নতুন উচ্চতায় | সান্দাকফু ট্রেক | দিন ৩

তুমলিং - জাউবাড়ি - গাইরিবাস - কাইয়াকাটা - বাতাসি - কালপোখারি

Nowshad
tripsharebd

--

২১ অক্টোবর
২৯৭০ মি. → ৩১৭০ মি.

তুমলিং

সারা রাত ঘুম হলনা, শেষ রাতের দিকে মোটে এক ঘণ্টা ঘুমালাম, তারপর ৫ টার দিকে উঠে বেড়িয়ে পরলাম একটু ভাল ওয়েদারের আশায়। বাইরে একটু একটু আলো, আরও বেশ কিছু মানুষজনও দেখলাম বাইরে বেরিয়েছে ইতোমধ্যে। সবার একি উদ্দেশ্য — ভোরের সূর্যের প্রথম আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা।

তখনো সূর্যের আলো নেই, জাস্ট একটু আবছা বোঝা যাচ্ছে পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বত - কাঞ্চনজঙ্ঘা । আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে একটু পরই সেই কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখা যাবে। তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে দোতলায় উঠে বাকি সবাইকে ডেকে তুললাম। আবার দৌড়ে ব্যাক করে ভিউ পয়েন্টে গেলাম। এক মিনিটের মধ্যেই সূর্যের প্রথম কিরণ যখন কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় পরল, এক অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা হল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কতক্ষণ। আমার মতন আরও অনেকেই অবাক চোখে দেখছে, ছবি তুলছে। অন্যদের ছবি তুলা দেখে আমারও মনে হল ছবি তোলার কথা।

The Sleeping Buddha

কাঞ্চনজঙ্ঘা মাউন্টেন রেঞ্জ দেখতে গৌতম বুদ্ধ শুয়ে থাকার আকৃতির মতন দেখায় বলে, একে ঘুমন্ত বুদ্ধ বলা হয়।

একদিকে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সূর্যদয়ের দৃশ্য, অন্যদিকে স্লিপিং বুদ্ধ এর রূপ, এদিক সেদিক করে দুইটাই উপভোগ করলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য আধঘন্টা স্থায়ী হল, তারপর মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল।

ভিউ পয়েন্টেও একটা বৌদ্ধ স্থাপনা রয়েছে এবং আশ পাশ ঘিরে প্রেয়ার ফ্লাগ টানানো আছে।

চারিদিক আজকে একটু বেশিই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মেইন রাস্তার সাথেই একটা দোকানে চাওমিন অর্ডার করলাম, সাথে এক কাপ লাল চা। চাওমিন হতে হতে বাইরে রোদে দাঁড়িয়ে একটু আরাম পাওয়া গেল। কালকে দেখা হওয়া আরও দুই একজনের সাথেও কথা হল। কেউ কেউ আজ ফিরে যাবে, আবার কেউবা জিপ এ করে সোজা সান্দাকফু চলে যাবে।

চাওমিন হয়ে গেলে খাওয়ার পালা সাঙ্গ করে রুমে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। নিচে নেমে এখানের টাকা-পয়সা সব পরিশোধ করলাম। তারপর সবাই মিলে হোমস্টের সামনে ছবি তুলে আমাদের তৃতীয় দিনের ট্রেকিং শুরু হল।

মজার ব্যাপার হল, এখন পর্যন্ত যেই মেইন রোড টা সান্দাকফু চলে গেছে, সেটা আসলে বেশিরভাগ অঞ্চলেই একটা বর্ডার হিসেবেও কাজ করেছে, যাওয়ার পথে হাতের বামে নেপাল, ডানে ভারত। সে হিসেবে আমরা তুমলিং এ নেপালেই ছিলাম।

আরেকটা বেপার হচ্ছে যেহেতু জাহিদ ভাই একাই একজন গাইড নিয়ে এসেছেন, তাই আমাদের ৫ জনের জন্য জন্য এখন ২ জন গাইড! গাইডের নাম রিকজেন শেরপা। আমাদের গাইড পুর্বা আর রিকজেন খুব ভাল বন্ধু এবং সমবয়সী। তবে রিকজেন হচ্ছে আলট্রা ফাস্ট। পাহাড়ের পথে যেন উড়ে উড়ে চলে! বেশ কম কথা বার্তা বলে।

আজকেও আমরা নেপালের ভেতর দিয়েই বেশিরভাগ রাস্তা যাব। এই রাস্তাটা আরও উঁচুতে এবং সুন্দর। আর দিনের আবহাওয়াটাও বেশ ভাল থাকায় যেতে যেতে অনেক সুন্দর দৃশ্য চোখে পড়ল।

পাহাড়ের গায়ে রোদ-মেঘ এর খেলা। মাঝে মাঝেই এদিকে সেদিকে ঘোড়া চড়ে বেড়াচ্ছে। এত উঁচুতে বিভিন্ন জিনিসপত্র বহনের জন্য ঘোড়া এবং গাধা ব্যবহার করা হয়। রাস্তা আজকের পথ একটু সহজ হলেও অনেকটা পথ যেতে হবে। মাঝে বেশ কয়েকবার বিরতি নিয়ে পানি, চকলেট, খেজুর ইত্যাদি খাওয়া হল। আর একটু আধটু ছবি তোলাও হল।

