সবুজ পাহাড়ের খোঁজে

বগালেক এবং কিউক্রাডং ভ্রমণ

Nowshad
tripsharebd

--

বৃহস্পতিবার, ১০ জানুয়ারি রাতে ঢাকা থেকে বান্দরবানের বাসে উঠে পড়ি আমরা ৮ জন। সকাল ৬ টার দিকে পৌছিয়ে অটো করে সোজা রুমা থানচি গামী বাস স্টেশনে। সেখান থেকে রুমার ৭টার বাসের টিকিট কেটে পাশের হোটেলে সকালের নাস্তার পালা চুকিয়ে নিলাম।

বান্দরবান থেকে রুমা প্রায় ২:৩০ ঘণ্টার রাস্তা। তবে পাহাড়ের বুক দিয়ে আঁকাবাঁকা হয়ে চলা এই রাস্তার জার্নি বেশ ভালই। একটু পর পর ছোট ছোট লোহার ব্রিজ এবং পথের বাক। পথে দুইটা চেকপোস্ট এ টুরিস্টদের নাম এন্ট্রি করা লাগে।

রুমা বাজার পৌঁছে আগে থেকে ঠিক করে রাখা গাইড নিউটন দাদার সাথে দেখা হল। সেখানের আর্মি চেকপোস্ট এ রেজিস্টার করে, একটা ফর্ম ফিলাপ করে জিপ ভাড়া করা হল কমলা বাজার পর্যন্ত। এই রাস্তাটা বেশ উঁচু নিচু, পথে আরেকটা চেকপোস্ট এ নাম এন্ট্রি করা লাগল। ১ ঘণ্টার মতন লাগে কমলা বাজার পৌঁছাতে।

আগে প্লান ছিল কমলা বাজার থেকে হেঁটে যাওয়া হবে বগালেক, কিন্তু হাটার ট্রেইলটা বন্ধ এবং গাড়ীর রাস্তা হেঁটে উঠার জন্য বেশি খাঁড়া। তাই একটা গাড়ীতেই আরেক গ্রুপের সাথে শেয়ার করে উপর পর্যন্ত উঠা হল। রাস্তাটা খুবই খাঁড়া। ভয়ে ছিলাম এত মানুষ নিয়ে উল্টে না যায়। তবে শেষমেশ নিরাপদেই চলে গেলাম।

গ্রুপের কয়েকজনের আগে এখানে আসা হলেও আমার জন্য প্রথমবার। বগালেকের পাশের ঠাণ্ডা বাতাসটা বেশ ভালই লাগছিল। চেকপোস্টে নাম এন্ট্রি করার চলে গেলাম সিয়াম দিদির সাথে কথা বলে ঠিক করা রাখা কটেজে। একদম লেকের পাড়ে দুই রুমের একটা কটেজ, বাঁশের তৈরি দেয়ার এবং ফ্লোর। বারান্দার ভিউটাও খুব সুন্দর। সবাই গিয়ে বারান্দায় শুয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ।

কটেজের পাশ থেকে দেখা ভোরের বগালেক

সবারই ক্ষুধা পেয়েছিল, তাই হাতমুখ ধুয়ে চলে গেলাম খাবার খেতে। সিয়াম দিদির এখানে খাবার ব্যাবস্থা খুব ভাল। তবে সবারই যেটা বেশি ভাল লাগল সেটা হচ্ছে পেয়াজের একটা সালাদ টাইপের (সম্ভবত পেয়াজ, শুকনো মরিচ, লবণ, সরিষার তেল — দিয়ে বানানো একটা জিনিস) খাবার। পেট ভরে খেয়ে কটেজের সামনে লেকের পাড়ে ঘুরেফিরে দেখা হল। তবে ফিরে এসে বারান্দায় শুয়ে থাকাটাই বেশি আরামের মন হল।

বিকেলে রোদ একটু কমলে আসে পাশে হাঁটতে বের হলাম। লেকের অন্য পাশে যাওয়া নিষেধ ছিল, কিন্তু আমি একা হাঁটতে হাটতে চলে গিয়েছিলাম বাকিরা আমার পেছনে ছিল, কিন্তু পরে আর কেউই আসেনি। এই সাইড থেকে লেকের ভিউটা অনেক সুন্দর, পেছনে উঁচু পাহাড়, লেকের পাড়ে মাচাং ঘরগুলো বেশ সুন্দর লাগছিল দেখতে। বেশ খানিক্ষন চুপ করে বসে ছিলাম। তারপর ফিরে এসে সবার সাথে লেকের পাড়ে সন্ধ্যা কাটালাম। (যেহেতু যাওয়া সেনাবাহিনীর নিষেধ তাই, ওখানে না যাওয়াই ভাল)

