নতুন উচ্চতায় | সান্দাকফু ট্রেক | দিন ২

চিত্রে — লামে ধুরা — মেঘমা — তুমলিং

Nowshad
tripsharebd
9 min readOct 29, 2018

--

২০ অক্টোবর
২৪০০ মি. → ২৯৭০ মি.

চিত্রে

ঘুম ভাঙ্গল ভোর ৬ টায়, কোনমতে কাঁপতে কাঁপতে উঠে বাইরে গেলাম। বাইরে তখনো ঘন কুয়াশার কারণে অল্প আলো, যদিও সময় অনুযায়ী সুর্যোদয় হয়ে যাবার কথা। শরীর গরম করার জন্য একটু এক্সারসাইজ করে নিলাম। দলের বাকিরাও একে একে উঠতে শুরু করেছে। আর সূর্য মামাও একটু একটু করে মেঘের কোল থেকে ছাড়া পাচ্ছে। সূর্যের আলোয় যেন চারিদিকের সবুজ পাহাড় গুলো হেসে উঠল। এই দৃশ্যের সাথে এককাপ চা না হলে চলেই না, তাই বোধহয় দিদি আমাদের চা দিয়ে গেলেন।

গতকাল কুয়াশায় ঢাকা থাকার কারণে চারিদিকটা ভাল করে দেখতে পারিনি, আজ বেশ ভালই দেখা যাচ্ছে। ঘরের উঠান পেরুলেই হরেক রকম ফুলের বাগান। তার সামনে কিছু শাক-সবজিও চাষ করা হয়েছে। দাদার সাথে কথা বলে জানলাম যে বেশ কিছু সবজি তারাই ফ্রেশ খাবার জন্য চাষ করে, আর বাকিসব মানেভঞ্জন থেকে কিনে আনতে হয়। আর খাবার পানি প্রাকৃতিক ঝিরি থেকে সংগ্রহ করা হয়।

আমরা সবাই একটু আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখার জন্য বের হলাম। দিদি বললেন এখানে একটা বৌদ্ধ মনেস্ট্রি আছে, কাল নিচে যেখানে চা খেয়েছিলাম সেটার কাছেই।

বাড়ির ঠিক সামনেই একটা ছোট্ট পুকুর এর মতন। সেটা রেখে একটু আগালেই কিছু প্রেয়ার ফ্ল্যাগ টানানো আছে।

এই অংশটা পেরিয়ে একটু উঁচুতে উঠলেই একটা স্তম্ভ এর মতন পাশে একটা দেয়ালে বিভিন্ন রঙে অনেক কিছু লিখা, তবে যে ভাষায় লিখা সেটা পড়ার দক্ষতা আমাদের নেই।

একটু সময়ের জন্য মেঘের উপর দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা উকি দিল। জীবনে প্রথমবারের মতন এই দৃশ্য দেখর অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মত না। আমরা নিচে নেমে এলাম Hawk’s Nest এর সাথেই রাস্তা ধরে একটু নিচে নামতেই পেয়ে গেলাম বৌদ্ধ মনেস্ট্রি। বেশ সাজানো গোছানো মনেস্ট্রি, মানুষজনের ভিড়ও নেই। সেখানের ভিক্ষুরা (monk) তাদের প্রার্থনা করার হল গোছানোতে ব্যস্ত। জিজ্ঞেস করে জানলাম বাইরে থেকে বড় একজন ভিক্ষু আসবেন বলেই এত প্রস্তুতি। এখানেও একটা পাথরের দেয়ালে বিভিন্ন রঙে কিছু একটা লিখা আছে দেখলাম।

হল রুমে ঢোকার পথে দেয়ালে কিছু প্রেয়ার হুইল লাগানো যেগুলো হাত দিয়ে ঘোরানো হয়। বিভিন্ন রকম লিখা সেগুলোর গায়ে। আমরাও একটু ঘুরিয়ে দেখলাম। এখানে একটা ভাল জিনিস হচ্ছে কেউ ছবি তুলতে বা কিছু দেখতে মানা করে না।

