নতুন উচ্চতায় | সান্দাকফু ট্রেক | দিন ১
মানেভঞ্জন ১৯২৮মি. — চিত্রে ২৪০০মি.
১৯ অক্টোবর, মানেভঞ্জন, উচ্চতা - ১৯২৮ মিটার
গাড়ী থেকে নামতেই গা কাঁপুনি দিয়ে উঠল। একদিকে ঠাণ্ডা অন্যদিকে হিমশীতল বাতাস বেশ জোরেই বইছিল। তাড়াতাড়ি গায়ে থাকা কাপড়ের উপর শীতের কাপড় পড়ে নিলাম। ঘড়িতে তখন বাজে দুপুর ২টা। তবে মেঘ আর কুয়াশার জন্য এইখানটায় সুর্যের দেখা নেই। লোকজনের বেশ ভালই সমাগম, আর অনেকগুলো ১৯৫০ মডেলের জিপও আছে সারিতে দার করানো। এগুলো দিয়ে সরাসরি সান্দাকফু-ফালুট যাওয়া যায়।
অনেক ক্ষুধা পেয়েছিল, তাই একজনকে জিজ্ঞেস করে একটা খাবার জায়গা খুঁজে পেলাম। এই পাহাড়ি এলাকায় সবচেয়ে পরিচিত এবং সহজলভ্য খাবার হচ্ছে চাওমিন এবং মম। আমরা চাওমিন অর্ডার করলাম। সামনেই আটা দিয়ে চাওমিন বানিয়ে, রান্না করে গরম গরম সার্ভ করা হল। ঠাণ্ডায় ধোয়া ওঠা চাওমিন একদম অমৃত লাগছিল। খাওয়া দাওয়ার পালা শেষ করে এবার গাইড নিতে হবে।
গাইডের খোঁজে একটু এগিয়ে গিয়ে একটা ইন্সটিটিউশন পেলাম যেখান থেকে গাইড নেয়া যায়। সেখানের দায়িত্বরত একজন ছিলেন, যিনি বেশ ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। চুলে স্টাইলিশ জট যার দুইপাশের সামনের দিকে আবার ব্লন্ড করা। তো উনি একটু একটু বাংলা আর ইংলিশ, হিন্দি, নেপালি ভালই বলেন। আমরাও আমাদের প্লান বললাম বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি মিলিয়ে মিশিয়ে। সাধারণত মানুষজন সকালের দিকে ট্রেক করে মানেভঞ্জন থেকে তুমলিং বা টংলু গিয়ে থাকে। কিন্তু অলরেডি ২:৩০ বাজার কারণে আমাদের প্লান ছিল দিনের মধ্যেই মানেভঞ্জন হতে ২ কিমি দূরে চিত্রে গ্রাম এ গিয়ে থাকা।
তো প্লান প্রোগ্রাম বলার পর, আমাদের গাইড এল। নাম - পূর্বা শেরপা। ১২ গ্রেড এর স্টুডেন্ড। পিক সিজনে পকেট মানির জন্য পার্ট টাইম গাইড এর কাজ করে। কম বয়সী এবং বেশ চালু। গাইড আসার পর আমরা যে কয়দিনের জন্য যাব, সেই কয়দিনের জন্য দিনের জন্য দিনপ্রতি ১০০০ রুপি হিসেব করে পুরো টাকাটাই পে করতে হবে । আমাদের প্লান এ অপশনাল হিসেবে বলেছিলাম যে শরীর ভাল লাগলে সান্দাকফু এর ৫ দিনের প্লান এর পর ফালুট-গোরখে হয়ে আমরা নিচে নামবো, সেক্ষেত্রে গাইডের হাতেই এক্সট্রা টাকাটা দিয়ে দিলেই চলবে। আর কেবল সান্দাকফুতে গিয়ে গাইডকে থাকা-খাওয়া বাবদ ৩০০ রুপি দিতে হয়। আর কোন খরচ দেয়া লাগে না। পরে জানতে পেরেছি যে এই দিনপ্রতি ১০০০ রুপির মধ্যে গাইড পায় ৯০০ রুপি, আর বাকিটা ইন্সটিটিউশন।
তো গাইড ঠিক হবার পর নির্ধারিত অফিসে গিয়ে পাসপোর্ট এর ফটোকপি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করলাম। তারপর আমরা দোকান থেকে পানি, চকলেট, বিস্কিট কিনলাম আর আমাদের গাইড (পুর্বা) তার ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে এল।
সান্দাকফু ট্রেকের একটা বড় অংশ পড়েছে সিংগালিলা ন্যাশনাল পার্কে । যাত্রার শুরুতেই এই ফরেস্ট এর একটা অফিস যেখান থেকে নাম রেজিস্ট্রি করিয়ে ২০০ রুপি করে টিকিট নিতে হয়। টিকিট অফিসের অফিসার তালা লাগিয়ে চলে যাচ্ছিলেন যেহেতু এই সময় সাধারনত কেউ ট্রেক শুরু করে না। কিন্তু আমরা বলায় আবার অফিস খুলে রেজিস্ট্রি করে দিলেন, বিনিময়ে ১০০ রুপি হস্তগত করলেন। এবার শুরু হল যাত্রা, সেই বহু কাঙ্ক্ষিত সান্দাকফু ট্রেক!!!