বগালেকের অন্যপাশের ভিউ

রাতে চিকেন বারবিকিউ এর ব্যবস্থা করা হয়েছে, সবকিছু নিউটন দাদাই করলেন। তাই আমরা আগে ভাগেই ভাত খেয়ে নিলাম। তারপর কটেজের একদম সামনে পাথর দিয়ে ঘিরে একটা আগুন জালানোর জায়গা করে সেখানেই সব ব্যাবস্থা। ঠাণ্ডার মধ্যে এভাবে তারা ভরা আকাশের নিচে আগুন জ্বালিয়ে সবাই মিলে গান করার মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলাম অনেকক্ষণ।

খাওয়া-দাওয়া আর গল্পগুজব করতে করতে সবাই ক্লান্ত। তাই এদিনের মত ঘুম। তবে রাতে ঠাণ্ডায় একটু কষ্টই হল। বাঁশের ফ্লোর এবং দেয়াল হওয়ায় ফাঁক ফোকর দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসে ভেতরে।

ভোর ৪ টায় ঘুম ভেঙ্গে গেল, বাইরে বেরুলাম, ঘুটঘুটে অন্ধকার, চারিদিকে কোন সাড়াশব্দ নেই। তাই আবার ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে ৫টার দিকে আবার উঠলাম, নিজে ফ্রেশ হয়ে বাকিদের ডাকলাম কারণ আমাদের প্লান ছিল আজ সকাল সকাল ট্রেক শুরু করবো যাতে রোঁদের মধ্যে কষ্ট কম হয়। কিন্তু কিসে কি, একজন একজন করে উঠতে উঠতে সেই ৭ টাই বেজে গেল।

সবাই উঠলে সিয়াম দিদির ওখানে গিয়ে পেট ভরে খিচুড়ী-ডিম খেয়ে নিলাম। এমন পেট ভরা অবস্থায় হাঁটা কষ্ট, তবে ট্রেকিং এর জন্য ভাল করে খাওয়াও দরকার। আর্মি চেকপোস্টে এন্ট্রি করে কিউক্রাডং এর পথে যাত্রা শুরু।

প্রথমে ১-২ কিলোমিটার গাড়ীর রাস্তা, তাই একটু কষ্টই হল। এরপর অফরোড ট্রেকিং। যেকোন ট্রেক এই অফরোড বেটার, গাড়ীর রাস্তা কিংবা পাথরের রাস্তায় হাঁটুর উপর প্রেশার বেশি পরে। তাই মাটীর রাস্তা পেয়ে বেশ ভালই লাগছিল হাঁটতে। পুরো ট্রেক এ একদম খাঁড়া অংশ বেশ কম। উঠা নামা আছে, তাই বেশ সহজ ট্রেকই বলা যায়। কিছুদূর যেয়ে একটু নিচে একটা ঝিরি, এর নামই চিংড়ি ঝর্না। শীতের সময় বলে অল্পই পানি, পাহাড়ে খাবার পানির উৎস হচ্ছে এমন ছোট ছোট ঝিরি। হেঁটে একদম উপর পর্যন্ত গেলাম, জায়গাটা বেশ ঠাণ্ডা বলে ভালই লাগছিল বসে থাকতে।

চিংড়ি ঝর্না এবং দার্জিলিং পাড়া

বিশ্রাম শেষে আবার হাঁটা, পথে পাহাড়ী পেঁপে খাওয়া হল। দার্জিলিং পাড়ায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। বেশ ছিমছাম একটা গ্রাম। এখান থেকে কিউক্রাডং স্পষ্ট দেখা যায়। খাঁড়া রাস্তাটাও দেখা যায়। বেশ কাছেই মনে হল।

তো আবার হাঁটা শুরু করার বেশ কিছুক্ষণ পরই পৌঁছে গেলাম কিউক্রাডং! এখানে হোটেল আছে একটা, সেখানে গোছল করার বাবস্থা আছে টাকার বিনিময়ে। ঠাণ্ডা পানি এবং পাহাড়ের রোদ — এই মিলিয়ে মিশিয়ে গোসল সেরে নিয়ে বেশ ফ্রেশ লাগছিল। এরপর সেখানে বসেই খেয়ে নিলাম। এখানের খাবার আসলে বগালেকের মতন ভাল না, আর দামটাও একটু বেশি।

কটেজে চলে গেলাম, খুবই সুন্দর ভিউ এখানে। একটা ঘরে আমরা ৮ জনের জায়গা হল, ঘরটায় ঠাণ্ডা কমই লাগে, তাই মনে হল আজকে ঘুম ভালই হবে।

