নতুন উচ্চতায় | সান্দাকফু ট্রেক | দিন ৪

কালপোখারি - বিকেভাঞ্জন - সান্দাকফু - আল

Nowshad
tripsharebd

--

২২ অক্টোবর
৩১৭০ মি. → ৩৬৩৬ মি.

পুরো ট্রিপ এর সবচেয়ে আরামদায়ক ঘুম থেকে উঠলাম ভোর ৬ টায়। আগের দিনের লম্বা সময় ধরে ট্রেক করার কারণে শরীর খানিকটা ব্যাথা, তবে আগের রাতের ঘুম না হওয়ার সমস্যাটা মিটে গেল এইরাতে ভাল ঘুম হবার কারণে।

আজকের ট্রেক এ একটা খুব খাড়া ৩ কিলোমিটার পথ আছে শুনে গতকাল এখানে এসেই পুর্বাকে বলেছিলাম এইটুকু রাস্তা জিপে যাওয়া যাবে কিনা। পুর্বা বলল যে ম্যানেজ করা যাবে। তো আমি সকালে ফাইনালি জানবো বলেছিলাম। তবে ঘুম থেকে উঠে বেশ ভালই লাগছিল, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম যে হাঁটব।

কাল পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল বিধায় আশপাশটা ঘুরে দেখা হয়নি। আজ হাঁতে সময় আছে, তাই একা একাই পুরো গ্রামটা ঘুরে দেখলাম। বেশ কিছু হোমস্টে আর চায়ের দোকান আছে। এখানে থেকে সান্দাকফু একদম স্পষ্ট দেখা যায়। খুব কাছেই, আর খাড়া আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো দেখা যায়। আসে পাশে মেঘ এর জন্য অন্যান্য দূরের পাহাড়গুলো খুব একটা দেখতে পাওয়া গেল না। সকাল সকাল দুই একজন পূজা করছে, কেউ কেউ দোকান খুলছে, রাতে যেই দাদা গান শুনিয়েছিলেন উনি তার গাড়ি ধোয়ামুছা করে চলে গেলেন, আর আমাদের হোমস্টের দাদা উঠে এই ঠাণ্ডার মধ্যে কাপড় ধুচ্ছেন!

বামে কালপোখারির রাস্তা | ডানে এই বড় পাহাড়টার চূড়াই সান্দাকফু

তো সবাই উঠে হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরে গিয়ে একটু আগুন পোহালাম, আর সাথে রুটি সবজি খেয়ে সকালের নাশতার কাজটাও সেরে নিলাম। এবার আমাদের বের হবার পালা, আজ সামিট ডে। তবে আমার ব্যাগ এ একজোড়া অতিরিক্ত জুতার কারণে ব্যাগটা ভারী হয়ে আছে, যার কারণে কাঁধ ব্যাথা করে। তাই জুতাটা রিকজেনের ব্যাগে এবং একটা সোয়েটার পুর্বার ব্যাগে ট্রান্সফার করলাম। তারপর দাদা-দিদির সাথে ছবি তুলে শুরু করলাম যাত্রা।

সান্দাকফু পর্যন্ত মোট রাস্তা ৬-৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রথম ৩ কিলো খুব একটা খাড়া নয়, বেশ আরামেই চলে গেলাম। তবে এই বেলায় গতি একটু কম, কারণ এত উচ্চতায় সমতলের মতন অক্সিজেন পাওয়া যায়না বলে শরীরও একটু পরিশ্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এক দফা ব্রেক নিয়ে তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম আমাদের পরবর্তী স্টপেজ - বিকেভাঞ্জনউচ্চতা - ৩২৮০ মিটার

একটা ব্যাপার হল, এই পর্যন্ত আসার মাঝে তেমন কোন বাচ্চা-কাচ্চা চোখে পড়েনি। বিকেভাঞ্জন এসেই দুই একজনের দেখা মিলল। একটা ছেলে, গাড়ি বানিয়ে দড়ি দিয়ে বেধে সেটা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে, আর আমরা যেখানে চা বিরতি দিলাম সেখানেও দুইজন পাওয়া গেল, একজন পয়সা আর ঢাকনা নিয়ে খেলছে, আরেকজন সেটা অনুমান করার চেষ্টা করছে যে পয়সাটা কোন ঢাকনার নিচে আছে। এই অনুমানকারির নাম - লাবু শেরপা

খুব হাসিখুশি পোজ দিয়ে আমাদের ছবি তোলার সকল আবদার মিটাল লাবু শেরপা।

বিকেভাঞ্জনে চা বিরতি নিলাম। সান্দাকফু যাবার আগে শেষ চেকপোস্ট এখানেই। টিকিট দেখানো আর নাম এন্ট্রি করিয়ে রওনা দিলাম সেই খাড়া পথ ধরে। একটুখানি যেতেই পা ভেঙ্গে আসছিল। তাই একটু পর পর থামতে হচ্ছিল। তবে শেষ এর এক দেড় কিলোমিটার রাস্তা একটু বেশিই খাড়া, দুই কদম ফেলেই যেন হাঁপিয়ে উঠছিলাম।

