সিকিম: দ্যা লস্ট কিংডম | পর্ব ১

গ্যাংটক - জোরথাং - পেলিং - জোরথাং - গ্যাংটক

Nowshad
tripsharebd
10 min readFeb 27, 2019

--

সকাল ৬টায় ঘুম ভাঙ্গল, এই ঠাণ্ডায় গিজারের গরম পানি দিয়ে বেশ আরাম করে গোছল সেরে নিলাম। রেডি হয়ে আমি আর ফয়সাল হোটেলের বিল পরিশোধ করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম গ্যাংটক এর উপরের দিকের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড এ। এখানে সিকিমের ভেতরে চলা ট্যাক্সির স্ট্যান্ড। আমরা পেলিং যাবার জন্য শেয়ার্ড ট্যাক্সি খুঁজলাম, কিন্তু জানা গেল ১২টার আগে কোন শেয়ার্ড ট্যাক্সি নেই, আর রিজার্ভে গেলে ৪০০০-৫০০০ রুপি খরচ হবে।তাই ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। একে ওকে জিজ্ঞেস করে সাজেশন পেলাম জোরথাং যাবার, সেখান থেকে পেলিং যেতে হবে। গ্যাংটক থেকে জোরথাং এর ভাড়া জনপ্রতি ১৭০ রুপি।

জোরথাং গ্যাংটক থেকে বেশ দুরে, প্রায় ২:৩০-৩:০০ ঘণ্টার পথ। তবে বেশ সুন্দর রাস্তা, আর নদী ধরে চলা রোড।আগেরদিন সন্ধ্যার পর হওয়ায় এই রাস্তাটুকু কেমন সেটা দেখা হয়নি। কখনও উঁচুতে উঠে গেছে, আবার কখনও নিচুতে একবারে নদীর পাড়ে নেমে গেছে রাস্তা।মাঝে মাঝেই ছোট ছোট গ্রাম, তবে সবই খুব সাজানো গুছানো। মজার ব্যাপার হচ্ছে গ্যাংটক থেকে জোরথাং যেতে হলে রংপো চেকপোস্ট দিয়ে সিকিম এর বাইরে বেড়িয়ে আবার মেলি চেকপোস্ট দিয়ে সিকিমের ভেতর ঢুকতে হয়।

মেলি যাবার আগে একটা হোটেলে যাত্রা বিরতি দেয়া হয়। অনেক রকম খাবার পাওয়া যায়, আর দামও কম। ভেজ চাওমিন দিয়ে সকালের নাস্তার পর্বটা চুকিয়ে নিলাম। তারপর আবার যাত্রা।

মেলি পর্যন্ত রাস্তা ডাউনহিল ছিল মূলত, আর এর পর আবার আপহিল।পাথুরে পাহাড়ের পাশে কেটে কেটে রাস্তাগুলো বানানো হয়েছে, খুব বেশি চওড়া নয়, আর এইসব রাস্তা কিছুদিন পর পরই মেরামত করতে হয় ভূমিধ্বস এর জন্য, মাঝে মধ্যে রাস্তা বন্ধও থাকে।

কাঁচা ও সরু রাস্তা || পাহাড়ি নদী

পাহাড় দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম জোরথাং এ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩২২ মিটার উঁচুতে অবস্থিত খুব ছোট্ট এবং গোছানো শহর জোরথাং। এক দেখাতেই আমাদের ভাল লেগে গেল। তবে প্রথমে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গিয়ে পেলিং এর শেয়ার্ড জিপ এর টিকিট কাটলাম, যাত্রী হয়ে যাবার পরেও এখানে সময় অনুযায়ীই গাড়ি ছাড়ে, যা দেখে একটু অবাকই হলাম (পরে এর কারণ জানতে পেরেছিলাম)।