কিউক্রাডং এর কটেজ এবং সুর্যাস্ত

বিকেল ৪ টায় সব গ্রুপ চলে গেল আর্মির ক্যাম্পে। সেখানের অফিসার আমাদের কিছু নিয়ম কানুন এবং সেফটির ব্যপারে ব্রিফ করলেন এবং আমরা নাম রেজিস্টার করলাম।

তারপর চলে এলাম হেলিপ্যাডে। এখানে ৬টার পর থাকা নিষেধ। তাই আমরা সুর্যাস্ত দেখে চলে এলাম। শেষবিকেলের সোনালি আকাশ, পাহাড়ের গায়ে মাখামাখি — এ এক অপরূপ দৃশ্য।

কটেজে এসে বারান্দায় সবাই মিলে গল্পগুজব করতে করতে খাবার সময় হয়ে গেল। হোটেলে গিয়ে খেয়ে নিলাম। তারপর আবার কটেজের সামনে এবং বারান্দায় আড্ডা। আমার বেশ ঘুম পেয়েছিল বলে আগে আগে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ভোর ৫টায় উঠলাম, কটেজের দরজা খুলেই হুহু করে বাতাস শরীরে লাগল। ঠাণ্ডায় যেন ঝড় হচ্ছে এমন জোরে বাতাস বইছে। তখনো আকাশ ভরা তারা। তাই দরজা খুলেই কতক্ষণ বাইরের চুপচাপ নীরবতা উপভোগ করলাম। দুই একজন আরও মানুষজন উঠল সুর্যদয় দেখার জন্য। এবার আর অন্ধকারে হেলিপ্যাড পর্যন্ত যেতে ভয় নেই, তাই গিয়েই ক্যামেরা সেট করলাম টাইমল্যাপস করার জন্য। অদ্ভুত সুন্দর সূর্যদয়।

কিউক্রাডং এর হেলিপ্যাড এ সূর্যোদয়

সকাল সকাল আমাদের ফেরা লাগবে তাই ফর্মালিটি সেরে নামা শুরু। নামার রাস্তাটা বেশ সহজ, খুব তাড়াতাড়ি নেমে গেলাম। চিংড়ি ঝর্নায় এসে প্রায় ৪০মিনিট বসে ছিলাম। তারপর আবার নেমে যাওয়া।

বগালেক এসে সিয়াম দিদির ওখানে খেয়ে নিলাম দুপুররের খাবার। তারপর সব হিসেব নিকেশ চুকিয়ে, ক্যাম্পে নাম কেটে দিয়ে, কমলা বাজার পর্যন্ত হেঁটে নামা।

এইটুকু রাস্তা একদম খাড়া যেটা আসার সময় গাড়ি দিয়ে এসেছিলাম। নামার সময় এত কষ্ট হল যেন দুইদিন হেঁটেও এত কষ্ট হয়নি। একটু দাঁড়ানোর জায়গা নেই, একবার নামা শুরু করলে আর থামার উপায় নেই, আর খুব সাবধানে নামতে হয়ম একটু এদিক সেদিক হলেই দুর্ঘটনা ঘটার চান্স আছে।

তো নিচেই আমাদের গাড়ি অপেক্ষা করছিল। সবাই ক্লান্তি আর পায়ে ব্যাথা নিয়েই উঠে পড়লাম গাড়ীতে। তারপর আবার ছুটে চলা।

রুমা বাজার গিয়ে চেকপোস্টে চেকআঊট করে নিউটন দাদাকে বিদায় জানালাম। তারপর বাসে বান্দরবান। ঢাকার বাসের টিকিট কেটে একটু লোকাল খাবার এর দোকানে ঢু মারলাম। তারপর রাতের বাসে ঢাকা।

বন্ধু Nayeem Reza’র লিখা দিয়ে শেষ করি

বগালেকের চিরচেনা মুখগুলো সেই আগের মতই আছেন। সর্বদা হাসিখুশি থেকে আন্তরিক আতিথেয়তায় আমাদের মুগ্ধ করে যাচ্ছেন। তবু তাদের মনের কোথায় যেন একটুকরো বিষাদের মেঘ জমে আছে আর সেটা বাইরে থেকে আমরা সহজেই স্পর্শ করতে পারছিলাম। অহেতুক আর অযৌক্তিক সব বিধি নিষেধের বেড়া জালের মাঝে পাহাড়ের সেই উন্মুক্ত প্রশান্তিটুকু এবার মন থেকে আর অনুভূত হয়নি।

ভয় হয়! ভাল থাকবে তো আমাদের এই সবুজ পাহাড়, নীল আকাশ ও এর মানুষেরা?

--

--