ড্রাগনের দেশেঃ ফোবজিখা

Afsana Jeba
tripsharebd
Published in
10 min readNov 5, 2018

সকালে ঘুম ভাঙল, কিন্তু শীতে বিছানার উষ্ণতা ছাড়তে মন চাইল না। আসলে এই ভিলা এবং জানালার দৃশ্য ছেড়ে কোথাও যেতে মন চাইল না। থিম্পু থেকে ফোবজিখা লম্বা পথ। তাতে আমার এত চিন্তা কেন! গাড়ি তো চালাবে টাইগার! সে ইতোমধ্যে গাড়ি ধুয়ে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে, এবং হয়তো মনে মনে ভাবছে কীসব গেস্ট নিয়ে এলাম শুধু দেরি করে! তৈরি হয়ে নিচে গিয়ে একথা জিজ্ঞেস করতেই বলল- You asked for a relaxed tour, right? সত্যিই একদিন একথা মেসেজে লিখেছিলাম।

রোদ মেখে যাত্রা শুরু করলেও দোচুলা গিয়ে রীতিমত কাঁপাকাঁপি শুরু হল। ৩১০০ মিটার উঁচু এই জায়গার প্রধান আকর্ষণ নাকি এখান থেকে বরফে ঢাকা হিমালয় দেখা যায়। কিন্তু হিমালয় দূরে থাক মেঘের জন্য নিচের উপত্যকা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তাতে যে আমার খুব দুঃখ হল তা কিন্তু না! হিমালয় আছে, আমিও একদিন তার সাথে দেখা করতে যাব, সে কি আমার জন্য অপেক্ষা করবে না? নিশ্চয়ই করবে! এখানে বরং যা আছে তাই দেখা যাক। এখানে ১০৮ টা স্তূপ আছে (Druk Wangyal Stupa), সবগুলো দেখতে একই রকম, একটা ওভাল শেপের নকশার উপর তিন স্তরে সাজানো। আচ্ছা আচ্ছা এসব পরে দেখা যাবে, আমি আর অনন্যা শীত কমানোর জন্য দৌড়ে এসব স্তূপ চক্কর দেয়া শুরু করলাম। কীসব নিয়ম যেন আছে ঘড়ির কাটার দিকে নাকি বিপরীত দিকে যেন। আমরা এসব কিছু তোয়াক্কা করলাম না! দৌড়ে ক্ষান্ত হয়ে, ছবি তুলে লাফালাফি করে উপরের বড় স্তূপটার পাশে শান্ত হয়ে বসতেই মনে হল এই জায়গাটা রহস্যময়। সামনে রাস্তার পাশের গাছগুলোর পর সব সাদা। মেঘে ঢাকা। মনে হল ঐ ওখান থেকে এক পা বাড়ালেই আমি অন্য কোন গ্রহে চলে যাব যার সব রঙ সাদা। এই সাদা গ্রহ কীরকম আমি জানিনা। সামনে সাদা পৃথিবী, পেছনে পাহাড়ে শত বাহু মেলা মহীরূহ, বামে একটু দূরে মন্দির।

Druk Wangyal Stupas, Dochula

মন্দিরটা এখানে বানানো হয় পরে, ড্রাগন রাজ্যের একশ’ বছর পূর্তিতে। আর ১০৮ টা স্তূপ বানানো হয় ইন্ডিয়ানদের সাথে যুদ্ধে ভুটানিজদের বিজয় উদযাপন এবং নিহতদের স্মরণ করে। ঘটনা হল ইন্ডিয়ার আসাম রাজ্যের বিদ্রোহীদের কিছু ঘাঁটি ছিল ভুটানে। এবং ঘটনা খুব বেশিদিন আগের না, ২০০৩ সালের। অবশ্য আমি তখন নিতান্তই বাচ্চা। এসব খবর রাখার কোন মানে হয়না।

Druk Wangyal Stupas, Dochula
Druk Wangyal Temple, Dochula

মন্দিরে যেতে আবার সিড়ি ভাঙতে হল। সিড়ি ভেঙে একপাশে খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সামনে মেঘ, সব সাদা। আগের অনুভূতি ফিরে এল – পা বাড়ালে অন্য পৃথিবী যার সব রঙ সাদা। মেঘ আমাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে মন্দিরের চূড়া স্পর্শ করে পেছনের সবুজ বনে গিয়ে লুকাচ্ছিল কিন্তু তাই বলে সামনের সাদা পৃথিবীর ঘনত্ব কোন অংশেই কমে যাচ্ছিল না। অনেকগুলো অ্যাক্রিলিক রঙের সাদা টিউব খালি করে ঢেলে দিয়েছে যেন! রঙের অপচয়!

