ড্রাগনের দেশেঃ থিম্পু

Afsana Jeba
tripsharebd
Published in
7 min readNov 5, 2018

ভুটান দেশটা আমাদের উত্তরে, দক্ষিণে, না কোথায় সে সম্পর্কে আমার খুব একটা সঠিক ধারণা ছিলনা যেমনটা ছিল ইন্ডিয়া, নেপাল বা মায়ানমার সম্পর্কে। ভুটান সম্পর্কে আমার প্রথম ইম্প্রেশনও ছিল খুব অদ্ভুত- ভুটানিজ পোশাক! ছোটবেলায় কোন এক সার্ক সম্মেলনে ভুটানের রাজার পোশাক দেখে আমি ভাবছিলাম- এ কেমন পোশাক! একটা সুন্দর আলখেল্লা, বড় মোজা, কিন্তু দুটোই হাঁটুর কাছাকাছি এসে দাঁড়ি চিহ্নের মত থেমে গেছে! এবং অদ্ভুতভাবে শুধু পায়ের ঐ অংশটুকুই দৃশ্যমান যেন জামাটা ছোট হয়ে গেছে!

জয়গাঁ-ফুন্টশলিং বর্ডারে মনোরম কারুকাজ করা ভুটানে প্রবেশের সুন্দর গেট। সেই গেটে আমাদের নাম-ঠিকানা জানার জন্য বা ব্যাগ চেক করার জন্য কেউ আটকাল না। গেট পাড় হয়ে দুকদম হাঁটতেই দেখলাম রাস্তার উল্টোদিকে টাইগার দাঁড়িয়ে। টাইগার আমাদের ভুটানিজ গাইড। জিজ্ঞেস করলাম- Waiting for us so long? -No! Just for two minutes only! আসলে ঘটনা তা না, আধঘন্টা আগেও যখন আমি ফোন করেছি তখন সে বলেছে চিন্তার কিছু নেই, সে আছে।

ভুটান গেট, ফুন্টশলিং

ইমিগ্রেশন অফিসের সামনে ছোট্ট খোলা জায়গা। খুব সাধারণ একটা ফর্ম পূরণ করতে হল আমাদের। টাইগার হঠাৎ বলল- Jeba, you need the hotel booking photocopies? I can help you. সে এত সুন্দর করে আমার নাম উচ্চারণ করল যে জগতের যাবতীয় যত লোক আমার নাম ভুল উচ্চারণ করেছে তাদের একবার করে শোনাতে ইচ্ছে করল! আচ্ছা আগেই বলে রাখি আমি যত বেশি ভুটানের কথা বলব তত বেশি বেশি টাইগারের কথা বলব। কারণ লেখা শেষ হলেই বুঝা যাবে! যাই হোক, সাত দিনের পারমিশন পেতে আমাদের কোন হাতি-ঘোড়া কিছু করতে হলনা। সিম কিনে এরপর থিম্পুর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।

চারদিকে পাহাড় পাহাড় পাহাড়, সবুজ সবুজ সবুজ, দিনের আলো বিদায় নিচ্ছে নিচ্ছে, দূরে নিচে দেখা যাচ্ছে তোরশা নদী সাদা ধোয়ার মত; এখানে সেখানে ফলের পসরা নিয়ে বসে আছে গ্রামের মেয়েরা, টাইগারের মোবাইলে বাজছে আমাদের জন্য বাংলা গান! তার মধ্যে আমার একটা প্রিয় গানও মিলে গেল- হয়তো তোমারই জন্য! পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলছি তো চলছি আর দুচোখ ভরে চারপাশের প্রকৃতি গিলছি। সন্ধ্যা প্রায়, তখন মনে হল আমরা দুপুরের খাবারই খাইনি! টাইগারকে বলতেই বলল- you’re asking about lunch? It’s almost six! কোন এক পথের ধারের রেঁস্তোরায় খেয়ে, শীতের কাপড় পরে আমাদের আবার যাত্রা শুরু।