জোরথাং মল রোড
আকার ব্রিজ এবং নদী

আমাদের হাতে সময় ১:৩০ ঘণ্টা। তাই আশপাশ ঘুরে দেখার জন্য হাঁটা শুরু করলাম। পাহাড়ি ছোট বড় অনেক শহরেই শনিবার শপিং ডে, মল রোড ব্যাস্ত, মানুষেরও আনাগোনা বেশ, ভাল বড় দোকান ই কি আর সরু গলির দোকান ই কি, সবই ব্যাস্ত কেনা বেচায়। আর এটা সেটা খাবারেরও অভাব নেই। কিন্তু রাস্তাগুলো খুব গোছানো এবং পরিষ্কার। তবে এতকিছুর মাঝেও আমার মন সেই নদীর পাড়েই। অলিগলি খুঁজে পেয়ে গেলাম নদীর ধারে নামার রাস্তা। নদীর পানি এত পরিষ্কার আর সুর্যের আলোয় নীল-সবুজ রঙটাও আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠে। বেশ কিছুক্ষণ নদীর পারে কাটিয়ে উঠে এলাম উপরে। এই নদীর উপর দিয়ে একটা ব্রিজ গেছে যার নাম আকার ব্রিজ। এই ব্রিজটাই মূলত সাউথ সিকিম আর ওয়েস্ট সিকিমকে যুক্ত করেছে, এপাশে জোরথাং হচ্ছে সাউথ সিকিমের লাস্ট পয়েন্ট। ব্রিজের উপরেও বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আশপাশটা উপভোগ করলাম। সাথে একটা ছোট্ট সাজানো পার্কও আছে দেখলাম। তবে এত দেখাদেখিতে ক্ষুধা পেয়েছিল, তাই হানা দিলাম স্ট্রিট ফুড এর দোকানে। পানি পুরি, চানা চাট, মম, পাকোড়া, ডিম চপ, সামুসা - আরও হরেক রকম খাবারের পসলা সাজানো আছে। এসব খেয়ে দোকানে গিয়ে আবার আমার প্রিয় অ্যাপি ফিজ খেলাম।

স্ট্রিট ফুড

খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে গাড়ীতে গিয়ে বসলাম।গাড়ীতে মানুষজন আগে থেকেই বসে আছে অন্য যারা ছিল। একটা জিনিস খেয়াল করলাম এখানে লেট হওয়াটা খুব স্বাভাবিক এবং লোকাল মানুষরা এতে তেমন কিছু মনে করেনা।

এবারের রাস্তাটা আগের মতন খুব ভাল না, প্রায়ই আধাকাচা এবং ভাঙ্গা রাস্তা, তাই গাড়ির গতিও কম। তবে এত দুর্গম যায়গায়ও মানুষ কিভাবে এসে শহর গড়ে তুলল সেটা ভাবতে ভাবতে একটু অবাক হতেই হল। পথে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে একটা টানেল ও পরল প্রায় আধা কিলোমিটারের মতন।একটু পরেই গাড়ী নদীর পাড় থেকে আরও উপড়ে উঠে যেতে শুরু করল। ছোট ছোট ছিমছাম জনবসতির মাঝে দিয়ে যাবার সময় মনে হল এমন শান্তির জায়গায় এসে মাঝে মাঝে থাকা গেলে হয়তো খুব ভাল থাকতাম।

প্রায় ৪ টার দিকে আমরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২১৫০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত খুব ছোট্ট এবং গোছানো শহর পেলিং পৌছাই। পেলিং এর উপরের পাশটায় না থেকে আমরা লোয়ার পেলিং এ চলে এলাম একটু হ্যাপেনিং টাইপের জায়গার খোজে। উঠে পড়লাম Mochilero Ostello নামক একটা হোটেলে।একটু দেখে শুনে ৯০০ রূপিতে একটা রুম নিলাম, গিজার সহ বেশ বড় এবং ভাল থাকার জায়গা।হোটেলটার ডেকোরেশন একটু ভুটান এর হোটেল কিংবা ছোট ছোট মন্সাট্রি এর আদলে করা। ডর্ম বেড এরও ব্যাবস্থা আছে এখানে।