শুরু হল ফোবজিখার উদ্দেশ্যে যাত্রা। দোচুলা পার হবার পর থেকে আমার মনে হল আমি আরেক অন্য পৃথিবীতে যাত্রা করছি। খানিক আগের সাদা কল্পনার পৃথিবী তেমন আকর্ষণ না করলেও এই সবুজ পৃথিবীতে আমি যেন আকণ্ঠ ডুবে যেতে থাকলাম। আশেপাশে বাড়িঘড়ের চিহ্ন উধাও হয়ে গেল। পাহাড়গুলোর উচ্চতা যেন আরও বেড়ে গেল। আর কালো পিচের রাস্তা এবং আমাদের গাড়ি- যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। নিজের গায়ের রঙ আর পোশাকের রঙ যেন বড় বেখাপ্পা! আমার একটা খুবই অদ্ভুত শিরশিরে অনুভূতি হল। মনে হল কোন অতিকায় প্রাণী যদি আমাকে ঝুলিয়ে নিয়ে ঐ বড় পাহাড়টায় একটু ডুবিয়ে আনে তাহলে আমার মুখ, চোখ, চুল, গায়ের রঙ সব সবুজ হয়ে যাবে। এবং সবুজ হবার ইচ্ছেটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল।

আমার সঙ্গীরা তখন একজন বাদে সব কাহিল। কারো মাথা ব্যথা, কারও গলা ব্যথা, কারও বমি ভাব- সবাই চুপচাপ চোখ বন্ধ করে ঘুম বা বিশ্রাম। আমার জন্য ভালোই হল। কোন কথা নেই। সব চুপ। এই নীরবতায় নিজের শিরা উপশিরায় সবগুলো দৃশ্য গ্রহণ করতে নিজেকে অলৌকিক মনে হল। এমন না যে এর কাছাকাছি দৃশ্য আমি আগে দেখিনি। কিন্তু এতটা শান্ত হয়ে এতটা গভীর পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারিনি!

এর জন্য টাইগার বিশাল ধন্যবাদ প্রাপ্য। কারণ ফোবজিখা আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনায় ছিলনা। ক্লান্তি কাটাতে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে সে শসা খেতে শুরু করল। আর আমরাও গিয়ে ভাগ বসালাম। তারপর সে কয়েকটা পোড়া ভুট্টা নিয়ে ভেঙে ভেঙে আমাদের বিলাতে লাগল। সবজির দোকানে একগাদা মরিচের সামনে তার পাশে গিয়ে বসে পরতেই মনে হল রেজার জন্য উপহার হিসেবে মরিচ নিয়ে যাইনা কেন? তারপর তার সাথে ভিডিও কলে কথোপকথনের পর টাইগার আবার ঘোষণা দিল- You’re sad! এবার আর আমি বললাম না যে চোখ ব্যথা করছে! দেখা যাবে আবার কোন ওষুধের দোকানে গিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে!

পথের ধারে শসা খেতে নামা

পাহাড়, সবুজ, ঘন পাইন বন, একটু পরপর টলটলে ঝর্না, গভীর উপত্যকা- তাতে সরু সুরেলা পাহাড়ী নদী; বুকের ভিতর পর্যন্ত গ্রহণ করতে করতে যখন প্রায় বিকেল, তখন দুপুরের খাবার খেতে গাড়ি থামানো হল, টাইগার বলল আর বেশীক্ষণ নয়, সর্বোচ্চ একঘন্টা লাগবে। অথচ আমার মনে হচ্ছিল অনন্তকাল ধরে আমি এই পথেই চলতে থাকি। আমার কোথাও পৌঁছুবার দরকার নেই। কোন গন্তব্যও প্রয়োজন নেই। এই রাস্তা শেষ না হলেই আমি খুশি।

