সিকিম: দ্যা লস্ট কিংডম | পর্ব ০

ঢাকা - চ্যাংড়াবান্ধা - শিলিগুড়ি - গ্যাংটক

Nowshad
tripsharebd
6 min readFeb 27, 2019

--

অফিস থেকে এক মাসের ছুটি নিয়েছি, কাজ করতে করতে একটু ক্লান্তি জেঁকে বসেছিল তাই। প্রায় অর্ধেক মাস তো শুয়ে বসে আরাম করেই কেটে গেল। আর বহু আকাঙ্খিত সিকিম ট্যুরও আসন্ন। শেষমেশ আমরা দল হলাম ৫ জনের - আমি, নাইম, মইন, মোত্তাকিন, ফয়সাল। অফিসের ছুটির একটু গরমিল থাকার সিদ্ধান্ত হল যে আমি আর ফয়সাল, বাকিদের দুইদিন আগেই রওনা হয়ে ঘুরবো এদিক সেদিক, তারপর বাকিরা গেলে সবাই একসাথে মূল ঘুরাঘুরির পর্ব শুরু হবে।

তো, দেখতে দেখতে সেই বহু প্রতিক্ষিত সময় হাজির, ১৫ ফেব্রুয়ারি রাত ৯:১৫, কল্যাণপুর, এস আর পরিবহনে চেপে রওনা হলাম চ্যাড়াবান্ধার উদ্দেশ্যে। তবে বহু প্রতিক্ষিত বলার কারণটাও জানা যাক -

ব্যাকগ্রাউন্ড হিস্ট্রি

২০১৮ এর প্রথম দিকের কথা, তখনও দেশের বাইরে পা রাখা হয়নি। তাই গুগল ম্যাপে আর ইউটিউবের সাথেই ঘুরে বেড়াতাম।একদিন বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছাকাছি কোথায় বরফ আর বরফে ঢাকা পাহাড়-পর্বত দেখা যাবে তা খুঁজতে খুঁজতে গুগল ম্যাপে চলে গেলাম স্বপ্নরাজ্য সিকিম

ইউটিউবে ভিডিও আর গুগল সার্চ করে বেশ একটা ট্যুর প্লান বানিয়ে ফেললাম। তারপর আরেকটু গুগল করেই জানলাম এক দুঃখজনক তথ্য - বাংলাদেশিদের জন্য সিকিম একরকম নিষিদ্ধ!

এত কাছে স্নো পিকড মাউণ্টেন, হাই এল্টিটিউড লেক কিছুই দেখা যাবে না জানার পর ভেবেছি যে যদি কখনও অনুমতি পাওয়া যায়, তবে অবশ্যই সিকিম যাব। তো এই ভাবনার মধ্য দিয়েই তখনকার মতন সিকিম পর্ব শেষ।

২০১৮ এর অক্টোবর এ সান্দাকফু থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে মনে হয়েছে, আরও কাছে থেকে দেখা দরকার এবং সিকিম থেকেই সেটা সম্ভব। তখন পারমিট এর বেপারে একটু আধটু কথা বার্তা শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু কোন কিছুই শিওর না। তবে আমি মনে মনে খুব চাচ্ছিলাম যাতে বাংলাদেশিদের জন্য পারমিট দেয়া হয়।

২০১৮ এর ডিসেম্বর সম্ভবত, সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশিদের সিকিম এর পারমিট দেয়া। আমার এতদিনের ইচ্ছা, এবার তো যাওয়া চাই ই।তখন থেকেই প্লান, ট্যুরমেট খোজা, আর দিন গুনতে থাকা।

Source: https://www.mapsofindia.com/maps/sikkim/sikkim-district-map.jpg

সিকিম পরিচিতি

সিকিম ভারতের একটি প্রদেশ/স্টেট। পশ্চিমে নেপাল, উত্তরে চীনের তিব্বত, পূর্বে ভুটান হওয়ায় অবস্থানগত দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ন ও একটু স্পর্শকাতর। ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যাবার পর সিকিম স্বাধীন রাজ্য থাকলেও ১৯৭৫ সাথে এটি ভারতের ২২ তম রাজ্য হিসেবে যুক্ত হয়।

সিকিমের চারটি ডিস্ট্রিক - ইস্ট, ওয়েস্ট, সাউথ, নর্থ। সবগুলো ডিস্ট্রিকেরই রয়েছে নিজস্ব রাজধানি। এই ডিস্ট্রিক গুলো ভাগ হয়েছে পুরাটাই ভিন্ন ভিন্ন পাহাড়ি নদীকে ঘিরে। ছোট ছোট শহরগুলোর অবস্থান ও নাম, রাস্তাঘাট, প্রায় সবকিছুই হয়েছে এসব ছোট বড় নদীকে ঘিরে। আর এই সব পাহাড়ি নদী মিশেই তৈরি হয়েছে তিস্তা।