পথে একজন পোর্টার এর সাথে দেখা হল, উনি উনার তিনটা ঘোড়া নিয়ে এসেছেন, ঘোড়ার পিঠে বিভিন্ন মালামাল। আমরা মাঝে মধ্যে থেমে, ছবি তুলে চেষ্টা করলাম নিজেদের আপ রাখার। যখন সান্দাকফু ০ কিমি সাইনবোর্ড চোখে পড়ল তখনের অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। তবে এই সাইনবোর্ডটাকেই পরবর্তি অনেকক্ষণ গালাগালি করলাম, কারণ এর পরে সান্দাকফুর চূড়ায় যেতে আরও প্রায় আধা কিলো খাড়া রাস্তা যেতে হল যেটা আমাদের শরীরের শেষ এনার্জিটুকুও শুষে নিল। সান্দাকফু চূড়ায় গিয়ে সবাই একদম শুয়ে পড়লাম। একদিকে এত উচ্চতায় বাতাসে অক্সিজেন কম, অন্যদিকে পা গুলো আর চালানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল।

সান্দাকফু একটু কমার্শিয়ালাইজড, অনেক রঙ্গিন বাড়িঘর, থাকার যায়গা, খাবার জায়গা, আর একটু ভিড়ও আছে বলা যায়। খরচও একটু বেশি। আমরা এইসব ঝামেলা এড়াতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আরও দুই কিলোমিটার সামনে আল এ গিয়ে থাকবো।

আল মূলত একটা ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড। সাথে একটা দুইটা ছোট্ট হোমস্টে আছে যেখানে, ১৫ — ২০ জন মানুষের থাকার ব্যবস্থা আছে। আমরা পৌঁছানোর একটু পরেই IndiaHikes এর প্রায় ৪০ জনের একটা গ্রুপ এল সেখানে ক্যাম্পিং করতে। অনেকগুলো হলুদ টেন্ট, আর পাশে কয়েকটা নীল টেন্ট।

আল এও থাকার জায়গা হল দোতলায়। উপরে উঠে শুয়ে পড়লাম, কিন্তু মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা, আর শরীরের সব জয়েন্ট মনে হচ্ছে খুলে গেছে। নিঃশ্বাস নিতে একটু কষ্ট হচ্ছিল। তাই নিচে নেমে আসলাম। শরীর খারাপ লাগছিল, বমিও হয়ে গেল। বুঝতে বাকি রইলনা যে এল্টিটিউড সিকনেস, একটু ভয় লাগছিল। তবে জরুরি অবস্থা হলে জিপ ডেকে চলে যাওয়া যাবে এই ভেবে শান্ত থাকলাম।

দুপুরের খাবার দিল, কিন্তু খুব একটা খেতে পারলাম না। পুর্বাকে বললাম অবস্থার কথা, পুর্বা রান্নাঘরে গিয়ে হোমস্টের দিদিকে বলতেই দিদি এক কাপ গার্লিক স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসলেন। গার্লিক স্যুপে এক চুমুক দিতেই পুরো শরীর একটা কাঁপুনি দিয়ে উঠল। কড়া রসুনের টেস্ট, মূলত গরম পানিতে রসুন আর লবণ দিয়ে বানানো হয় এই স্যুপ। তবে আধা কাপ খেতে না খেতেই আগের চেয়ে অনেক বেটার লাগা শুরু হল। দলের বাকিরাও একটু করে খেয়ে নিল।

শরীর ক্লান্ত থাকার পরেও উপরে উঠে শুতে গেলাম না দমবন্ধ লাগে বলে, বাইরে বেড়িয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে আর বুক ভরে দম নিয়ে চেষ্টা করলাম নিজেকে ঠিকঠাক রাখার। বিকেলে একটু রোদ পাওয়ায় শরীর আগের চেয়ে ভাল লাগছিল, আর মাথা ব্যাথাটাও কেটে গেল, কিছুটা চিন্তামুক্ত হলাম নিজের রিকভারি দেখে।

সন্ধ্যে হয়ে এলে আবারো খাবার জায়গায় চলে এলাম একাই, এখানে এখন অনেক মানুষ। রান্নাঘরের সাথে হওয়ায় জায়গাটা বেশ গরম, তাই মানুষজনের আড্ডাটাও এখানে জমেছে বেশ। আমি প্রথমে গিয়ে পুর্বার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বার্তা বললাম, ট্রেকের মাঝে খুব একটা গল্পগুজব করার সুযোগ মিলেনি। সকালে গাড়ীতে ফেরত যাওয়া যাবে কিনা খবর নিলাম, জানা গেল যে যাবে। তবে পুর্বা বুঝতে পেরেছে যে আমি মনে মনে চাই হেঁটেই যেতে, শুধুমাত্র ব্যাকআপ হিসেবে গাড়ির খোজ করছি। তাই সে বলল সকালে যেন শরীরের অবস্থা বুঝে ওকে জানাই যে গাড়ীতে যাওয়া লাগবে কিনা।