লাল ভাত, কেওয়া দাতসি, ডাল খেয়ে অন্যদের খেতে খেতে আশপাশ দেখতে বের হলাম। তৃতীয় দিনে প্রথম গাড়ির হর্ন শুনে চমকে আবিষ্কার করলাম আমি রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছি প্রেমে পরার মত একটা সবজি খেতের দিকে। বেড়ার কাছে গিয়ে একজন মেয়েকে দেখতে পেলাম, তাকে জিজ্ঞেস করলাম ভিতরে আসতে পারব কিনা। দু’তিনবার জিজ্ঞেস করার পরও তিনি যখন শুধু সরল হেসেই যাচ্ছেন তখন আমি আর অনন্যা বুঝলাম যে তিনি ইংলিশ জানেন না। তারপর ইশারায় বুঝাতেই তিনি মাথা নাড়লেন। এই বাড়ি এবং পাশের সবজি ক্ষেতে ঢুকেই মনে হল আমি আমার স্বপ্নের রাজ্যে এসে গেছি। গেটটা এরকম যে দুটো কাঠের তক্তা একটা বাঁশে ফোকর বানিয়ে আটকানো। দুটো তক্তা ঠেলে সরিয়ে বাঁশের ফোকর থেকে খুলে তবে ঢুকতে হবে। এই দৃশ্য কেবল আমি উপন্যাসেই কল্পনা করে দেখেছি! ছোট্ট আঙিনা বাড়ির সামনে। তাতে সুন্দর সুন্দর ফুলের টব রাখা। ঘরের পাশ দিয়ে ক্ষেতে যাওয়ার জায়গা! কী নেই সেখানে! ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম, মূলা, গাজর, পেঁয়াজ, আরও অচেনা সবজি। সবজি ক্ষেত পার হয়ে খোলা মাঠের পর গোয়াল ঘর। তারপর আরও কী কী! বলে রাখা ভালো আমি বহুকাল ধরে চাষী হতে চাই!! থন নু বলে একটা রান্নার পেজ আমি ফলো করি, এমন না যে রান্নায় আমার খুব আগ্রহ! ফলো করি কারণ মেয়েটার জীবনধারা দেখতে ভালো লাগে, ক্ষেত থেকে এত সুন্দর করে সব তুলে আনে যে, আর ও এত সুন্দর জায়গায় থাকে যে আমার কল্পনায় নিজেকে ওখানে বসাতে খুব ইচ্ছে করে। মনে হল থন নুর ঐসব দৃশ্যের কাছাকাছি কোথাও চলে এসেছি।

চাষীর বাড়ি

আরও আরও উঁচু উঁচু পর্বত পার করে শিরা উপশিরা সবুজে ভর্তি করে প্রায় শেষ বিকেলে পৌঁছলাম Gangteng Monastery তে। ফোবজি উপত্যকার মাঝখানে যে পাহাড়টা সেখানেই এই জং। এখান থেকে ঘুরে ঘুরে সম্পূর্ন উপত্যকাটাই দেখা যায়। অনেকগুলো পাহাড় মিলে এই উপত্যকাকে বাইরের সমস্ত পৃথিবী থেকে আড়াল করে একান্ত নিজের করে কোলের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে যেন। জঙে ঢুকার আগে পেমা আমাদের ছোটখাট একটা লেকচার দিল সামনের দেয়ালের চিত্র, বৌদ্ধ ধর্ম এবং এই জং সম্পর্কে। লেকচার আমার তেমন কানে গেল না। গেলেও মনে রইল না। প্রকৃতির পর স্থাপত্য আকর্ষণ করলেও করতে পারে, অন্তত ইংলিশে ইতিহাস শোনার মুড ছিলনা। পেমা টাইগারের মতনই একজন গাইড, অন্য দুজন বাঙালি অতিথি নিয়ে এসেছে। যদিও পেমা বা টাইগার কারও সাথেই গাইড শব্দটা মানায় না। ওরা আমাদেরই দলের অংশ হয়ে উঠেছিল। যাই হোক এই জঙে ঢুকে উঠোন পার হয়ে মন্দিরের ভিতরেই শুধু দেখতে পেলাম, তাও ভালো করে নয়, কারণ সবকিছুই বন্ধ হয়ে গেছিল। টাইগার বলল সব জঙই একরকম! পুনাখা গিয়ে ভালো করে দেখব আমরা। এখানে নাকি নভেম্বরে Tsechu fest হয় যার mask dance বিখ্যাত। টাইগার একথা বলার পর আবার আমার এই নাচ দেখতে মন চাইল। কিন্তু এখন সেই সময় না!

