নতুন উচ্চতায় | সান্দাকফু ট্রেক | দিন ৫

আল - গুরদুম - শ্রীখোলা - সেপি

Nowshad
tripsharebd

--

২৩ অক্টোবর

ভোর ৫ টায় উঠলাম, তখনো বাইরে খানিকটা অন্ধকার। রাতে একটানা ঘুমাতে পারিনি, ঠাণ্ডায় বেশ কয়েকবার ঘুম ভেঙ্গেছে। তখনি বুঝেছিলাম বাইরে ঠাণ্ডাটা কতটা বেড়েছে। এই ঠাণ্ডায় টয়লেটে যাওয়া একরকম যুদ্ধ। কাপতে কাঁপতে নিচে নামলাম, আর পানিতে হাত দিয়ে যেন হাত পুরোটা জমে গেল।

তাড়াতড়ি রান্নাঘরে এসে দিদিকে বললাম — দিদি, পিনে কে লিয়ে গরম পানি মিলেগা ?
দিদি খুব মজা করে বললেন — পিনে কে লিয়ে, অর জিনে কে লিয়ে ভি। বলে হাঁতে একাকাপ গরম পানি দিলেন। কতক্ষণ কাপটা ধরে রেখে আর পানি খেয়ে শরীর গরম হল।

বাইরে বেরিয়ে দেখলাম সূর্য মামা একটু একটু উকি দেবেন দেবেন ভাব, দৌড়ে উঁচু জায়গাটায় উঠে গেলাম, তখন সেখানে উৎসুক সবার চোখ সামনের দিকে। উপরে পৌঁছে যা দেখলাম ট তা দেখে দুইটা শব্দ মুখ দিলে বেরুল - শিট এবং ওয়াও!

হাঁতের একদম কাছে নিজ মহিমায় দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা! একবারে পুরো রেঞ্জটা দেখা যাচ্ছে। আর সুর্যের আলো যত বাড়ছে চারপাশ তত বেশি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এই সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই।

একই ফ্রেমে - এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোৎসে, মাকালু

একটু বামে তাকিয়ে আরও অবাক, মাউন্ট এভারেস্ট রেঞ্জও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে !!! এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পাঁচটির মধ্যে চারটি (এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোৎসে, মাকালু) পর্বত দেখার আনন্দ বোঝানো যাবে না। তবে একটু পরে ভিউ আরও পরিষ্কার হলে কাঞ্চনজঙ্ঘার চেয়ে এভারেস্টের দিকেই বেশিক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বত বলে কথা।

হাত, সোয়েটারের পকেট থেকে বের করে মোবাইল দিয়ে একটা দুইটা ছবি তুলতেই যেন জমে বরফ হয়ে যায়, তখনই খেয়াল করলাম আশেপাশের সব গাছের পাতা সাদা হয়ে আছে !!! তার মানে তাপমাত্রা মাইনাসে !!! হাত দিয়ে দেখলাম একটা পাতা, একদম জমে বরফ হয়ে আছে। জীবনের প্রথম মাইনাস তাপমাত্রার অভিজ্ঞতা, প্রাকৃতিক বরফের দেখা! এটাও এক অনন্য অনুভূতি।

মানুষের ছবি তোলার ভিড়, আমার সম্বল ফোনের ক্যামেরা। সেটা দিয়েই চেষ্টা করলাম ভাল কিছু ছবি তুলে রাখতে। তবে চোখে যা দেখেছি তার বিন্দুমাত্রও ছবিতে তোলা সম্ভব হয়নি।

খানিকক্ষণ পর ভিউ পয়েন্ট থেকে একটু নিচে নেমে এলাম, চারিদিক সাদা আর সাদা। গাছের পাতা, তাঁবুগুলো, ঘরের ছাদ সবই বরফে ঢাকা। তবে পুর্বা বলল যে এটা স্নোফল না, তাপমাত্রা মাইনাসে নাম্বার কারণে মেঘ আর শিশির জমে বরফ হয়ে গেছে, তাই এই অবস্থা। তবে সূর্য উপরে উঠার সাথে সাথে তাপমাত্রা একটু বাড়ল।

