁড়িয়ে আছি। সেখানে বসে আমি কাগজ কলম নিয়ে লিখা শুরু করলাম।

সবই ঠিক ছিল। একটু পর পুনাখা জঙে যাব, তারপর সাসপেনশন ব্রিজ, হাসপাতাল তো ট্যুর প্ল্যানে ছিলনা, আর থাকবেই বা কেন? কে জানত দুর্ঘটনা ঘটবে? গাড়িতে উঠার সময় আরশির হাত দরজার কাছে ছিল, দরজা লাগিয়ে দেয়ায় ওর হাত চাপা পরে গেল! আমরা সবগুলো মানুষই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে গেলাম আরশির চিৎকার করা কান্নায়। তাই পরের গন্তব্য হল পুনাখা জেলা হাসপাতাল, পুনাখা জঙের পাশেই। ডাক্তার দেখিয়ে, এক্স রে করে জানা গেল, না হাতের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। কয়েক ডজন ওষুধ, জীবনের প্রথম এক্সরে রিপোর্ট, নীল হয়ে যাওয়া ফোলা আঙুল, চোখে পানি কিন্তু হাসতে হাসতে আরশি হাসপাতাল থেকে বের হল।

এর মাঝে একটা মজার ঘটনা ঘটল। যখন বেঞ্চে বসে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছি তখন একটা মেয়ে এসে সপ্রতিভভাবে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করল। আমি হা করে তাকিয়ে আছি দেখে সে হাত নেড়ে নেড়ে আবারও বলল। এবার আমি বললাম আমি ভুটানিজ ভাষা জানিনা। সে দুসেকেন্ড হা হয়ে থেকে হঠাৎ হাসিতে ফেটে পরে ইংলিশে বলল- তুমি ভুটানিজ না?? আমি বললাম – না, বাংলাদেশ থেকে এসেছি! তারপর মেয়েটা বলল- আমি জিজ্ঞেস করছিলাম তিন নম্বর ডাক্তারের ঘরে আমার আগের সিরিয়ালে তুমি কিনা! তোমাকে কিন্তু এই পোশাকে সত্যিই মানিয়েছে! ততক্ষণে আমার খেয়াল হল- ও আচ্ছা এজন্য ও ভুল করল!

মো চু আর ফো চু যেখানে মিলিত হয়েছে সেখানে ঠিক মো চুয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে পুনাখা জং। রাস্তা থেকে দেখলে picturesque beauty যাকে বলে ঠিক তাই এই জঙ। যে এই সাইট নির্বাচন করেছে তার চোখ আছে বলতেই হবে! মো নদীর উপর সুন্দর কাঠের ব্রিজ, টিকেট নিয়ে আমাদের সেখানে দাঁড়াতে বলা হল, গাইড এসে ভিতরে নিয়ে যাবে। একটু পর একজন অতি সুদর্শন হাতে লাল রঙের মাফলার বা ওড়নার মত কিছু একটা নিয়ে এসে বললেন আমাকে এটা পরতে হবে! আমি প্রশ্নাতুর চোখে তাকিয়ে থাকতে বললেন- If you’re wearing our traditional dress you must go inside the Dzong with full national attire. – I don’t know how to wear this. কারণ আমি কোন মেয়েকে ওড়নার মত এই জিনিস পরতে দেখিনি। ওনি সুন্দর করে আমার কাঁধের উপর ঝুলিয়ে দিলেন। এই ওড়না বা মাফলারের মত জিনিসটার নাম rachu, এর ফাংশন বাম কাঁধের উপর ঝুলিয়ে রাখা, মন্দিরে সম্মান জানানোর জন্য বা উৎসবে পরা হয়, রাচুর রঙ দিয়ে নাকি প্রফেশনও বুঝানো হয়! যাই হোক এই গাইডের নাম উগেন। ব্রিজ পার হয়ে অনেকগুলো খাড়া সিড়ির পর জঙে প্রবেশ। এটাই ভুটানের একমাত্র জঙ যেখানে তিনটা উঠান আছে। প্রথম উঠানেই একটা বড় অশ্বত্থ গাছ। চারদিকে কাঠের ভয়ানক সব কারুকাজ করা রেলিং, জানালা, দরজা, কার্নিশ। এই অমানবিক কাঠ খোদাইয়ের কাজ এত ধৈর্য নিয়ে মানুষ কীভাবে করে? একেবারেই স্বতন্ত্র এদের স্থাপত্য। এই কাঠের কারুকাজ মন্দির থেকে শুরু করে বসতবাড়ি পর্যন্ত সব জায়গায়। যেখানে কাঠ দিয়ে করা সম্ভব হয়না সেখানে কনক্রিট দিয়ে করে তার উপর কাঠের রঙ দেয়া হয়। কিন্তু দেশ জুড়ে এই একই স্টাইল সব জায়গায়। যেন জেদ ধরেছে, না আমরা আধুনিক স্থাপত্য অনুসরণ করব না। এবং এই জিনিসটা আমার খুবই ভালো লেগেছে। নিজেদের ম্যাটেরিয়াল, নিজেদের স্টাইল, নিজেদের ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দেয়া।