সিকিম হচ্ছে ভারতের একমাত্র গ্রিন স্টেট। এখানে একদিকে যেমন পরিষ্কার পরিচ্ছন, অন্য দিকে প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর এমন বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করা হয়। সেটা বিদ্যুৎ উৎপাদনই হোক, কিংবা চাষাবাদই হোক। এমনকি বাইরে সিগারেট খাওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সিকিমের পাওয়ার হাউস হচ্ছে এর বুকে বয়ে চলা পাহাড়ী নদীগুলো। অনেক গুলো ছোট বড় বাধ চোখে পড়ে পুরো সিকিম জুড়েই।এগুলো থেকে টারবাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, এই বিদ্যুৎ অনেক ভেতরের পাহাড়ি গ্রামেও পৌঁছে গেছে।

ভ্রমণের জন্য সিকিম আসলেই খুব ভাল একটা লোকেশন।একদিকে যেমন সবুজে ভরা ছিমছাম ছোট ছোট পাহাড়ি শহর ও গ্রাম, অন্যদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে থাকা লেক এবং বরফে ঢাকা পাহাড়! আর কাঞ্চনজঙ্ঘাও সবচেয়ে ভাল দেখা যায় সিকিম থেকেই। তবে বিদেশীদের সিকিম ভ্রমণ একটু নিয়মকানুনের মধ্যে করতে হয়, এমনকি ভারতীয়দেরকেও কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়।

দ্যা জার্নি

ভোর বেলায় বাস বুড়ীমারি বর্ডারে পৌঁছানোর কথা থাকলেও মাঝে টায়ার এর সমস্যার কারণে এক ঘণ্টা দেরি হয়ে আর রাস্তায় জ্যামের কারণে বর্ডারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৯ টার বেশি বেজে গেল। এত মানুষ সিকিম যাচ্ছে, প্রচন্ড ভিড় আর দালালের হাত ছাড়া বর্ডারের কাজ শেষ করার কোন উপায় নেই। নিজে নিজের ফর্ম লিখে সব কাজ করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোন লাভ হলনা, শেষমেশ দালালকে ২৫০/= টাকা দিয়েই আমাদের সাইডের ফর্মালিটি শেষ হল। ভারতের সাইডের অর্থাৎ চ্যাড়াবান্ধা বর্ডারে টাকা লাগল ১০০/= কিন্তু তাদের ব্যাবহার এবং সার্ভিস অনেক ভাল এবং দ্রুত।

বর্ডারে মানি এক্সচেঞ্জে শুধু বাংলা টাকা থেকে রূপিতে কনভার্ট করলাম, ডলার পরে ভাঙ্গাবো বলে। যেহেতু আমরা মাত্র দুইজন তাই এখান থেকে গাড়ি রিজার্ভ নিবনা। এখানেই বাংলাদেশি আরও দুইজনের একটা গ্রুপ এর সাথে দেখা হয়ে গেল। দুইজনই বয়সে আমাদের চেয়ে বড়, তবে বেশ কথা বার্তা বলেন। তো মানি এক্সচেঞ্জের দাদা বললেন অটোতে বাইপাস গিয়ে বাসে শিলিগুড়ি চলে গেলে তাড়াতাড়ি হবে এবং খরচও কম হবে। তাই অটোতে করে বাইপাস গিয়ে বাসের অপেক্ষা। কিন্তু বাসে আসলে এখান থেকে সীট পাওয়া কঠিন, তাই আরেক অটোতে করেই কাছেই চ্যাড়াবান্ধা রেল স্টেশনে চলে গেলাম। ২৫ রুপির শিলিগুড়ির ডেমো ট্রেনের টিকিট কাটলাম, ১৫-২০ মিনিট পর ট্রেন আসল। ভারতের ট্রেন ভালই, আগের বারের অভিজ্ঞতাও বেশ। ট্রেনের অনেকটাই ফাঁকা, আমাদের অটো ওয়ালা বলেছিল দেড় ঘণ্টা লাগবে। আমরা বেশ ইঞ্জয় করছিলাম ট্রেন জার্নি। তবে এই দেড় ঘণ্টা পর ট্রেন পৌছল অন্য এক স্টেশনে যেখান থেকে ট্রেন উলটো পথে চলা শুরু হল। আমরা একটু কনফিউসড, আর সিম বা ইন্টারনেট না থাকায় ম্যাপেও দেখতে পারছিলাম না কিছু। একে ওকে জিজ্ঞেস করে জানলাম আরও দেড় ঘণ্টা লাগবে শিলিগুড়ি জংশন যেতে!