তো ঘুরাঘুরি শেষ করে আমরা যখন আমাদের হোমস্টে এর সামনে চলে এলাম তখন একটা জিপে করে পূর্বা (আমাদের গাইড) এল। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, কাল আমাদের এখানে রেখে জিপ পেয়ে যাওয়ায় রাতে বাসায় (মানেভঞ্জন) চলে গিয়েছিল, এখন আবার আরেকটা জিপ এ চলে এসেছে।

পূর্বাকে বললাম যে আমাদের কাছে ট্রেকিং পোল নেই, বাশ পাওয়া যাবে কিনা। সে আমাদের পাওয়া যাবে বলে সেটা ম্যানেজ করতে বেরিয়ে গেল। এর মধ্যে আমাদের সকালের নাশতা ব্রেড-অমলেট রেডি। রান্নাঘরে ঢুকে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে নিলাম। বেরিয়ে দেখি দাদা আর পূর্বা আমাদের জন্য চারটা বাশ কেটে সুন্দর ট্রেকিং পোল সাইজের করে রেখেছে।

এবার ব্যাগ গুছিয়ে বের হবার পালা। টাকা-পয়সার সব হিসেব নিকেশ চুকিয়ে বের হব, তখন দিদি আমাদের গাইড সহ পাঁচজনের জন্য একটা করে খাদা (ট্র্যাডিশনাল সাদা লম্বা কাপড়) আমাদের গলায় পড়িয়ে দিলেন। পাহাড়ে অতিথিদের এইভাবে বরন করা কিংবা বিদায় দেয়ার নিয়ম আছে। আমরা যেহেতু তাদের প্রথম দিককার গেস্ট তাই তারা আমাদের এই জিনিস দিয়েছেন। ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম কাপড়টা শুধু সাদা না, ভেতরে আরও কি কি জানি আঁকিবুঁকি এবং লিখাও রয়েছে। যাই হোক, ভাল একটা সুভেন্যির পাওয়া গেল।

শেষে সবার সাথে গ্রুপ ছবি তুলে বেরিয়ে পরলাম আমাদের দ্বিতীয় দিনের ট্রেকিং এ।

চিত্রে থেকে মুল রাস্তা ধরে হাঁটলে ১-২ কিমি পরেই লামে ধুরা। আসার পথে তিনটা কুকুরও আমাদের সাথে সাথে অনেকটা পথ এল। আমরাও বেশ আরামেই চলে গেলাম বেশ কিছুদূর। খুব একটা খাড়া নয়, আর আবহাওয়াও বেশ ভাল। মাঝে একটা অফরোড শর্টকাট এ একটুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম আর প্রকৃতি উপভোগ করলাম। রোদের আলোয় শরীরও একটু গরম হল।

একটা ব্যাপার লক্ষনীয় যে, একটু পরপর সুন্দর সুন্দর মেসেজ লিখা আছে সাইনবোর্ডে পুরো রাস্তা জুড়েই -

লামে ধুরা গিয়ে ছোট্ট একটা চা বিরতি নিলাম। এখানে কয়েকটা বাড়িঘর আছে মাত্র, আর রাস্তার পাশে একটা দোকান।

Lamay Dhura

একটু বসে আবার হাটা শুরু করলাম। বেশ খানিকদূর গিয়ে দুই একটা খাড়া শর্টকাট বেয়ে উঠে একটু হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু প্রকৃতি যেখানে আছে, সেখানে টায়ার্ড থাকাটা খুব বেশিক্ষণ সম্ভব না। একটা ভিঊপয়েন্ট পেয়ে গেলাম, সবুজ ঘাসে ঢাকা। সেখানে শুয়ে বসে ঠাণ্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে গেল।

এই পয়েন্ট থেকে কিছুদূর সামনে হাঁটতে হাঁটতে একসময় মনে হয় ঘন মেঘের মাঝে ঢুকে গেলাম। পরিবেশ এর সাথে নামের একদম মিল জায়গাটার - মেঘমা। বাশ দিয়ে বানানো বেশ কিছু বেঞ্চ আর একটা সিংহাসন টাইপের জিনিস বানানো আছে, সবাই ছবি তুললাম। একপাশে ছোট্ট একটা মনাস্ট্রি আছে, অন্যপাশে পাথরে তৈরি করা একটা রেস্টুরেন্ট যাতে হাল্কা খাবার পাওয়া যায়।