Gangteng Monastery

খুশি খুশি মনে জং থেকে নিচে নেমে এলাম যেখানে আর পাইন বন নেই। বলা চলে এই আধা সমতল জায়গা থেকে হুট করে বড় গাছগুলো উধাও হয়ে গেছে। গাঢ় সবুজ বা কোথাও হলুদ সবুজ মিলিয়ে আর একটা চিকন ফিতার মত নদী নিয়ে এই ফোবজি উপত্যকা। তো এই উপত্যকার প্রস্থের মাঝখানে সন্ধ্যালগ্নে ফুটবল খেলার জন্য (!) টাইগার যখন গাড়ি থামাল তখন আরেক শিরশিরে অনুভূতি এসে ভর করল! এবার সেই একটু আগের ভেবে নেওয়া অনেকগুলো পাহাড় দিয়ে সমস্ত পৃথিবী থেকে আড়াল করা ওদের কোলের উপরের জায়গাটাতেই আমি। ফুটবল খেলব, কিন্তু ফুটবলই আনা হয়নি! টাইগার আগের রাত থেকে বলে বেড়াচ্ছে যে মেয়েরা আর ছেলেরা দু’দল হয়ে খেলবে। আমি বললাম- ফুটবল আনোনি তো কী হয়েছে? পাথর দিয়ে খেলা শুরু করো!

চারপাশের পাহাড়ের আশ্রয়ের এই খোলা জায়গাটা দিনের শেষ আলোয় আমাদের এত ভালো লেগে গেল যে আমাদের আর বলেকয়ে অনুরোধ করেও গাড়িতে উঠানো গেল না! কেউ লাফাচ্ছে, কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ নাচছে, কেউ পারলে এখানেই শীতের মধ্যে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছে! শেষ ব্যক্তিটাই আমি!

না, না ফোবজিখার গল্প এখনো শেষ হয়নি! সবে শুরু! সন্ধ্যের পর এই অজানা উপত্যকার অজানা গ্রামে অজানা এক বাড়িতে অজানা পরিবারের সাথে এক অজানা দৃশ্যের সদস্য হয়ে গেলাম আমি! দশখানা কাঠের সিড়ি বেয়ে উঠে বারান্দার মত জায়গাটা থেকে আধো আলোয় আমি কিছু ঠাহর করতে পারলাম না। দরজা দিয়ে ঢুকে একটা ঘর, যাকে আমাদের ভাষায় লিভিং রুম বলা চলে, ঘরের মাঝখানের উনুনের চারদিকে কার্পেট পাতা, উনুনও ঠিক বলা চলে না, ঘর গরম রাখার প্রাচীন ব্যবস্থা, জ্বালানী হিসেবে কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে কিন্তু আগুন দেখা যায় না, আর চিমনি হিসেবে একটা পাইপ। দুজন ‘আমা’ আমাদের ‘কুজোজাঙপো’ বলে অভিবাদন জানাল। হুট করে মনে হল আমি কয়েক শতক পিছিয়ে কোন পুরনো উপন্যাসের পাতায় হাঁটা শুরু করেছি। এই ঘরের চারপাশে পাঁচটা ঘর। নিজের ঘর পেয়ে জামাকাপড় বদলাবার আগেই নাজা পানের ডাক পরল। নাজা হল দুধ চা। টাইগার আমাদের পরিবেশন করল। সাথে আছে মুড়ি, বিস্কুট ও সেদ্ধ পমেটো। পটেটো কে পমেটো কেন বলছে জিজ্ঞেস করতেই পেমা জানালো পমেটো হল একটা সংকর জাতীয় উদ্ভিদ যাতে একই সাথে টমেটো এবং পটেটো ফলে। বুঝলাম না ঐ গাছের টমেটো কে কি তাহলে টটেটো বলবে? চা পান করার সময়ই ঠিক হল রাতের খাবারের জন্য আমি আলুভর্তা বানাব।