মানেভঞ্জন থেকে চিত্রে দুই কিলোমিটার পথ, খুবই খাড়া এবং অনেকটা অংশ পিচঢালা এবং বেশ কিছু অংশ পাথুড়ে রাস্তা। আমরা ম্যাপ দেখে জেনেছিলাম যে, পুরো ট্রেক এ সবচেয়ে খাড়া রাস্তা এটা! প্রথমে পাইন ফরেস্ট এর মধ্য দিয়ে রাস্তা গেছে। বিশাল বিশাল পাইন গাছ এর সারি নিচ থেকে অনেক উপরে উঠে গেছে রাস্তার দুই পাশেই। বেঝাই যায় যে সুর্য একদম মাথার উপরে না থাকলে এখানে সুর্যের আলো পৌছাবার খুব একটা সুযোগ নেই।
ট্রেক শুরু করার কিছুক্ষণ পড়েই একটু আগেই পড়া শীতের কাপড়গুলো খুলে ফেলা লাগলো ঘেমে উঠার কারণে। খানিক বাদে শরীর একটু ঠাণ্ডা হতেই আবার পড়েও ফেলতে হল।
ট্রেক এ বেশ কিছু শর্টকাট রাস্তা আছে যেগুলো হয়তো মাটির নয়তো পাথরের সিড়ীর। এই পাথরের সিঁড়ীগুলো হচ্ছে সবচেয়ে কষ্টদায়ক। হাঁটুর বারোটা বেজে যায় এই খাড়া সিঁড়িগুলো বেয়ে উপরে উঠতে।
একটু সময় একটা শর্টকাট দিয়ে যাবার সময় চোখে পড়ল কয়েকটা বড় বড় পাথরে কিছু প্রেয়ার লিখা আছে আর বিভিন্ন রঙের পতাকা টানানো আছে। এইগুলো প্রেয়ার ফ্ল্যাগ যা এশিয়ান রিজিওনে পাহাড় পর্বতে অবস্থিত বৌদ্ধ ধর্মানুসারিরা লাগিয়ে থাকে। গাড়ী, বাড়ী, মন্দির, রাস্তায় খুব কমন এই পতাকাগুলো।
এই মেঘ-কুয়াশা-বন এর মাঝে হাঁটতে হাঁটতে পাঁচটা বাজার একটু আগে আমরা চিত্রে পৌছাই। চারিদিকে মেঘ এবং কুয়াশার কারণে একদম অন্ধকার, একটু দূরের কিছুও দেখা যায় না। আর ঠাণ্ডা বাতাসে তো হাঁড় জমে যাবার উপক্রম। তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়লাম একটা ঘরে। এইটা মূলত একটা হোমস্টে যার নাম Hawk’s Nest । এখানে গরম চা খেয়ে একটু চাঙ্গা হলাম। তবে জানা গেল যে এখানে কোথাও থাকার জায়গা নেই, এক গ্রুপ একসাথে ২০ জন আসায় সব বুকড। বাইরে টেন্ট করেও বেশ কিছু মানুষ থাকার ব্যাবস্থা করে নিয়েছে। আমাদের আরেকটু উপরে যেতে হবে থাকার জায়গার জন্য।
এই ঠাণ্ডায় বের হতে ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু কিছু করার নেই। এমনিতেই অন্ধকার, তার উপর সন্ধ্যার আগেই থাকার ব্যাবস্থা না করতে পারলে বিপদ। তাই খুব বেশিক্ষণ বসে না থেকে বের হলাম। আরও প্রায় আধা/এক কিলোমিটার উঁচুতে উঠলাম এই ঘন কুয়াশার মধ্যে। উপরে উঠে বাতাস যেন দিগুণ বেগে বইতে শুরু করল। তাড়াতারি View Point Homestay তে ঢুকে সরাসরি রান্না ঘরে চলে গেলাম। আগুনের কাছে খানিকক্ষণ বসে আরাম পাওয়া গেল কিছুটা। এই জায়গার একদম পাশেই SSB (Sashastra Seema Bal) এর ক্যাম্প আছে। যখন এদের ক্যাম্প ছিলনা, তখন এই জায়গাতেই এরা সবাই থাকতো। এখন আলাদা ক্যাম্প করার পরে এটি Homestay এর জন্য ওপেন হয়েছে।