এখানে সবকিছুই খুব গোছালো মনে হল। মনাস্ট্রির ভেতরে ঢুকে দেখলাম, এই প্রথম প্রেয়ার ফ্ল্যাগগুলো কাছে থেকে দেখলাম, অনেক লিখা এবং ছবি আছে সবগুলোতেই। একদম মোড়ে একটা গোলচত্তর আছে যেখানে একটা গাছ লাগানো। সাথেই একটা পানির কল লাগানো আছে পথচারীদের পানির সোর্স হিসেবে। আমরা পানির বোতলগুলো ভরে নিলাম সেখান থেকে। আর রেস্টুরেন্টে আমরা কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিয়ে চা বিস্কিট ডিম সেদ্ধ খেয়ে আবার চাঙ্গা হয়ে গেলাম।

পুর্বাকে বলেছিলাম যে মেইন রাস্তা ধরে হাঁটতে ভাল লাগে না, অফরোড যাওয়া যাবে কিনা। সে বলল মেঘমা থেকে বামে নেপালের ভেতর দিয়ে একটা রাস্তা আছে যেটা ধরে তুমলিং যাওয়া যায়। আর ডানে যে মেইন রাস্তা সেটা চলে গেছে একটু উঁচুতে টংলু হয়ে তুমলিং। আমরা নেপালের রাস্তাই বেছে নিলাম।

অফরোড ভালই লাগছিল, একদিকে আমরা যেমন নেপালের ভেতর ছিলাম অন্যদিকে আরও বেশি সুন্দর দৃশ্যে ভরা পথ। পাহাড়ের গায়ে আলো-ছায়া-মেঘ এর খেলা - এ এক অপরূপ দৃশ্য।

পথে আরও একটা বৌদ্ধ স্থাপনা পেয়ে যাই, একটা ঘরের মতন যার ভেতরে একটা ঘণ্টা নিজে থেকেই বাজছে। ভাল করে খেয়াল করে দেখা গেল যে উপর থেকে নেমে আসা ঝিরির পানি কাজে লাগিয়ে এমনভাবে জিনিসটাকে বসানো হয়েছে যাতে পানির স্রোতের জন্য ঘণ্টাটা বাজতে থাকে!

পথে আমরা গুরাশে নামক একটা ছোট্ট গ্রাম পার হলাম। মাত্র কয়েকটা বাড়িঘর। সমতলের বাসিন্দা হয়ে চিন্তা করা যায় না যে এই মানুষগুলো কিভাবে এই কঠিন প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাস করে!

যাই হোক, আমরা আরও অনেকদূর একটু উঁচু রাস্তায় এগুই, মাঝে আরেকবার পানি বিরতি নেই। কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পাই তুমলিং, বেশ কিছুটা খাড়া পাথুরে রাস্তা। এইটুকু রাস্তাই উঠতে আমাদের যতটুকু এনার্জি ছিল সব শেষ। একটু মাথাটাও ব্যাথা হচ্ছিল, আর সাথে হাঁটুর ব্যাথা তো আছেই।

বাড়িঘরগুলো রঙ্গিন - নীল, লাল, হরেক রকম রঙে বেশ সুন্দর লাগছিল দেখতে। উপরে উঠার পর বেশ খানিকটা ভিড় খেয়াল করলাম। অনেকগুলো পরিবার এবং গ্রুপ একসাথে আসায় এই ভিড়।

পুর্বা আমাদের জন্য থাকার জায়গা ঠিক করে দিল। আমরা এক প্রান্তের একটা হোমস্টে তে জায়গা পেলাম, দোতলায়। পুরো বাসাটা কাঠের তৈরি, ছাদ দিয়ে আধাস্বচ্ছ শেড এ ঘরের মধ্যে বেশ ভালই আলো আসে। নিচ তলায় শেয়ার্ড টয়লেট।

পথে একটা ডাস্টবিন এর গায়ের লেখাটা শেয়ার না করলেই না -

অনেক ক্ষুধা পেয়েছিল, তাই তাড়াতাড়ি করে ম্যাগি নুডলস খেয়ে এবেলায় ক্ষুধা মেটালাম।