অন্ধকার পাহাড় দেখতে দেখতে যখন হঠাৎ টুপটাপ আলোর দেখা মিলল তখন বুঝলাম থিম্পুর কাছাকাছি চলে এসেছি। খুব উপরে জ্বলজ্বল করা একটা বুদ্ধের মাথা দেখে মনে হল এ নিশ্চয়ই সেই মূর্তিটা! হোটেলে পৌঁছে রীতিমত হা! শহরটা দেখা যাচ্ছে, ছোট ছোট আলোর বিন্দু দিয়ে তৈরি। উল্টোদিকের পাহাড়ে বুদ্ধের সেই মূর্তিটাও দেখা যাচ্ছে। নিচের শহরের দৃশ্য এতই মন কাড়ল যে এই দৃশ্য দেখতে দেখতেই দু’তিন ঘন্টা চলে গেল।

রাতের থিম্পু

পরদিন খুব সকালে উঠে চারপাশ হেঁটে এলাম। অচেনা ফলের গাছ, পেমা ইউসেলিং ভিলার নিচের তলাগুলোর পাশের সাজানো টেরাস- শুকাতে দেয়া মরিচ-বেগুণ, চা পানের সুন্দর জায়গা, পাশের কোথাও নির্মাণরত ভবন এবং সর্বোপরি উপর থেকে দিনের থিম্পু শহর আর উল্টোদিকে ঠায় বসে থাকা বুদ্ধ দরদেনমা।

প্রথম গন্তব্য ইমিগ্রেশন অফিস, পুনাখা যাবার পারমিশনের জন্য। টাইগার কাজ সারতে সারতে আমরা রাস্তার পাশের দোকানগুলো ঘুরছিলাম। সেখানে দেখা হল খুব ছোট একটা বাচ্চার সাথে। বয়স এক বছরও হবেনা। এত সুন্দর। বাচ্চা মালিহার কথা মনে পরে গেল। ওকে নিয়ে সময় কাটাতেই ডাক পরল। দ্বিতীয় গন্তব্য মেমোরিয়াল চর্টেন (Memorial Chorten), তবে আমরা কেউ ভিতরে ঢুকলাম না। এই জিনিস তৃতীয় ড্রাগন রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুকের (Jigme Dorji Wangchuk) সম্মানে বানানো হয়। ভুটান শব্দের অর্থ ড্রাগন, তাই রাজারা ড্রাগন রাজা! সাধারণ মানুষ নিজেদের Druk people বলতে ভালোবাসে। কেন এত ড্রাগনের ছড়াছড়ি আমি স্পষ্ট জানিনা। এই মুহূর্তে জানতে ইচ্ছেও করছেনা।

আসলে আমাদের প্রথম গন্তব্য বলা চলে Buddha Dordenma, কারণ এই জায়গাটাই ভালোমত ঘুরে দেখা হল। হোটেল থেকে যতটা ছোট দেখতে লাগছিল কাছ থেকে ততগুণ বড় দেখা যাচ্ছিল যে কোথায় দাঁড়ালে সম্পূর্ণটা ক্যামেরার ফ্রেমে আটানো যাবে এই নিয়ে দ্বিধা দেখা দিল। ১৭৭ ফিট উঁচু এই মূর্তিটা নাকি আবার ৮ ইঞ্চির ছোট ছোট এক লাখেরও বেশি বুদ্ধ মূর্তি দিয়ে ভর্তি করা হয়েছে। কী অদ্ভুত! সামনের প্রশস্ত জায়গাটা থেকে পুরো শহরটা দেখা যায়, এবং পুরো শহর থেকেই এই বজ্রের বুদ্ধকে দেখা যায়। খুব রোদে তিষ্টোতে না পেরে মন্দিরের ভিতরে গেলাম। ভিতরে নাকি আরও প্রায় ২৫ হাজার ছোট বু্দ্ধ আছে। সত্যি কথা বলতে ছোটগুলো দেখতেই বেশি ভালো লাগছিল এবং ইচ্ছে করছিল দু’একটা পকেটে করে নিয়ে আসি! অদ্ভুত অজানা দেয়ালচিত্র, ধর্মপ্রাণদের আরতি ও ধ্যান সব মিলিয়ে ভিতরে একটা মোহময় ঠান্ডা পরিবেশ। ভিতরের কলামগুলোকে প্রার্থনার জন্য রাখা বুদ্ধকে দেখার একটা বাঁধা মনে হল। দেয়ালে সাজানো ছোট বুদ্ধ আর দেয়ালচিত্র দেখতে ভালো লাগছিল।