মানুষজন আস্তে আস্তে গোছগাছ করে পরবর্তি গন্তব্যে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের সাথে আরেক বাঙ্গালী গ্রুপ জিপে করে ফিরে যাবে, আমাকে যাবার জন্য বলল তাদের সাথে, কিন্তু যাব যাব করেও শেষ মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম হেঁটেই নামবো। অন্য দিনের চেয়েও আজকের এই সিদ্ধান্ত অনেক গুরুতর। কারণ একবার জঙ্গলের ভেতর নিচে নামা শুরু করলে আর ফেরত এসে অন্য পথ ধরার সুযোগ নেই, পুরো খাতা কলমে ১৬ কিমি নামতে হবে।

আমার গতরাতের নেপালি বন্ধুরা তাদের তাঁবু গুছিয়ে ফালুটের দিকে রওনা দিল। তাদের বিদায় দিয়ে আমরা চললাম সান্দাকফুর দিকে। আমাদের গাইড পুর্বা আর রিকজেন দুইজনই বলল যে এই ফেরার রাস্তায় তাদের নিজেদেরও একটু কষ্ট হয় পাথুরে আঁকাবাঁকা রাস্তায় নামতে।

সান্দাকফু পর্যন্ত চললাম আসার রাস্তা ধরেই। তারপর একটু জিরিয়ে, শুরু হল নামার পর্ব। মুল রোডের পাশে বনের মধ্য দিয়ে সরু হাটার রাস্তা চলে গেছে। শুরুর দিকে বেশ ভালই লাগছিল, এভাবে বনের মধ্য দিয়ে এখন পর্যন্ত খুব একটা হাটা হয়নি। তারমধ্যে আমরা ছাড়া আর কোন মানুষ নেই এই রাস্তায়। প্রথমে ছোট ছোট শাখা আছে এমন গাছের জঙ্গল, তারপর বড় বড় পাইন গাছের বন। পাইন বনে প্রথমে খুব আস্তে আস্তে নিচে নামা লাগলেও একটু পর শুরু হল একটানা খাড়া নিচে নামার রাস্তা। এমন অবস্থা যে এখানে থামা বা বসারও অবকাশ নেই।

নিচে নামার সময় হাঁটুতে চাপ বেশি পড়ে, আর আঁকাবাঁকা পাথরের রাস্তা হওয়ায় একই ছন্দে নামা যায়না বলে পরিশ্রমটা বেশি হচ্ছিল। আর তাতেই অনেক পিছিয়ে পড়লাম, এতই পিছিয়ে গেলাম যে কাউকে দেখা তো যায়ই না, অনেক ডাকাডাকি করেও কারো সাড়া শব্দ পেলাম না।

একাই হাটছি সামনের দিকে, পাইন গাছের বন শেষ হয়ে বাশবন শুরু হল। বেশ সুন্দর ছোট ছোট বাশ দুইপাশে আর মাঝে দিয়ে হাটার রাস্তা। একা হলেও বেশ উপভোগ করছিলাম। আর ভয় তেমন একটা ছিলনা, কারণ রাস্তা একটাই। হাঁটতে থাকলে একসময় ঠিকই গন্তব্যে পৌঁছে যাব। আর দুই একটা কনফিউজিং জায়গায় রিকজেন মাটিতে ডিরেকশন একে গেছে যাবার সময়, তাই খুব একটা দুশিন্তা হল না। তবে ব্যাগটা আর বইতে পারছিলাম না, কাঁধ এবং ঘাড়ে প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছিল। প্রায় ৪০ মিনিট জংগলের মধ্যে দিয়ে একা হাটা-নামা করতে করতে একসময় বাঁশবনের মধ্যে একটা খোলা জায়গা পেলাম, যেখানে বাকিরা শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। কোন মতে ব্যাগটা রেখে পানি খেলাম। তবে আর ব্যাগটা নিয়ে হাঁটতে পারছি না, তাই আমার ব্যাগটা পুর্বা নিল, আর পুর্বার টা রিকজেন।

কাঁধ থেকে বোঝা নামিয়ে বেশ হাল্কা হয়ে গেলাম। তবে পুর্বার কাঁধে ব্যাগটা দেয়াতে একটু খারাপও লাগছিল, গাইড হোক, ছেলেটা আমার চেয়ে বয়সে ৪-৫ বছর ছোট, জাস্ট এই কারণে গত দুইদিন পুর্বা নিজে থেকেই ব্যাগ নিতে চাওয়ার পরেও ব্যাগ দেইনি। আজ একবারে না পেরেই দিলাম। তবে কাঁধে ব্যাগ নিয়েও এই পথ দিয়ে ছুটে ছুটে একটু সময়েই দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। শুধুই তো নামের শেষে শেরপা টাইটেল না, তার একটা ব্যাপার সেপার ও আছে!