Mochilero Ostello || Lower Pelling

হোটেলের মালিককে বেশ ভাল লাগলো, ভাল ইংরেজি বলেন এবং নিজেও ট্রাভেলার। তিনি আমাদের সাজেস্ট করলেন স্কাই ওয়াক এবং হেলিপ্যাডে চলে যাবার জন্য, স্কাই ওয়াক সম্পর্কে একটু তথ্য ভুল দিলেন যদিও।
মাত্র ১৫-২০ মিনিট লাগবে বলেছিলেন, কিন্তু আমরা অনেকক্ষণ হাটার পর দেখলাম সামনে খাঁড়া পাহাড়ি রাস্তা, তাই চলে গেলাম হেলিপ্যাডে। এই আপার পেলিং এ একটা ফুটবল মাঠও দেখতে পেলাম। বেশ কিছু দামি হোটেল আছে। হেলিপ্যাডে চারদিক খোলা থাকায় ঠাণ্ডা বাতাস।আসে পাশে বেশিরভাগটাই মেঘ তবে পড়ন্ত বিকেলের একটু রোদ কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় পড়ার দৃশ্য অসাধারণ লাগছিল।

হেলিপ্যাড থেকে দেখা Upper Pelling

হেলিপ্যাডের পাশেই একটা হোমস্টে আর ক্যান্টিন আমরা ঢুকে ম্যাগি অর্ডার করলাম। এখানের বারান্দার ভিউটা খুবই সুন্দর, একবারে পুরো পেলিং শহরটা দেখা যায়। বারান্দায় বসে ধোয়া উঠা ম্যাগি খেতে খেতে পরিবেশটা উপভোগ করছিলাম বেশ। খেয়ে দেয়ে নেমে এলাম নিচে, আসার পথে আপার পেলিং ভাল করে দেখয়ে নিলাম। মাঝে একটা খাবার দোকানে বসে দোসা খেলাম, তারপর মসলা চা খেয়ে হেঁটে হেঁটে চলে এলাম হোটেলে।

রাতের Mochilero Ostello

ঠাণ্ডা বেশ বাইরে, তাই হোটেলের মালিক, তার বন্ধু, আর পাশের হোটেলের ম্যানেজার আমার হোটেলের বারান্দায় আগুন জ্বালিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন, আমরাও আড্ডায় বসে পড়লাম। কথায় কথায় জানা গেল হোটেলের মালিক শিলং এর লোক এবং এখানে একটু ডিফারেন্ট একতা হোটেল, ক্যাফে করতে চান যেখানে নাইট লাইফ থাকবে যেটা পাহাড়ের প্রায় সবখানেই মিসিং। কথা বলতে বলতে আমাদের হোটেলে সন্ধ্যার নাস্তা করার জন্য উত্তর প্রদেশ থেকে ঘুরতে আসা সদ্য বিবাহিত এক জুটির সাথেও বেশ খানিক্ষন আড্ডা হল। পেশায় আমাদের সাথে তাদেরও মিল থাকার ভালই হচ্ছিল কথা বার্তা। জানলাম যে উনারা প্রায় অনেকদিন ধরেই সিকিমে ঘুরছেন এবং বেশ কিছু জায়গায় যেতে পারেননি খারাপ আবহাওয়ার কারণে।

আন্ডারগ্রাউন্ডে খাবার যায়গা, ভবিষ্যৎ ক্যাফে

এখন টুরিস্ট সিজন না হওয়ায় বেশিরভাগ হোটেলেই খুব একটা মানুষজন নেই। আমাদের হোটেলেও আমরাই শুধু গেস্ট। তাই হোটেলের স্টাফরা হোটেল এর নতুন ডেকোরেশন এর কাজে এ ব্যাস্ত। প্রায় ৮:৩০ পর্যন্ত গল্প আড্ডা শেষে ভাত ডাল শাক চাটনি দিয়ে ডিনার সেরে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। রাতে টেম্পারেচার বেশ নিচে নেমেছে বলে কয়েকবার ঘুম ভেঙ্গেছে ঠাণ্ডায়।

