সিকিম: দ্যা লস্ট কিংডম | পর্ব ৩

লাচুং, নর্থ সিকিম

Nowshad
tripsharebd
7 min readFeb 27, 2019

--

সকাল সকাল সবাই উঠে ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে বের হয়েছি নাস্তা করতে। একটা ছোট্ট দোকানে দেখা গেল অনেক রকম আইটেম পাওয়া যায় লুচি-সবজি, ফ্রাইড রাইস, মম এসব খেয়েই ব্রেকফাস্ট। ততক্ষণে জানলাম আমাদের পারমিট হয়ে গেছে নর্থ সিকিমের।আমাদের গাইড হোটেলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

নর্থ সিকিমে ভ্রমণের জন্য সবারই রেজিস্টার্ড এজেন্সির মাধ্যমে যেতে হয়। বিদেশীদের জন্য একজন গাইড আবশ্যক। আমাদের গাইডের নাম পাসাং শেরপা ডাকনাম অর্জুন। বয়স কম এবং বেশ উৎফুল্ল বলে কথা বার্তা বেশ ভালই জমলো।

সবাই ব্যাগ নিয়ে নেমে গেলে হোটেলে নর্থ সিকিম ২ দিন ১ রাতের প্যাকেজের জন্য ১৬৫০০ রুপি দিয়ে আর হোটেলের বিল চুকিয়ে চলে গেলাম আমাদের গাড়ীর ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। আজকেও আমাদের গাড়ী Innova। পরিচয় হল আমাদের ড্রাইভার প্রশান্ত (বাংলায় উচ্চারণটা ভাল লাগেনা, ইংরেজিতে Prasant)। খুবই বিনয়ী এবং ব্যাবহার ভাল। বয়স অর্জুনের মতই।

জার্নি শুরু, আর মনের ভেতর ভাললাগাও শুরু, এট লাস্ট যাচ্ছি নর্থ সিকিম! আমরা পথে একটু সুন্দর জায়গা দেখলেই থামাতে বলি, নামি, দেখি, ছবি তুলি। এই জার্নিতে জানালার পাশের সীট এর দাম অনেক। তাই আমরা একটু পর পর পালাপাল্টি করে জানালার পাশে বসেছি।

পাহাড়ি রাস্তা, কখনও উঁচু কখনও নিচু, কখনও ছোট ছোট গ্রাম এর ভেতর, আবার কখনও দূরের স্নো পিকড মাইণ্টেনের ভিউ, কখনও দুই পাহড়ের মাঝে ছোট-বড় ব্রিজ, আবার কখনও ভূমিধ্বসে ক্ষতিগ্রস্থ বিপদজনক রাস্তা - এমন জার্নিতে সত্যিই ক্লান্তি আসে না।

আমরা এরপর দাঁড়াই সেভেন সিস্টার্স ওয়াটার ফলস এ। এর আগে মেঘালয়ের একই নামের ঝর্নায় দেখেছি সাতটা শাখা বলে এই নামকরণ, কিন্তু এখানে মনে হয় এক সিস্টার ছাড়া বাকিরা কোথাও বেড়াতে চলে গেছে! তবে এইখানে দুটো দোকান আছে যাতে হাবিজাবি খাবার পাওয়া যায়, পাকোড়া, সমুসা, চাট, ইত্যাদি খেয়ে আপাতত ক্ষুধা মেটালাম, খেতেও দারুণ।

একটা বেপার না বললেই না, নর্থ সিকিমকে প্লাস্টিক মুক্ত জায়গা বলা হয়। এমনকি পুরো সিকিমের প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত।ওয়ান টাইম প্লেটগুলো কিছু আছে শুকনো পাতার তৈরি আর কিছু কাগজের। যারা যেখানে যাই বিক্রি করছে সবার কাছেই একটা ডাস্টবিন থাকটা এখানে মাস্ট। আর পুরো সিকিম জুড়েই সচেতনতামূলক সাইনবোর্ড রয়েছে সবখানে - তাতে ধূমপান, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, সড়ক আইন, শিক্ষা, ইত্যাদি বিষয়ে নানা কথা লিখা।

পথের মাঝের একটা ছোট্ট শহর আমার খুব ভাল লাগলো - নাম মাঙ্গান (Mangan)। একদম ছিমছাম ছোট একটা শহর, যার একপাশ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ আরও কিছু পাহাড়ের প্যানারমিক ভিউ পাওয়া যায়। সময় নিয়ে আসলে এই শহরে একদিন হয়তো থাকা যেত।

পথে অনেকগুলো ঝর্না দেখা গেল, একদম ছোট থেকে শুরু করে বড় ঝর্নাও, কোন কোনটার উচ্চতা অনেক বেশি, আবার কোন কোনটা পাহাড়ের গা গড়িয়ে গড়িয়ে চলে গেছে অনেক নিচে।