গাইড দুইজন অনেকদূর গিয়ে গিয়ে শুয়ে বসে থাকে আর আমরা সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলে তারপর তারা উঠে। রিকজেন এড হবার পর পুর্বার গতিও এমন বাড়লো যে আমরা রীতিমত মনে মনে বকাবকি শুরু করলাম যে বেটারা এমনে দৌড়ে পাহাড়ে উঠে যায়, আর আমরা একটু উঠতেই হাঁপাই। তার উপর আমার বাম হাঁটুর ব্যাথাটা বেড়েই চলল, ফলে গ্রুপ এর সবার পেছনে পড়ে থাকতে হল।

মাঝে মাঝেই এইরকম বিভিন্ন পাথরে রঙ্গিন লিখা চোখে পড়ার মত। কিছুদূর গিয়ে একটা চেক পয়েন্ট, এটা নেপালের মাঝে পড়েছে। এখানে আমাদের তথ্য দিতে হল, আর সিঙ্গালিলার টিকিটও দেখাতে হল। এরই অন্য পাশে একটা কৃষি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে অনেকগুলো গ্রিনহাউস দেখা গেল।

চেকপোস্ট পেরুতেই পৌঁছে গেলাম নেপালি গ্রাম জাউবাড়িতে। বেশ খানিক্ষন রেস্ট নিলাম কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে নিয়ে। ধোয়া উঠা লাল চা খেয়ে ক্লান্তিটা একটু কেটে গেল। চা’র দোকানের সাথে একটা ঘর দেখা যাচ্ছে। দেয়ালে বব মার্লে, জন লেনন, ইত্যাদি পোস্টার লাগানো, গিটার রাখা একপাশে, বেশ মিউজিক্যাল ডেকোরেশন বলা চলে।

এখান থেকে বেশ খানিক্ষন ডাউনহিল ট্রেকিং। একসময় নিচে নামতে নামতে পৌঁছে গেলাম গাইরিবাস। এখানেও অনেক মানুষজন। একটা খাবার দাবারের জায়গা আর পাশে SSF চেকপোস্ট। আমাদের সবার পাসপোর্ট ইন্ট্রি দিতে হল। তারপর মম খেয়ে পানির বোতল গুলো ভরে নিলাম।

সামনের ২ কিমি রাস্তা একদম খাড়া উপরে উঠে গেছে। রাস্তা দেখেই আর উঠতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু না উঠে উপায় নেই, সবে মাত্র অর্ধেক রাস্তা এসেছি। একদম পাথুরে ভাঙ্গাচোরা রাস্তা। আস্তে আস্তে উঠতেও পায়ের খবর হয়ে যাচ্ছে। আমার হাঁটুর ব্যাথা যেন প্রতি স্টেপেই বেড়ে চলছে। অর্ধেক গিয়ে বসে পরলাম, জাহিদ ভাইয়ের কাছ থেকে মুভ স্প্রে নিয়ে পায়ে লাগানোর পর একটু ভাল লাগলো। তারপর পানি খেয়ে আবার উপরে উঠা। খাড়া রাস্তা শেষ হয় কাইয়াকাটা নামের জায়গায়। এখানে সবাই বসে চা, পানি খেয়ে আবার হাটা। এরপর আরেকটা ছোট্ট গ্রাম বাতাসি পড়ল চলার পথেই। পানি খেয়ে একটু জিরিয়ে আবার চলা শুরু।

আস্তে আস্তে চলছিলাম বলে গ্রুপ থেকে অনেক পিছিয়ে পড়লাম। শেষে থাকার একটা বড় অসুবিধা হচ্ছে যে রেস্ট খুব কম নেয়া যায়, কারণ বাকিরা আগে গিয়ে রেস্ট নিতে পারে। একসময় আর পা চলছিল না। তাই আরেকটা ২ জনের গ্রুপ এক জায়গায় বসে রেস্ট নিচ্ছিল দেখে তাদের সাথে গিয়ে বসলাম বেশ কিছুক্ষণ। সেখানে তাদের সাথে কথা হল খানিক্ষন। তাদের গাইড যে ছিল সে খুব মজার মানুষ, নাম - দাওয়া দ্রুকপা। আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পেরে সে বলল যে পাহাড়ের মজাই এটা, খারাপ লাগবে, শরীর আর চলবে না, ব্যাথা হবে, কিন্তু শেষমেশ যখন ট্রেক শেষ হয়ে যাবে তখন এই স্মৃতিগুলার জন্যই খারাপ লাগে, আবার আসতে মন চাইবে।