ভোর বেলায় ঘুম ভাঙল।উঠে ফ্রেশ হয়ে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে গেলাম কাছেই থাকা ভিউ পয়েন্টে। দূরের শুভ্র পর্বতমালার উপর সূর্যের প্রথম কিরণ, মনে হয় কেউ যেন সোনায় মুড়িয়ে রেখেছে। আর কাঞ্চনজঙ্ঘার রীতিমত দানবীয় আকার বুঝা যাচ্ছিল। সামনে একটা বিশাল সবুজ পাহাড় যদিও ভিউ অনেকটাই ব্লক করে রেখেছে, তবুও দুইপাশ দিয়েই যা দেখা যাচ্ছে তা ই অপরূপ। তবে আসেপাশের মেঘ এর কারণে বুঝাই যাচ্ছিল যে এই দৃশ্য বড়জোর ৫-১০ মিনিট থাকবে এবং হলও তাই। একটু পরেই কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া ঢেকে গেল মেঘের আড়ালে। তবে আসে পাশের আরও উঁচু পর্বতগুলোও দেখে ভাল লাগছিল।

মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা

ভিউ পয়েন্ট থেকে চলে গেলাম একটা শর্টকাট ধরে আপার পেলিং এ। সেখান থেকে সোজা স্কাই ওয়াক এর রাস্তায়, আর কাউকে সে রাস্তায় হাঁটতে দেখলাম না যদিও। আগেরদিন এই পথেই মাঝামাঝি এসে ফিরে গিয়েছিলাম। তবে আজকে এই খাঁড়া পাহারটায় উঠব বলেই সিদ্ধান্ত নিলাম, আস্তে আস্তে উঠা শুরু করলাম, তবে পথ যেন শেষই হয় না।ঠিক এক ঘণ্টা পর পৌছালাম সেখানে।

একটা পাহাড়ের চুড়া, সম্ভবত পেলিং এর সবচেয়ে উঁচু পয়েন্ট। সেখানে একটা বিশাল মনাস্ট্রি- Sanghak Choeling Monastery। এখানে এখন যে বিশাল মনাস্ট্রি রয়েছে সেটা নতুন করে করা, পর্যটকদের আনাগোনা সেখানেই। তবে পুরাতন মনাস্ট্রিটা একটু আগেই সেখানে মনাস্ট্রির বেশিরভাগ কাজ হয়ে থাকে।

বিদেশীদের জন্য এখানে এন্ট্রি ফি ৫০ রুপি যাতে স্কাই ওয়াকও আছে। বেশ আধুনিক যায়গা বলতে হবে, আর্কিটেকচার এর দিক দিয়েও এবং প্রযুক্তিগত দিক দিয়েও। প্রায় সবখানেই দেয়ালে আটা সাউন্ডবক্সে প্রার্থনা চলছে। উপরে বিশাল একটা গোল মঞ্চ টাইপের যেখানে হয়তো বড় কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। আর মূল উপাসনালয় এ উঠতে অনেকগুলো সিঁড়ি উঠতে হয়। খুব সুন্দর কারুকার্য সবখানেই। ছোট বড় অনেক আকারের প্রেয়ার হুইল। আর মূল উপাসনালয় এর ভেতর প্রায় চারতলা প্যাঁচানো সিঁড়ি রয়েছে। সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় দেখলাম দেয়ালের সুন্দর সুন্দর কারুকার্য। বুদ্ধের অনেক রকম মুর্তি দেয়ালের খোপে খোপে বসানো রয়েছে।