পুর্বার সূত্রেই পরিচয় হয় এই রুটের সবচেয়ে অভিজ্ঞ গাইডের সাথে, বয়স ৪০-৫০ হবে। বেশ ইংরেজি বলে। তাকে ফালুট এর কথা জিজ্ঞেস করলাম, বললেন যে এখন তো পিক সিজন, উনি খবর নিয়েছিলেন, সব বুকড। একা হলে তাও সমস্যা হত না, কিন্তু আমরা ৫ জন থাকার জায়গা পাব কিনা ঠিক নেই। আরও বললেন আমরা চাইলে ৭ কিমি দূরে মাঝে আরেকটা জায়গা সবরগ্রাম এ থাকতে পারি, পরে গোরখে হয়ে শ্রীখোলা নামতে পারি। তবে সেক্ষত্রে একদিনে অনেকদূর হাঁটতে হবে।

আগে যে একজন পোর্টার এর কথা বললাম উনার সাথেও কথা হল। জানতে পারলাম উনার বাড়ী শ্রীখোলায়, একদম নদীর পাশে।

আরও একজন গাইডের সাথে কথা হল, উনি বেশ অনেক কথা বললেন। পাহাড়ে উনাদের অধিকার নিয়ে, সরকারের অবহেলা নিয়ে দুঃখ করলেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম যে উনার দুই ভাই নেপালে এভারেস্ট এর শেরপা ছিলেন, কিন্তু এক বছর আগে এভালেন্সে মারা গেছেন।

তো গাইডদের সাথে অনেকক্ষণ গল্প করতে করতে দিদি আমার কাছে এসে কেমন আছি জিজ্ঞেস করে আরেক বাটি স্যুপ দিয়ে গেলেন, তবে এবার ভেজিটেবল স্যুপ। এই ঠাণ্ডায় গরম স্যুপ খেয়ে শরীরে একটা ভাললাগা কাজ করে।

পাশেই একটা নেপালি গ্রুপ বসে ছিল, একজনের সাথে প্রথমে কথা হল। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি এবং ট্রেকিং করছি শুনে আমাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলো, দেশ, আমার অনুভূতি ইত্যাদি নিয়ে। একে একে গ্রুপের সবার সাথেই পরিচয় হল। অনেক মিশুক এবং ঘোরাঘুরি পাগল এরা। অনেক গল্প, আমাদের হিরো আলম, ওদের ভীম নিরুলা কিছুই বাদ গেল না। হাসাহাসি আর চিল্লাচিল্লিতে ভালই সময় কাটছিল। জানাগেল যে নীল রঙের তাঁবুগুলো ওদেরই। ওরা আগেও এই রুটে বেশ কয়েকবার ট্রেক করেছে।

একজন ফটোগ্রাফার এবং মিরিকে একটা হোমস্টের মালিক (Rodhigharhomestay), দুইজন ফিল্ম বানায়, একজন মিউজিক কম্পোজার এবং গিটারিস্ট, আর দুইজন স্টুডেন্ট।

আড্ডার এক পর্যায়ে ওদের সাথে বসে লোকাল ড্রিঙ্ক রক্সি (Raksi) টেস্ট করা হল, একটু সবুজ রঙের আর গরম গরম সার্ভ করা হয়, মূলত নেপালি পানীয়। খেতে ভালই, এই ঠাণ্ডায় শরীর গরম রাখতে লোকাল মানুষজন এটা খুব বেশি খায়।

গল্প, গান, নাচ কিছুই বাদ গেল না। সাথে আরেকদল বাংলাদেশি ও ভারতীয় বাঙ্গালীও এসে যুক্ত হল। সবাই মিলে অনেক হৈ হুল্লোড় করে খাবারের সময় হলে এবারের মতন সাঙ্গ হল এই পার্টি। বেশ ভালই সময় গেল বলা যায়।

খেয়ে একটু বাইরে বেরুলাম। আকাশ বেশ পরিষ্কার, চাঁদের আলোয় চারিদিক ভেসে গেছে। তবে ঠাণ্ডাটা বেড়ে যাওয়ায় ফিরলাম। আসার সময় একজন গাইড বললেন কাল যেন তাড়াতাড়ি উঠে পড়ি, একদম ক্লিয়ার ভিউ পাওয়া যাবে।

তো কালকে ক্লিয়ার ভিউ পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে, লেপ-কম্বলের নিচে ঢুকে গেলাম …

দিন ০

দিন ১

দিন ২

দিন ৩

দিন ৪

দিন ৫

দিন ৬ এবং শেষ

--

--