Punakha Dzong

জঙে ফিরে আসি। কাঠের কারুকাজ দেখে চোখ জুড়োতে জুড়োতে শেষের দিকে মন্দির। এই জঙের শুধুমাত্র মন্দিরেই লোকজন ভিতরে ঢুকতে পারবে, আর কোথাও না। মন্দিরের ভিতর প্রায় ডজনখানেক মূর্তি, তার দ্বিগুণখানেক ফ্রেস্কো। উগেন ধরে ধরে একটা একটা মূর্তি নিয়ে বলে যেতে লাগল। এখানেই প্রথম জানলাম বুদ্ধের তিনটা রূপকে আরাধনা করা হয়, বর্তমান, অতীত, ভবিষ্যত। আরেকটা জিনিস জানলাম ভয়ংকর-দর্শন দেবতা ভয়ংকর-দর্শন কেন? কারণ তারা অতীতে খারাপ কাজ করত, কিন্তু পরে ভালো হয়! দীর্ঘ লেকচারের পর মন্দির থেকে বের হয়ে উগেনকে শিখালাম আমরা বেঙ্গলি নই, বাঙালি! ব্যস্ততার অজুহাতে বিদায় নেবার আগে সে বলল- এখন তোমরা ইচ্ছেমতো ছবি তুলো, কোন দরজা খোলা পেলেই টুপ করে ঢুকে পরো না! আর তুমি কাউন্টারে রাচু ফেরত দিয়ে দিও! সে চলে যাবার পর জানতে পারলাম আমাদের শৈলী তাকে যেতে দিতে চায় না! কারণ সে নাকি তার উপর ‘ক্রাশ’ খেয়েছে!!

সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে বলে আমরা খুব বেশি সময় নিলাম না কেননা আমাদের সাসপেনশন ব্রিজ দেখতে হবে। জঙ থেকে অল্প পথ হাঁটতে হয় নদীর পাড় ধরে। ফো বা পো নদীর উপর এই ব্রিজ। ব্রিজ, নদী, পটভূমির গ্রাম-ক্ষেত- তারপর আনন্দে ঝলমল করা একের পর এক সবুজের শেডের পাহাড় তো আছেই; আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম এই ব্রিজের structure system দেখে। ৩৫০ মিটার দীর্ঘ (গুগল চাচা বলেছে) এই ব্রিজ বানানোর জন্য নদীকে একটুও বিরক্ত করা হয়নি! নদীর দুই পাড়ে চারটা কলাম, এখান থেকে তার দিয়ে ব্রিজটাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। লোহা ছাড়া আর কিছুই ব্যবহার করা হয়নি।

Suspension Bridge, Pho Chhu

এপার থেকে ওপারের দৃশ্য ছোট ছোট সুন্দর বাড়ি, হলুদাভ সবুজ ক্ষেত, পেছনে গাঢ় সবুজ পাহাড়- এই উপত্যকার সীমান্ত রক্ষী। আর এই স্বর্গীয় নদীটার কথা নাইবা বললাম। নীল, সাদা, লাল, সবুজ, হলুদ প্রার্থনা পতাকা ব্রিজের রেলিঙে আটানো- সুন্দর বাতাসে উড়ছে। শুধু ভালো লাগছিল না এত মানুষ। এই সময়টাতেই কেন এত ভিড় থাকতে হবে যখন আমি এসেছি! ব্রিজের মাঝে দাঁড়িয়ে এই এত মানুষ এবং আরশির ভয় পাবার কারণে নদীটা ঠিকমতো উপভোগ করা হলনা। তাই ওপারে গিয়ে শিকড় গেড়ে বসে রইলাম। পানি অনেক নিচে। অথচ এই নদীর বন্যাতেই পুনাখা জঙ নাকি একবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

এরপর মনে হল এই লোহার ব্রিজের উপর বাতাসের সাথে আমাকে দৌড়াতে হবে! আসার পথে তাই আরশিকে অনন্যার হাতে ছেড়ে দিয়ে মানুষজনকে বিরক্ত করে আমি দৌড় লাগালাম এবং ভালো লাগছিল। বাতাসের ঠান্ডা আদর, নদীর অপার্থিব রঙ এবং চারপাশের অসাধারণ দৃশ্যকে না চাইতেও বিদায় জানাতে হল। ঠিক ছিল আমরা পুনাখায় থাকব না, থিম্পু ফিরে যাব। গাড়ির কাছে এসে দেখলাম টাইগার একা একা অপেক্ষা করছে। জ্বালানো তবু শেষ হলনা- টাইগার, এই রাচু আমাকে ফেরত দিতে হবে। গাইড আমাকে এই জিনিস দিয়েছে। – কিন্তু এখন তো কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছে! দেখা যাক! পুলিশকে কীসব অনুরোধ করে সে ফেরত দিয়ে এল। তখন দিনের শেষ আলো। নদী এবং তার পাশে পুনাখা জঙের মনোরম শেষ দৃশ্য উপভোগ করে থিম্পুর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হল। আমার মনে তখন অপূর্ণতা অথবা পূর্ণতা- আমি জানিনা! সব চুপ, অন্ধকার রাস্তা! এক দেড় ঘন্টা পর আমার ধ্যান ভাঙিয়ে টাইগার ডাকল- Jeba? – Hmm? -(silence) -bolo?? – I was checking if you slept… – I’m not sleepy! – Dreamy? – May be!

--

--