Buddha Dordenma

এই পর্ব শেষ করে আবার গাড়িতে। কোথায় যাব জানিনা। টাইগার কিছু বলল না। একসময় রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে বলল- এটা থিম্পুর সবচে’ পুরানো মন্দির। সেই বারো শতকে বানানো! মন্দিরটা প্রধানত বাচ্চাদের জন্য। বাচ্চাদের নাম দেয়ার জন্য বা শুভকামনার জন্য বাবা-মায়েরা এখানে আসে। যাও ঘুরে আসো। বামদিক দিয়ে যাবে, ডানদিক দিয়ে আসবে!

কতক সিড়ি ভাঙার পর চোখের লেভেলে চাঙগাঙখা মন্দিরের (Changangkha Lhakhang) দেখা মিলল। পাথরের রেলিঙে চুপ করে বসে রইলাম। দুজন বৃদ্ধ চুপচাপ বসে আছেন, একটা মা তার বাচ্চাকে প্রার্থনা চাকা ঘুরানো শিখাচ্ছে। একজন অতি বৃদ্ধ উঠে আসলেন, এক হাতে প্রেয়ার হুইল, অন্য হাতে আমার অজানা কিছু একটা, ঠাসাঠাসি অনেক জামাকাপড় গায়ে; তাকে কেন জানিনা আমার খুব ভালো লাগল! তিনি ভিতরে ঢুকে গেলেন। এইখানে বসে থেকে আমার খুব শান্তি শান্তি লাগছিল। মূল মন্দিরের ভিতরে ঢুকলাম না। পেছনের উঠানে গিয়ে আবার চুপচাপ বসে রইলাম। সেখান থেকে শহরের একটা অংশ দেখা যায়।

Changangkha Lhakhang

ফুটবল রেঁস্তোরায় দুপুরের খাবার খেতে খেতে টাইগার বলল- You’re sad! Actually I was sad. But I replied- My eyes are hurting! It was true though! He asked the reason and I gave my very ready answer- Don’t know. খাওয়া শেষে পার্কিঙে যেতে যেতে টাইগার মাসাফির সাথে গল্প করছিল। হঠাৎ পেছন ফিরে আমাকে বলল- Come with me. তারপর ফুটপাত ছেড়ে একটা করিডরে ঢুকে গেল- You see the lady in white apron? Just go and ask her to give medicine for your eyes! আমি তো হা, এই সামান্য কাজে আবার ওষুধ? -Is she a doctor? -No. But she may help you. গেলাম। ওনি বেশ কিছু প্রশ্ন করে একটা ড্রপ ধরিয়ে দিল। রাস্তায় আসতে টাইগার জিজ্ঞেস করল- You know the song sundori komola? -What? (তার মুখে সুন্দরী কমলা শব্দটা আমি বুঝতে পারলাম না!) -The song? Sundori komola! -Oh you like this song? খুবই অবাক হলাম। তাই বলে এই পুরানা বাংলা লোকগীতিও সে শুনেছে? কতশত বাঙালী গেস্ট ছিল তার?

ছিমছাম পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চলছিল, একপাশে পাহাড়, একপাশে শহর। পৌঁছলাম Tashichho Dzong viewpoint এ। হলুদাভ সবুজ পাহাড়ি ধানক্ষেত পেরিয়ে দূরে সেই জং বা monastery. জঙের পাশে ভুটানের Assembly Building, মাঝখানে ওয়াং চু বা থিম্পু নদী। ভুটান সরকারের অধিকাংশ কার্যকলাপ এই জঙে হয়। স্থাপত্য দেখার চাইতে ডান থেকে বায়ে ২৭০ ডিগ্রি সম্পূর্ন দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগছিল। হলুদাভ সবুজ ধানক্ষেত স্তরে স্তরে নেমে গেছে, নদীটা উকিঁ দিচ্ছে কোথাও কোথাও, তারপর একগুচ্ছ চার পাঁচতলা বাড়ি, বামে লাল ছাদের কিছু একটা বড় জায়গা জুড়ে, ডানে জং, পটভূমিতে পাহাড়! দিনের রোদ শেষ হয়ে শীত শীত লাগছিল, পাশে ভ্রমণসঙ্গীদের ছবি তোলার কিচির মিচির। মনে হচ্ছিল এই রাইস টেরাসের মধ্য দিয়ে একটা দৌড় দেই, নদী পর্যন্ত চলে যাই।