দল এখন দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে গেল - পুর্বা, রিকজেন, দিপু, রাহাত আগে আগে চলে গেল আর আমি, নাহিদ ভাই, জাহিদ ভাই পিছে পড়লাম। পরবর্তি এক দেড় ঘণ্টায় আর তাদের দেখা পেলাম না। রাস্তা যেন আরও খারাপ এবং ঢালু হয়ে গেল। বাকগুলোও ছোট হয়ে গেল, তাই কষ্টটা দিগুণ হয়ে গেল। একটু পরে পাহাড়ের এক পাশ থেকে নিচের জনবসতি দেখে মনে একটু শান্তি পেলাম। তবে এই শান্তির জায়গায় পৌছাতে আরও প্রায় আধ ঘণ্টা নিচে নামতে হল। তারপর পৌঁছে গেলাম খুব সুন্দর সাজানো গোছানো এক গ্রাম গুরদুম এ।

জায়গাটা এত সুন্দর যে একদিন থেকে যেতে খুব ইচ্ছা হল। প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছিল, তাই গিয়েই তাড়াতাড়ি খাবারের অর্ডার করলাম। খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে এই জায়গাটা, একটা রেস্টুরেন্ট আর অপরদিকে থাকার জায়গাটা বেশ। বড়িগুলো নীল-সবুজ রঙ করা আর অনেক ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো।

এখানে এসে গত কয়েকদিনে দেখা হওয়া দুইটা গ্রুপের সাথে আবার দেখা হয়ে গেল। কথা বলে মনে হল আমরা বেশ আগেই এসেছি এতোটা পথ। গত কয়েকদিনের সবচেয়ে ভাল খাওয়া হল। পুর্বা বলল যে এবার একটু তাড়াতাড়ী হাটা লাগবে কারণ সন্ধ্যার আগেই সেপি গিয়ে থাকার জায়গা ফাইনাল করতে হবে, যদিও পুর্বা ফোন করে বলে দিয়েছে আমাদের কথা।

হাঁটুতে মুভ স্প্রে লাগানোতে ব্যাথা একটু সময়ের জন্য কমে গেল। তারপর একটু দ্রুত গতিতে নিচে নামা। অনেক উপর থেকে যেই ঝরনার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল সেটায় পৌঁছে গেলাম একসময়। খেয়েই হাটাহাটি করায় ঘেমে একাকার সবাই। তবে মেজাজটা খারাপ হল যখন দেখলাম ঝর্না পার হবার পর আবার বেশ খানিকটা উপরে উঠা লাগবে দেখে।

একটু উপরে উঠে একটা গ্রাম আসল - টিম্বুরি, গ্রামের প্রতিটি বাড়িই খুব সুন্দর করে সাজানো। ঘরবাড়ীগুলোর পাশেই আবার নানা রকম সবজির চাষ। আসলে এই ছোট্ট গ্রামটার লোকেশনটাই খুব ভাল লাগল, কয়েকটা হোমস্টেও আছে।

এই গ্রামের শেষ মাথায় গিয়ে বেশ খানিটা উপরে উঠা, তাই একটু থামলাম একটা রেস্ট নেয়ার জায়গায়। সেখানে এক লোকাল দাদার সাথে কথা হল। বললেন যে ২০০৮ পর্যন্ত সে শহরে ছিলেন, তার পরিবার স্বজন সবাই এখন শহরে, কিন্তু তার ভাল লাগে না শহরের জীবন তাই আবার এই জায়গাতেই ফিরে এসেছেন। কোন অফিস নাই, বাস মিস হবার টেনশন নেই, স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারেন, অসুখ ও কম হয় এখানে। দাদার কথা শুনে ভাল লাগল।