রান্নাঘর গরম রাখার কোন ব্যবস্থা নেই। টাইগার বারবার করে বলল বসার ঘরে বসে বানাতে। আমি অবশ্য রান্নাঘরেই বানাব ঠিক করলাম। পেমা আমাকে পেঁয়াজ কেটে দিল, লবণ দিয়ে দিল। টাইগার আমাকে মরিচ, তেল, কড়াই খুঁজে দিল। আমি আলুভর্তা বানাতে লেগে গেলাম।

দুজন ‘আমা’ অন্যান্য খাবার বানাচ্ছিল। তারা ইংলিশ, হিন্দি, বাংলা কোনটাই জানেনা। তাই কোন কথা জমল না।

আলুভর্তা বানিয়ে আমি বাকিদের সাথে উনু খেলায় যোগ দিলাম। এই প্রথমবার খেলা। টাইগার, পেমা, মাহি বহু চিটিং করছিল। টাইগারের মতে চিটিং ছাড়া উনু খেলা হয়না। এই উনু খেলতে গিয়েই মনে হয় আমার টাইগার আর পেমাকে ভীষণ ভালো লেগে গেল। চিল্লাপাল্লা- হইহল্লা। আমি পেমাকে দুএকবার মারলামও কার্ড লুকিয়ে ফেলার অপরাধে। ভুলভাল চারটা ভাষায় আমাদের উত্তেজিত কথোপকথন চলছিল- ইংলিশ, হিন্দি, বাংলা এবং ভুটানিজ।

রাতের খাবার খাওয়ার সময় আবার সেই উপন্যাসের দৃশ্যের অবতারণা হল। চাচিআম্মা গোছের একজন যাকে এতক্ষণ আমা বলে আসছি কারণ টাইগার তাকে এভাবেই সম্বোধন করছিল, সেই সবাইকে হিটারের পাশে বসে বিশাল পাত্র থেকে লালচালের ভাত বেড়ে দিল। আরও ছিল ডাল, কেওয়া দাতসি, গরুর মাংস, মুরগীর মাংস, মরিচের আচার এবং সর্বোপরি আমার বানানো আলুভর্তা।

এই অদ্ভুত দৃশ্যের আমি কি একজন সদস্য? নাকি দর্শক আমি জানিনা। কারণে বাস্তবে এমন দৃশ্য আমার স্মৃতিতে নেই। মা উপন্যাসের মা এসে সামোভার থেকে প্রাচীন বইয়ের হলদে হয়ে যাওয়া পুরানো বইয়ের কালো অক্ষরের অমলিন শান্ত গভীর সুবাস ছড়িয়ে দিল যেন।

খাওয়া শেষে “সুজা” পানের ব্যবস্থা। সুজাও এক ধরনের চা। চায়ের পর এক কাপ ঘরে বানানো ওয়াইন। টেস্ট ভালো কিন্তু কিন্তু তেজ বেশি এবং চেহারা সুন্দর না। টাইগার বলল অন্য কোথাও ওয়াইন খাওয়াবে।

তারপর আড্ডা ভেঙে যে যার ঘরে। মেঝেতে বিছানা পাতা। ভয়াবহ শীত। কিন্তু ওঘরে ভুটানিজ ভাষায় তখনো পারিবারিক আড্ডা চলছে আগুনের পাশে বসে। কোন কথাই বুঝা যাচ্ছে না কিন্তু সবই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

আমি শব্দে ঘুমাতে পারিনা। চিঠি লিখছিলাম। সেই চিঠির একটা অংশ এই লেখায় ব্যবহার করা হয়েছে। আগুনের পাশে পারিবারিক মিষ্টি কোলাহল থেমে যাবার পর অদ্ভুত উপন্যাসের পাতায় আমি ঘুমিয়ে গেলাম।