রান্নাঘরের একপাশে চুলা অন্য পাশে বসার জায়গা । চুলার কাছেই উপরে ঝুলানো লোকাল পনির যা দেখে প্রথমে ভুট্টা ভেবেছিলাম। তো সেখানে বসে আমরা তাদের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করলাম, দাদা দিদি খুবই আন্তরিক মানুষ। দাদা বেশ ভালই বাংলা জানেন এবং দিদি মূলত ইংরেজিতে আমাদের সাথে টুকটাক কথা বললেন। পরিচয় হোল উনাদের ১৪ বছর বয়সী কুকুর Foo এর সাথে। আমাদের একজন একজনের সামনে গিয়ে একটু মাথায় হাট বুলিয়ে দেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল!
কথার মাঝে জানতে পারলাম যে আমরা তাদের তৃতীয় গেস্ট! চিত্রে তে ট্রেকাররা তেমন একটা থাকার জন্য থামে না, আর উনারাও নতুন করেছেন থাকার ব্যাবস্থা। বছরের এই সময়টার আবহাওয়া ভাল থাকে, কিন্তু এইবছর আবহাওয়া একটু আগেই খারাপ হয়েছে জানতে পারলাম দিদির কাছ থেকে। তারপর রুম দেখালেন, দেখে ভালই লাগল, দুইটা বেড আর সবার জন্য আলাদা লেপ ও কম্বল। রুমের বাইরেই দুটো বাথরুম।
একটু পরে দিদি আমাদের একটা লোকাল ড্রিঙ্ক এর কথা বললেন, নাম টংবা(Tongba) — ফার্মেণ্টেড বাজরা/যব (Millet, অনেকটাই গমের মতন) আর সাথে গরম পানি দিয়ে তৈরি করা হয়, বাশ এর জার এ সার্ভ করা হয়। টেস্ট করার জন্য একটা নিলাম, গরম পানি ঢেলে কিছুক্ষণ রেখে তারপর খেতে হয়, পানি শেষ হয়ে গেলে আবার একই প্রসেস। শরীরটা খানিক গরম হল টংবা খেয়ে। তারপর রুমে গিয়ে প্রায় দুইদিন পর নরম বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম।
চোখ লেগে এসেছিল প্রায়, রাত ৮টার দিকে ডাক এল যে রাতের খাবার রেডি। সবজি-ভাত-ডাল এই হচ্ছে মেনু। সাথে একটা খুবই কড়া টেস্ট ওয়ালা চাটনি দেয়া হয় পাহাড়ের প্রায় সবখানেই, ভাল খারাপ দুই রকম টেস্টই লাগে জিসিটা, আজব! ট্রেক করে ক্ষুধা বেশ ভালই লেগেছিল, তাই পেট ভরে খেয়ে নিলাম।
পাহাড়ে সন্ধ্যার পর আসলে করার মতন কিছুই নেই, তাই সবাই তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আমরাও খাওয়া দাওয়ার পর, গায়ে আরেক লেয়ার কাপড় জড়িয়ে, কম্বল + লেপ এর নিচে ঢুকে গেলাম। আর আগামীকালের আবহাওয়া একটু ভাল থাকবে এই আশায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টের পেলাম না …