কিছুদূর উপরে উঠেই সুন্দর পিচঢালা রাস্তা পেয়ে গেলাম, অনেকক্ষণ পর হেঁটে কস্ট হচ্ছেনা তেমন, তাই বেশ ভাল লাগছিল। তবে রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলে বলে মনে হল না। কেন চলেনা সেটা বুঝলাম রাস্তার শেষ এ গিয়ে, পাহাড় ধস হয়ে রাস্তার যেই অংশটা নিচের রাস্তার সাথে সংযুক্ত ছিল, সেটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আর পাশ দিয়ে খাড়া খাড়া সিঁড়ী নিচে নেমে গেছে। এই শেষ এ এসে এমন কষ্টদায়ক সিঁড়ী বেয়ে নিচে নেমে কতক্ষণ বসে থাকা লাগলো।

অনেক কষ্ট, অনেক ধরনের অনুভূতি, কিন্তু আমরা শ্রীখোলা পৌঁছে গেছি, আমাদের সেই অনেকদিনের প্লান করা ট্রেক ঠিকঠাক শেষ করতে পরেছি এই আনন্দ বলে বোঝানো যাবেনা। শ্রীখোলার বিখ্যাত সেই ব্রিজে সবাই বিজয়ীর বেশে ছবি তুললাম।

প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মেইন রোড দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেলাম দেড় কিলোমিটার দুরে সেপিতে। আমাদের জন্য জায়গা বুক করা ছিল প্রিতম’স হোমস্টে। সেখানে তিনটা দল এক হয়েছে। সাথে সবার গাইড। একটু রেস্ট নিতেই রিকজেন এসে বলল, আজকে তো এঞ্জয় করার দিন, ট্রেক শেষ, সবাই বাইরে যেতে।

বাইরে গিয়ে দেখলাম সাইন্ডবক্স লাগানো, একটা বনফায়ার করার জায়গায় আগুন জালানো হয়েছে। আমরা ১ কেজি মুরগি বারবিকিঊ করার জন্য বললাম।

তারপর পুর্বা, রিকজেন, আমরা সবাই আগুনের সামনে বসেই অনেক আড্ডা। আর চিকেন বারবিকিউ করার দায়িত্ব গাইড দুইজনেরই। রিকজেন এইসব রান্না বান্নায় বেশ পারদর্শি। আমাদের একটু লোকাল ওয়াইনও টেস্ট করা হল। তারপর শুরু হল একটু গান নাচ, গাইডরা সহ। রিকজেন বলল যে এই কয়দিনে সারাদিন রাত একসাথে ছিলাম আমরা, এরপর হয়তো সারাজীবনেও দেখা হবে না, আজ তাই সবাই মিলে মজা মাস্তি করবো আমরা। আমাদের সাথে সেই পাগলাটে এবং মজা করার গাইড দাওয়া এসে যোগ দিল।

একমুহুর্তের জন্য মনে হল আসলেই এই জায়গা থেকে চলে গেলে এই মানুষ গুলোকে মিস করবো খুব। পাহাড়ে আমাদের মতন মানুষ শুধু টাকা দিয়েই কোন ঝামেলা ছাড়াই নিশ্চিন্তে ঘুরাফেরা করতে পারে এই মানুষগুলো থাকার কারণে।

গত কয়েকদিনে চুপচাপ থাকা রিকজেন আজকে একদম চালু, কত কত কথা তার। আমরা বেশ মজা নিয়েই তার সাথে গল্প করলাম। পুর্বা বরাবরের মতই মিতভাষী। খুব ভাল সময় গেল আসলে। অনেক অনেক দিন মনে থাকবে এই দিন, এই সন্ধ্যার কথা।

কাল সকালে ৫:৩০ এ জিপ আসবে, আমাদের গন্তব্য দার্জিলিং। অনেক ধরনের মিশ্র অনুভূতির নিয়ে এই ট্রেক এর কথা ভাবতে ভাবতে হেলে পড়লাম গভীর ঘুম এ ...

দিন ০

দিন ১

দিন ২

দিন ৩

দিন ৪

দিন ৫

দিন ৬ এবং শেষ

--

--