দুপুরের কাছাকছি সময় আমরা দাঁড়াই চুংথাং হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্লান্ট বাধ এ। অপরূপ সুন্দর নদী আর তাতে থাকা স্বচ্ছ নীল পানি সামনা সামনি না দেখলে ভাবতাম ফটশপ করা ছবি! কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করলাম, কিন্তু ঠাণ্ডা বাতাসে জমে যাবার অবস্থা। তাই গরম গরম চা খেয়ে একটু শরীর গরম করে আবার উঠে বসলাম গাড়িতে।

চুংথাং থেকে আর কোন ব্রেক নেইনি। সোজা চলে গেছি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৭০০মিটার উপড়ে অবস্থিত লাচুং এ।পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর নাম ধরেই এই জায়গার নামকরণ। আমাদের জন্য নির্ধারিত হোটেল - ফ্রোজেন ভ্যালি।নতুন হোটেল, আমাদের গাইড আগে আসেনি তাই একটু খুঁজতে হল, নদীর এপাশ ওপাশ আধঘণ্টা খোজার পর দেখা পেলাম হোটেলের, একদম হেলিপ্যাডের সাথেই। তবে ম্যাপ কাজ করছিলনা সেখানে, সম্ভবত আর্মি এরিয়ার সাথে হওয়ায় জিপিএস ব্লক করা তাই গুগল ম্যাপে অদ্ভুত একটা মেসেজ দেখাল।তবে চারিপাশে স্নো পিক আর উঁচু পাহাড়ের মাঝে ছোট ছোট জনবসতির লাচুং দেখতে সত্যিই অসাধারণ লাগছিল। আমার অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল এমন একটা ভ্যালিতে থাকার, সেটা পূরণ হচ্ছে ভেবে খুব ভাল লাগছিল।

হোটেলে ব্যাগ রেখে ম্যাগি বানাতে বললাম, আর সন্ধ্যার আগেই পাশের লাচুং নদীর ধারে চলে গেলাম। ঠাণ্ডাটা যে একটু বেশি সেটা ভালই টের পাচ্ছিলাম।তবে চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাঝে এমন স্বচ্ছ সুন্দর নদীর পাড়ে বসে থাকতেও বেশ ভালই লাগছিল। সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে ফিরে আসি হোটেলে। হোটেলের ডাইনিং আন্ডারগ্রাউন্ডে। সেখানে বসে গরম গরম ম্যাগি খেতে একদম অমৃত লাগছিল।

হোটেলের দায়িত্বে যিনি ছিলেন হোটেলটি তার দিদির, মুম্বাইয়ের লোক, ভাল রান্না করেন। আমরা খেয়ে দেয়ে একটা রুমে গিয়ে সবাই কম্বলের নিচে ঢুকলাম। আমাদের সাথে অর্জুন আর প্রশান্ত ও এল রুমে। আমরা নিজেরা এবং ওঁদের সাথে বেশ অনেক গল্প করা হল। সিকিমে যেহেতু ট্যুরিজমই মূল উপার্জনের উৎস, তাই অনেকেই পেশা হিসেবে এটাকেই বেছে নেয়। আর সিকিম ভারতের আওতাভুক্ত হবার সময় যেসব পরিবারের সরকারি ফর্মাল কাগজপত্র করেছে তারাই সরকারি চাকুরীতে প্রাধান্য পায়।এই কারণে এখানে লেখাপড়ার হার ভাল থাকলেও ডিগ্রীর খুব একটা ব্যবহার জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশের কাছেই নেই।

রাতের খাবারের সময় হলে আমরা ফুলকপির সবজি, ডাল, ভাত, চাটনি দিয়ে পেট ভরে খেয়ে নিলাম। কাল সকাল ৬ টায় বের হবো ইয়ামথাং ভ্যালির উদ্দেশ্যে।

৫টায় ঘুম ভাঙ্গল, বাইরে তখনো অন্ধকার। আর টেম্পারেচার মাইনাসে। ঠাণ্ডা পানি ধরে মনে হল হাতগুলো যেন জমে গেল, তাই গিজার চালু করে একটু পানি গরম হলে সেটা দিয়েই হাতমুখ ধুলাম। বাকিদের ডেকে তুলে সবাই রেডি হয়ে নিলাম। সবাই উঠতে উঠতে একটু আলো হলে আমি একটু বাইরে থেকে ভোরের লাচুং দেখে এলাম।হোটেল থেকেও দূরের পাহারগুলো দেখা যাচ্ছিল। আমাদের গাইড আর ড্রাইভার দুজনেই রাতে একটু বেশি চিল করার কারণে উঠতে পারেনি তাই আমরাই ডেকে তুললাম। তারাতারি ওরা রেডি হলে গাড়ি নিয়ে সবাই রওনা হলাম ইয়াম্থাং ভ্যালির উদ্দেশ্যে।কাছেই একটা আর্মি চেকপোস্ট। সেখানে আমাদের ছাড়া আর একটি গাড়ী দাঁড়িয়ে। দুটি গাড়ীকেই একসাথে যাবার অনুমতি দেয়া হল।