তার কথাগুলো শুনে মন ভাল হয়ে গেল, তাদের সাথেই পরবর্তি অনেকক্ষণ হাঁটলাম। গাইডের সাথে কথা বলতে বলতে আর পায়ের ব্যাথাটা টের পেলাম না, কথায় কথায় জানা গেল যে সে ১৪-১৫ বছর ধরে এইখানে গাইডের কাজ করছে। গাছ, ফুল, ফল সবকিছুর নাম তার জানা। বেশ মজা করতে পারে। পরে অবশ্য জেনেছি যে সেখানকার গাইডদের মধ্যে তার অবস্থান তৃতীয়, তারা একটা আনঅফশিয়াল র‍্যাংকিং করেছে। অবশ্য কিসের ভিত্তিতে করা সেটা জানা হয়নি।

আমার হাটার বেগ বেশ বাড়ল, পায়ের ব্যাথাটা হটাত করেই যেন পুরোপুরি টের পাচ্ছিলাম না! সম্ভবত অনেকক্ষণ ব্যাথার পর ব্রেইন ইগনোর করতে শুরু করেছে। সেই গাইড বলল যে পাহাড়ে কিলোমিটার একটু বেশি করে হিসেব করলে ভাল, নাইলে মনে হবে যে এতদূর আসলাম অথচ কিমি শেষ হয়না কেন! একসময় আমার গ্রুপকে ধরে ফেললাম। পথে অপর গ্রুপের একজন বাঙ্গালী আমার আর নাহিদ ভাইয়ের একটা ছোটখাট ক্যামেরা ইন্টারভিঊ নিয়ে ফেললেন। তার সাথেও বেশ কথাবার্তা হল।

তো এই পথে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় বিকেল ৪ টার দিকে আমরা পৌছালাম কালপোখারি। জায়গাটার নাম কালপোখারি হবার পেছনের কারণ যদ্দুর জানতে পেরেছি সেটা হল পোখারি মানে হচ্ছে পুকুর, আর কাল মানে কাল রং। পাশেই একটা পুকুর রয়েছে যেটার পানি দেখতে একটু কাল রঙ এর মনে হয়। এটাকে সম্ভবত ধর্মীয়ভাবেও একটা বিশেষ পুকুর ভাবা হয়। তাই এরই নাম অনুযায়ী এলাকার নামকরণ।

আমাদের থাকার জায়গা ঠিক করা হল একদম পুকুরের পাশেই প্রথম হোমস্টেতেই। খুব সুন্দর লোকেশন, আর ভেতরে বেশ গরম। ঘরের ভেতরেই টয়লেট আছে। আর আজ প্রথম বারের মতন গাইডরাও একি ঘরেই থাকবে আমাদের সাথে। একটা বড় বেড ৪/৫ জন শোবার মতন, একটা সিঙ্গেল বেড ও একটা ডাবল বেড। দেয়ালগুলো সব কাঠের বোর্ড দিয়ে ঘেরা। ঘরে কিছু বই রাখা, আর দেয়ালে একটা গিটার ঝোলানো। বেশ পছন্দ হল জায়গাটা।

ঘরে ঢুকেই প্রথমে বলেছিলাম খাবার দিতে, এতদূর হেঁটে প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছিল। খুব তাড়াতাড়িই সার্ভ করা হল গরম গরম চাওমিন। খেয়ে পেট ভরল এবং বেশ ভালো লাগায় সন্ধ্যায় খাওয়ার জন্য আগেই অর্ডার করে রাখলাম। তারপর বিছানায় শুতেই সবাই ঘুম। এক ঘণ্টা ঘুমের পর বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভাঙ্গল চাওমিন রেডি এই ডাকে। গত কয়েকদিনে সবচেয়ে ভাল এক ঘণ্টা ঘুম হল এইটাই। পুর্বা চাওমিন দিয়ে গেল রুমে, খেলাম ঘুম ঘুম চোখেই।

তারপর কতক্ষন গল্প করতে করতে রাতের খাবারের সময় হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগেই চাওমিন খাওয়ায় রাতের খাবার খুব একটা খেতে পারলাম না। তবে বেশ কিছুদিন পর চিকেন খেলাম এবং বেশ ভালই লাগল।

বাইরে খুব ঠাণ্ডা এবং বাতাস, তাই রুমে চলে এলাম। রুমে বেশ আরাম এবং গরম। কম্বলগুলোও বেশ ভাল। আমরা কথাবার্তা বলছিলাম, এমন সময় হোমস্টের দাদা আসলেন। দেয়াল থেকে গিটার নামালেন, ইরেজি, হিন্দি, নেপালি গাল শোনালেন বেশ কিছু। আমরাও চেষ্টা করলাম সুর মেলাতে। দাদা চলে গেলেন রাতের খাবারের জন্য, তবে আরেকজন দাদাঁ এলেন আমাদের গানের শব্দ শুনে। ইনি এই রুটে জিপ চালান, নিজের একটা জিপ আছে। উনিও বেশ গিটার বাজান — বেশ কিছু গান গাওয়ার পর শেষ হল Living on a jet plane দিয়ে।

আমরা নিজেরাও বেশ আরামে শুয়ে বাতি নিভিয়ে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। মনে হল এমন আরামে অনেকদিন থাকিনি। হাসাহাসি করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম আগামীদিনের প্রতীক্ষায় …

দিন ০

দিন ১

দিন ২

দিন ৩

দিন ৪

দিন ৫

দিন ৬ এবং শেষ

--

--