চ্যাংরাবান্ধা রেল স্টেশন
ট্রেনের পথে চা বাগান | | ধূলিঝড় এর আগ মুহুর্ত

আমাদের এমনিতেই একটু তাড়া কারণ আজই গ্যাংটক যেতে হবে, কিন্তু বাস দেড়ি করেছে, এখন আবার ট্রেন ও দেরি! মাঝে মাঝে থেমে থাকা, আবহাওয়া খারাপ, ইত্যাদি ইত্যাদি দেখতে দেখতে এই ট্রেন শেষমেশ শিলিগুড়ি গিয়ে পৌঁছায় বিকেল ৪ টায়! আমাদের তারাহুড়া, তবে সিম একটা কিনতেই হবে। তাই এয়ারটেল এর একটা সিম স্টেশনের সামনের থেকেই কিনে পাওয়ার আপ করে নিলাম।

শিলিগুড়ি জংশন

আমার ইচ্ছা ছিল আজকে কালিম্পং চলে যাব, কাল সকাল কালিম্পং ঘুরে তারপর গ্যাংটক যাব। কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়ায় কালিম্পং এর শেয়ার্ড গাড়ি ছিলনা, আর গ্যাংটকেরও শেষ দিকে ছিল গাড়ি। তাই গ্যাংটকেরই শেয়ার্ড জিপে চেপে বসলাম সামনের দুই সীটে।

রাস্তাটা মনে হল বেশ সুন্দর, কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় তেমন কিছুই বুঝলাম না। শিলিগুড়ির একটু আগেই শুরু হল বৃষ্টি, আর ঠাণ্ডা বাতাস। বেপারটা বেশ ভালই লাগছিল আমার। দেখতে দেখতে রাস্তা একটু উঁচু নিচু হওয়া শুরু হল। আর দূরের পাহাড়ের গায়ে জেগে থাকা জোনাকি পোকার মতন ঘরবাড়ির বাতিগুলো দেখতে বেশ ভালই লাগছিল।

প্রায় ৮ টার দিকে আমরা পৌছাই সিকিমের প্রবেশদ্বার রংপো চেকপোস্টে।গাড়িতে উঠার সময় ড্রাইভারের সাথে কথা হয়েছে যে এখানে থামাবে এবং ওয়েটিং চার্জ ১০০ রুপি পার হেড দিতে হবে, অর্থাৎ আমাদের গাড়িভাড়া পার হেড ৩৫০ রুপি।

রংপো অফিশিয়ালি বন্ধ ৮টা থেকে, কিন্তু তখনোও বেশ অনেকজন টুরিস্ট পারমিট এর জন্য ওয়েটিং, তাই কর্মরত অফিসার ফোন করে আরেকজনকে আনালেন কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য। তাদের আন্তরিকতা দেখে খুব ভাল লাগলো, অফিস টাইমের পরেও নিজেরা ফর্ম লিখে সবাইকে পারমিট দিয়ে তারপর অফিস বন্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

রংপো পারমিট অফিস

চল্লিশ মিনিট লেগে গেল পারমিট নিতে নিতে, তখনো গাড়ির বাকি যাত্রীরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, কেউ আমাদের নিয়ে কোন চিল্লাফাল্লা করেনি। মনে হল সিকিমের মানুষ খুব ধৈর্যশীল এবং এর প্রমাণ পরে আরও পেয়েছি। রাত হয়ে যাওয়ায় রাস্তা প্রায় ফাঁকাই, গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে চলল, আর ঠাণ্ডা হাওয়ায় আমার মনে সিকিম প্রবেশের সুখ!

গ্যাংটক পৌছালাম রাত ১০:৩০ এ। ৮টায় এখানের সব বন্ধ হয়ে যায়, সেই হিসেবে এখানে এখন রাত অনেক।গাড়ি থেকে নেমেই ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটায় টের পেলাম যে টেম্পারেচার ৫ ডিগ্রি এর নিচে। আসেপাশের দোকান-পাট সব কিছু বন্ধ, রাস্তায় তেমন একটা মানুষজনও নেই। সিকিমের সাথে সিকিমের বাইরে আসা যাওয়ার যে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, সেটা মূল গ্যাংটক শহরের বেশ নিচে। সেখানে নেমে আমরা আজকে আর উপরে না গিয়ে, ট্যাক্সি স্ট্যান্ড এর পাশেই একটা হোটেলে চেক ইন করলাম। প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছিল, তাই একটু হাতমুখ ধুয়ে আমরা হোটেলে খাবার কথা বললাম। হোটেলের কিচেন বন্ধ, আর বাইরেও হোটেল বন্ধ, হোটেল এর স্টাফ কোথা থেকে যেন আমাদের জন্য ভাত, ডাল, বেগুন তরকারি আনলেন। যদিও এইটুকুর দাম ১৭০ রুপি, তবে এত দেরিতে খাবারের ব্যাবস্থা হওয়াতেই আমরা খুশি।

হোটেলে আরেকটা বাংলাদেশি গ্রুপ ছিল ৪ জনের, আমাদের সাথের দুইজন তাদের সাথে মিলে গেল নর্থ সিকিম যাবার প্যাকেজে। আর আমরা দুইজন যাব কাল ওয়েস্ট সিকিমের শহর পেলিং। পেলিং যাবার স্বপ্ন আর সিকিম পৌঁছানোর স্বস্তি নিয়েই ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ঘুমিয়ে পড়লাম এদিনের মতন।

--

--