মনাস্ট্রি এবং গ্লাস ওয়াক

মনাস্ট্রি থেকে নেমে স্কাই ওয়াক এ চলে আসলাম। যেহেতু কাচের ফ্লোর, তাই জুতা খুলে চলতে হয়, আর এই ঠাণ্ডায় পায়ের নিচের কাচ যেন বরফ এর মতন ঠাণ্ডা হয়ে আছে।যাদের হাইটফোবিয়া আছে তাদের জন্য বেশ এডভেঞ্চারাস হবে স্কাই ওয়াক। খুব বড় না, হাফ সার্কেল সাইজের গ্লাস ওয়াক তৈরি করা হয়েছে। আর আবহাওয়াও বেশ, ঝলমলে রোদ, মাঝে মাঝেই কাঞ্চনজঙ্ঘা উকি দিচ্ছে। তবে আমাদের আবার নিচে নামতে হবে তাই বেরিয়ে এলাম।

এখন নিচে নামাটা আরেকটা কষ্টকর ব্যাপার, তারমধ্যে আমাদের একটু তাড়াও আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানে যারা এসেছে সবাই গাড়ী রিজার্ভ করে এসেছে, সো শেয়ার করে যাবার উপায়ও নাই। তাই ভাবলাম এক কোলকাতার কাঁপল এর গাড়িতে ফাঁকা আছে দেখেছি, তাদের কাছে লিফট চাইবো। কাছে গিয়ে বললাম আপার পেলিং পর্যন্ত লিফট দেয়া যাবে কিনা, দাদা একটু আপত্তি করতে চেয়েছিলেন মনে হয়, কিন্তু দিদি রাজি হয়ে গেলেন। আমরা দুইজনে তাদের গাড়িতে চড়ে চলে গেলাম নিচে। তারপর হোটেলে গিয়ে দেখলাম ব্রেকফাস্ট এর টাইম আপ। আমরা তাই, ব্যাগ গুছিয়ে চলে গেলাম আপার পেলিং ট্যাক্সি স্ট্যান্ড এ।

আজ আমাদের সন্ধ্যার মাঝেই গ্যাংটক পৌঁছানো লাগবে।তাই তাড়াও একটু বেশি, তবে পেলিং থেকে সরাসরি গ্যাংটক এর শেয়ার্ড জিপ হাতে গোনা কয়েকটা। আমরা পেলাম না, আগে থেকে জানা ছিলনা বলে। তাই ৫০ রুপি দিয়ে চলে গেলাম ওয়েস্ট সিকিম এর রাজধানী গেইজিং এ। সেখানের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড এ গিয়ে আরেক সমস্যা, গ্যাংটক এর পরবর্তী গাড়ি আরও এক ঘণ্টা পর। ততক্ষণ অপেক্ষা করবো না তাই ভেঙ্গে যাবার চেষ্টা করলাম, তবে ছোট যে রুট সেখানের গাড়ির টিকিট শেষ, তাই যে পথে এসেছি সেই পথেই ব্যাক করার সিদ্ধান্ত নিলাম, অর্থাৎ গেইজিং - জোরথাং - গ্যাংটক। তবে এটা যে একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল সেটা টের পেয়েছি পরে।

পেলিং থেকে ১ ঘণ্টা চলার পর এক জায়গায় সব গাড়ি থামল। দেখলাম রোড কন্সট্রাকশন চলছে। জানতে পারলাম এখানে গাড়ী ১ ঘণ্টা দাঁড়াবে! এমনিতেই দেরি, তার মধ্যে আরও দেরি! তবে এবার ড্রাইভারের সাথে কথা বলে ক্লিয়ার হলাম ব্যাপারটা। এখানে বেশিরভাগ দিনই নিদিষ্ট কিছু সময় কিছু রুট এ রোড এর কাজ হয় এবং সেই সময়টা ওই রুট বন্ধ থাকে, আর এ জন্যই গাড়ী ভরে যাবার পরেও সময়ের আগে গাড়ি ছেড়ে যায় না।