তুমলিং এর একটা সমস্যা আছে, আগে পিছে সব দিকে খোলা। মানে কোন বড় পাহাড় নেই আশেপাশে। এই কারণে বাতাস এবং ঠাণ্ডাটা একটু কড়া বলা যায়। বাইরে আমাদের সাথে অনেক বাঙ্গালীর সাথেই কথা হল যারা ভারতের বিভিন্ন জাগয়া থেকে এসেছেন এখানে। কেউ একা, কেউবা পরিবার সহ জিপে করে এসেছেন। আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি জেনে সবারই অনেক কৌতূহল, অনেক জিজ্ঞাসা, আর কমবেশি সবারই বাংলাদেশে আদি আবাসস্থল অথবা এখনো আত্মীয়স্বজন আছে!

রুমে এসে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু মাথা ব্যাথার জন্য ঘুম এলনা। বাকিরা একটু আধটু ঘুম। তখন আরও একজন ভেতরে ঢুকল। চেহারা দেখে ভারতীয় কিংবা বাংলাদেশি হবে অনুমান করলাম। হাই হ্যালো বলার পর জিজ্ঞেস করলাম — “Where are you from ?” উত্তর - "Bangladesh"

ব্যাস, বাকি ট্যুরে জাহিদ ভাই যোগে আমাদের ৪ জনের দল থেকে ৫ জন হয়ে গেলাম। মজার বেপার হচ্ছে আমরা যে পথ দুই দিনে ভাগ করে এসেও কাতরাচ্ছি, সেই পথ ভাই এসেছেন মাত্র ৪ ঘণ্টায়!!! তো খানিক্ষন কথা বার্তা বলে জানলাম উনি মাঝে মধ্যেই ঘুরাফেরা করেন এবং নিয়মিত সাইকেল চালান। তো আমাদের চেয়ে ফিট থাকারই কথা।

ঘুমাতে না পেরে বাইরে চলে গেলাম, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হচ্ছে আর ঠাণ্ডাটাও বাড়ছে। বাইরে গিয়ে আবারো ভারতের বাঙ্গালী কয়েকজনের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে সন্ধ্যা বেলায় রুমে ফিরলাম।

খাবার প্রায় ৭:৩০ এর দিকে হয়ে গেল, সারাদিন হাটাহাটিতে প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছিল। একদম গলা পর্যন্ত খেলাম ডাল-ভাত-সবজি আর সেই চাটনি। খেয়ে গিয়ে মাত্র শুয়েছি, এমন সময় জাহিদ ভাই এসে বলল, বাইরে নাকি ক্লিয়ার আকাশ, পুরো কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলোতে!

ভাইয়ের বলতে দেরি, আমাদের উঠতে দেরি হয়নি। লেপ-কম্বলের আরাম ফেলে তাড়াতাড়ী জুতা পরে বাইরে বেরিয়ে যখন রাস্তার উপর গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন এক মনমুগ্ধকর দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল। চাঁদের আলোয় অপরূপ উজ্জলতায় ভাসছে কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ!

কিছুক্ষণ সেখানে এই দৃশ্য দেখার পর আর টিকা গেল না ঠাণ্ডার প্রকোপে। চলে এলাম রুমে আর শুয়ে পড়লাম যার যা কিছু আছে তা নিয়েই (সোয়েটার, লেপ, কম্বল)।

রাত হচ্ছে, শীতটাও একটু বেশি লাগছে। দুই একজনের নাক ডাকার শব্দও পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু আমার ঘুমের খবর নাই। ঠাণ্ডায় মাথা ব্যাথা আর শরীরে জ্বর জ্বর ভাব দুইটা নাপা খেয়েও গেলনা (সম্ভবত এল্টিটিউড সিকনেস)। সারা রাত এদিক সেদিক করে আর আগামীকাল শরীর খারাপ হবার ভয় নিয়েই শেষ রাতে হয়তো মোটে এক ঘণ্টার জন্য ঘুমিয়ে পড়লাম ...

দিন ০

দিন ১

দিন ২

দিন ৩

দিন ৪

দিন ৫

দিন ৬ এবং শেষ

--

--