টাশিচো জং

না, আমাকে দৌড়ে নদী পর্যন্ত যেতে হল না। Changlimithang stadium দেখা শেষে গেলাম উল্টোদিকের পার্কে। তার পাশেই নদী। পার্কে ঢুকতেই একজন সোনালী বুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন সম্ভাষনের জন্য। বড় বড় কাটা ঝোপে নীল ফুল। অচেনা সেই ফুলের সাথে কথোপকথন শেষে নদী- মৃদু অথচ দৃঢ় অস্তিত্ব জানিয়ে বয়ে যাচ্ছে, আমি শীতে শাল জড়াচ্ছি। সবাই শরীরচর্চার সরঞ্জাম নিয়ে লেগে গেল! একটা পাথরের উপর বসে নদী দেখছিলাম আর ঠান্ডার অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছিলাম। বুঝলাম না সারাদিন এত রোদের পর এই শীত কোথা থেকে আমার গায়ের উপর ঝাপিয়ে পরল!

এরপর গন্তব্য মার্কেট। টুপ করে সন্ধ্যা নেমে গেল কোথা দিয়ে টের পাওয়া গেলনা। টাইগার জানাল যে আজ সংসদ নির্বাচনের দু’দলের মধ্যে ডিবেট হবে, তার এই ডিবেট দেখতেই হবে, সে দেড় দু’ঘন্টা না থাকলে আমরা মন খারাপ করব কিনা! আমরা ভাবলাম দেড় দুঘণ্টা আশপাশ ঘুরে এবং দোকানপাট দেখেই কাটানো যাবে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল পরবর্তী এক ঘন্টা এখানে ওখানে হাঁটতে হাঁটতে আমরা আবিষ্কার করলাম চোখের সামনের প্রত্যেকটা ভুটানিজই দুই নেতার ডিবেট দেখছে, প্রত্যেক দোকানেই টিভি চলছে, না চললেও পাশের দোকানে গিয়ে দেখছে। এর মাঝেই আমি কিরা কিনার জন্য বায়না ধরলাম। কিরা ভুটানিজ মেয়েদের পোশাক। দাম শুনে একটু দমে গেলাম। মনে হয় থিম্পুকে ইন্ডিয়ার জয়পুর ভেবে বসেছিলাম! এক দোকানে কানটুপি কিনার পর আন্টিগোছের একজনকে বললাম- তোমাদের পোশাকের এত দাম যে আমি কিনতে পারছি না! সে হাসতে হাসতে বলল- তুমি আমাদের পোশাক পরবে নাকি? তাহলে শোনো নিচতলার ডানপাশের দোকানটায় যাও! গিয়ে বলো দেখো আমি তোমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরব, আমাকে ডিসকাউন্ট দিতেই হবে! আর কেন দিবেনা বলো? দিতেই হবে। তুমি শুধু গিয়ে বলো।

সত্যি সত্যি তার কথামত ঐ দোকানে গিয়ে একটা সবুজ রঙের কিরা কিনে খুশি হয়ে গেলাম!

টাইগার আসার পর আমরা গেলাম sangaygang viewpoint থেকে রাতের থিম্পুর আলোকমালা দেখতে। হোটেল থেকে দেখা আর এখান থেকে দেখার পার্থক্য হচ্ছে এখান থেকে প্রায় পুরো শহরটাই দেখা যায় এবং চেনা যায়। তাশিচো জং, মেমোরিয়াল চর্টেন, স্টেডিয়াম, চাঙগাঙখা মন্দির সব খুঁজে খুঁজে বের করলাম। তারপর টাইগার এসে বলল- না, তুমি চাঙগাঙখা আর মেমোরিয়াল স্তূপ উল্টাপাল্টা করে বলছ!!

Thimpu from Sangaygang viewpoint
Tashichho Dzong at night

--

--