ঘুম ভাঙল খুব শীত শীত সকালে। গত সন্ধ্যায় ঠান্ডার জন্য আর নিচে যাওয়া হয়নি। সকালবেলা জানালা খুলতেই মনের ভিতর এক পাহাড় শান্তি ভিড় করল। একপাশে বন, সামনে সবজি ক্ষেত, তারপর সবুজ ঘাসেদের ভিড়, তারপর পাহাড়। একটা শাল জড়িয়ে বের হলাম। সবজি ক্ষেত পার হয়ে পাথরের বেড়ার পর একটা গোলাপী ফুলের রাজ্যে পৌঁছে গেলাম। একপাশে আলোর ঝলক অন্যপাশে পাহাড় ও মেঘের ছায়া। আর সামনে যে ছোট পাহাড়টা সম্ভাষণের জন্য ঠিক এই উপত্যকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে তার উপরেই Gangteng Monastery. হালকা শীতের সকালবেলায় আমার মনে হল এই অচেনা উপত্যকায় কিছুদিন থাকলেই আমার রাগ টাগ সব উবে যাবে। এই প্রকৃতি সব ঋনাত্মকতা শুষে নেবে।

ফিরে আসতেই আবারো নাজা পানের আমন্ত্রণ। হিটারের উপর থেকে চায়ের পাত্র নামিয়ে কাপে ঢেলে দেয়া তরল আদর। হিটারের পাশে এই মাঝবয়সী “আমা”র কার্যক্রম বরাবর আমাকে হলুদ পুরানো উপন্যাসের পাতায় ঠেলে দিচ্ছে। যদিও আমি দুধ চা পছন্দ করিনা তারপরও পরপর দুকাপ চা শেষ করেও আমার হিটারের উষ্ণতা আর এই দৃশ্য থেকে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। হঠাৎ একজন অতি বৃদ্ধা গুটিগুটি পায়ে মুখে শত ভাজের আনন্দ নিয়ে নাজা পান করতে এই দৃশ্যে প্রবেশ করল। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তিনি এত সুন্দর কেন? ওনি চায়ের কাপ ধরলেন দুহাতে, একহাতে নয়, অঞ্জলি নেবার মত করে। এবং সারাক্ষণ হাসছেন। যেন গভীর আনন্দের পুকুর থেকে মাত্রই স্নান শেষ করে এই দৃশ্যে চমক দিতে এলেন!

কিরা এমন একটা পোশাক দেখতে অতি সাধারণ মনে হলেও দু’বার দু’জন পরিয়ে দেয়ার পরও দেখা গেল কীসব ভুলভাল রয়ে গেছে যা আমি নিজেও জানিনা। গাড়িতে ব্যাগ রাখতে যেতেই টাইগার এবং পেমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনতে পেলাম। আমাকে এই পোশাকে দেখে তারা খুবই খুশি। আমি কৃত্রিম আহ্লাদ-বেজার হয়ে বললাম- দেখো এই জিনিস আমি ঠিকমতো পরতে পারিনি। টাইগার বলল- দু’জন আন্টি আছেনা? তাদের বলো পরিয়ে দিতে। আমা আমাকে সুন্দর করে পরিয়ে দিলেন। সাথে জঙ্ক্ষা ভাষায় নরম সুরের কিচিরমিচির যার কিছু আমি বুঝলাম না। নিচে নামার পর দ্বিতীয় আমা এসে আবার আমার পোশাক ঠিকঠাক করে দিলেন। গায়ের রঙ সবুজ না হলেও পোশাকের রঙ সবুজ নিয়ে ফোবজিখা থেকে পুনাখার দিকে যাত্রা শুরু হল। পৃথিবী থেকে আদরে আড়াল করা এই পাহাড়ের কোলের ভিতর থেকে বের হয়ে নতুন আশ্রয়ে নিয়ে না গেলেও আমি কিছু মনে নিতাম না। সাত দিন এই ইয়াংকা ফার্ম হাউজে আমাকে ইংরেজি না জানা চাচিআম্মাদের সাথে থাকতে বললেও আমার খুব কষ্ট হতো বলে মনে হয় না। আবার সেই পাইন বন, নিচে সবুজের মাঝে সরু নদী, আবার সেই গায়ের রঙ সবুজ হবার শিরশিরে অনুভূতির এক দিনের চেনা আত্মীয়, আবার সেই উড়ে এসে জুড়ে বসা আমরা নতুন গন্তব্যের দিকে; অথচ আমার কোন গন্তব্য দরকার নেই!

--

--