তো, দেরি যখন হবেই আর কি করার, গাড়ী থেকে নেমে একটু চিপস খেতে খেতে দেখলাম যে পাশেই নদীর উপর দিয়ে একতা ঝুলন্ত ব্রিজ আছে, সেখানেই যাব বলে নিচে নেমে গেলাম। স্বচ্ছ পানির পাহাড়ি নদী, আর পাথর। বেশ ভালই লাগছিল, তাই নদীর কাছে বসেই অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলাম। অপেক্ষার এক ঘণ্টাও কেটে গেল। তারপর ফিরে এসে আবার গাড়ি ছুটল।

পাহাড়ি নদী এবং ঝুলন্ত ব্রিজ

জোরথাং এসেও দেখলাম একই সমস্যা, মেলি রোড ৪:৩০ পর্যন্ত বন্ধ, তখন বাজে ২:৩০ এর মতন। আর গাড়িও নেই গ্যাংটক এর তেমন, তবে কয়েকজন টিকিট কেটে ফেরত দেয়ায় আমাদের কপালে শেষ গাড়িটার টিকিট মিলল। তারপর আশপাশ থেকে কিছু খেয়ে এলাম এবেলা ক্ষুধা নিবারণের জন্য। যাবার সময় মল রোড সরগরম থাকলেও আজ নেই। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এসে গাড়ীতে উঠে বসলাম, গাড়ি আধঘণ্টা পর ছাড়ল। কিন্তু আবারো সেই একই দশা - আধ ঘণ্টার রাস্তা এসে Kitam Bird Sanctuary এর সামনে এসে রাস্তা বন্ধ কন্সট্রাকশন এর জন্য। সেই জ্যাম ছাড়ল প্রায় ৫ টার দিকে।

কিতাম বার্ড সাংচুয়ারির সামনে জ্যাম

মাঝে আবহাওয়াও বেশ খারাপ ছিল, একটু ঝড় আর ধুলা। আগের বার পাশে নদীতে গিয়ে সময় কাটানোর অপশন থাকলেও এবারে দাঁড়িয়ে বসে সময় কাটানো ছাড়া আর উপায় ছিল না। জ্যাম ছাড়তেই গাড়ি আবার ছুটে চলল সোজা গ্যাংটক। তবে গ্যাংটকে ঢুকতে একটু দেরিই হল ট্রাফিক এর কারণে।

গ্যাংটকে একেতো ঠাণ্ডা, অন্যদিকে বৃষ্টি। আমাদের বাকি তিনজনও আগেরদিন রাতে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে এখন প্রায় গ্যাংটক এর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বলে জানাল। আমরা তাই মল রোডে (MG Marg) চলে গেলাম হোটেল খুঁজতে।বেশ কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে আধাভেজা হয়ে হোটেল দেখলাম, আর ততক্ষণে বাকিরাও চলে এল। এখন আমরা ২ থেকে ৫ জনের গ্রুপ। উঠে গেলাম Hotel Bayul এ। ১৬০০ রূপিতে দুই রুমের একটা রুম, একটায় বড় বেড আরেক রুমে একটা ম্যাট্রেস এবং সোফা। মল রোডের একদম সাথে হোটেল, জানালা দিয়ে বাইরে দেখলে রাস্তার ব্যস্ততা দেখা যায়।

বৃষ্টিভেজা রাতের MG Marg

খুব ক্ষুধা পেয়ে গেছিল সবারই, তাই একদম সাথেই থাকা মহারাজা হোটেলে গিয়ে আলু পরোটা খেয়ে এবেলার মতন ক্ষুধা নিবারণ করা গেল।ততক্ষণে গ্যাংটক এর ঘুমিয়ে পড়ার সময় হয়ে গেছে। তাই আমরাও ফিরে এসে হোটেলে যে যার মতন শুয়ে পড়লাম, আর রাজ্যের ক্লান্তিমাখা ঘুমে হারিয়ে গেলাম।

--

--