অতিরিক্ত স্নোফল এর কারণে এখন ইয়ামথাং পর্যন্ত যাওয়া যায় না সেটা আগে থেকেই জানতাম।গাড়ি আপহিলে উঠছে, আর এখানে কোন জনবসতিও নেই।মাঝে একটা ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড আছে। যে কয়টা বাড়িঘর ছিল আগে, সবগুলোর চাল বরফের আবরণে ঢাকা।

আমাদের থামতে হল চেকপোস্ট থেকে ১০ মাইল দূরে।তবে এখানেই রাস্তার উপর এবং দুইপাশে বরফ। সকাল সকাল এসেছি বলে আমরা মাত্র দুই গাড়ী মানুষ। তাই পুরো জায়গাটাই এখন আমাদের দখলে। নিজেরা নিজেদের মতন স্পট বেছে নিলাম। আমরা একটু উপড়ে উঠে অন্য গ্রুপটা থেকে দূরে চলে গেলাম। জীবনে প্রথমবারের মতন এমন স্নো দেখা, আর চারপাশে সব সাদা। পাহাড় গাছ সবই সাদা বরফে ঢাকা। আর সেই বরফে ঢাকা চূড়াগুলোর উপর সুর্যের আলো এসে পড়ছে, সেই আলো মেখে একদম সোনালি রঙ ধারণ করছে - এ এক অপরূপ দৃশ্য।

কতক্ষণ বরফ নিয়ে ছোড়াছুড়ি আর আশপাশ ঘুরাঘুরি করতে করতে মানুষজনে ভীড় ভালই হল। তাই আবার গাড়ীতে উঠলাম। হোটেলে ফিরে এসে ব্রেকফাস্ট করে ফেরার জার্নি শুরু। ফিরে আসার জার্নিটা একটু তাড়াতাড়িই যাচ্ছিল। তাই একটু ব্রেক এর দরকার ছিল, সেটা নিলাম চুংথাং এর হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্লান্ট এর নদীর ধারে। একটু নিচে একটা সাস্পেনশন ব্রিজ আছে নদীর উপর। পুরো ব্রিজটা নানান রঙের প্রেয়ার ফ্ল্যাগে সাজানো, দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল। আর ব্রিজের উপর থেকে নদীটাও দেখতে অসাধারণ।নিচ থেকে দেখতে কেমন সেটা দেখার ইচ্ছা হচ্ছিল, কিন্তু সোজা কোন রাস্তা নেই, আর নিচে যায়গাটা একদম নিরাপদও না যেহেতু বাধ মাঝে মাঝে খুলে দেয়া হয়। তবে এই বেলা নিরাপদই মনে হওয়ায় এদিক সেদিক বেয়ে নেমে গেলাম নিচে। নিচে নদীর কাছে গিয়েও দেখলাম পানির রঙ একি রকম লাগে। আর দুইদিকের পাহাড়ের মাঝ দিয়ে দূরের উঁচু স্নো পিক গুলো দেখা যায়।

পুরো ট্রিপ এ একটা বিষয় আমাদের খুব ভাল লাগল, অর্জুন আর প্রশান্ত এর গানের প্লেলিস্ট। ভাল মিউজিক টেস্ট ওয়ালা মানুষের সাথে জার্নিও ভাল হয়। কখনও সবাই মিলে সুইট চাইন্ড ও মাইন, আবার কখনো ব্রায়ান এডামস এর সামার অফ সিক্টি নাইন, আর নেপালি হাওয়া চল সিরিরি তো একদম সবারই মনে রাখার মতন ক্যাচি একটা গান।

নদীর ধারে কিছুক্ষণ থেকে আবার গাড়ীতে। মাঝে সেই সেভেন সিস্টারস ফলস এর সামনে চাট, পাকোড়া, সমুসা খেয়ে নিলাম। গ্যাংটক এসে পৌছালাম বিকেল ৪ টায়। হোটেলে গিয়ে একটু হাতমুখ ধুয়ে যে যার মতন হাল্কা কেনাকাটায় বেড়িয়ে পড়লাম।

কেনাকাটা শেষে আজকেও ভাবা একটা ভাল জায়গায় খেতে হবে। তাই MG Marg এর মাঝামাঝি OSM নামে একটা সুন্দর রেস্টুরেন্টে চলে গেলাম। দেখতে বেশ পশ জায়গাই লাগছিল, তাই ভঁয় হচ্ছিল যে গলা কাটা দাম না হয় আবার। কিন্তু মেন্যু দেখার পর স্বস্তি পাওয়া গেল, তাই ওর্ডার হল নির্ভয়ে — ধনিয়া মুরগ, সাংহাই রাইস নুডলস, ভেজ পোলাও, মুরগ মাখনি, জিরা রাইস, ইত্যাদি। পাঁচ জনেই পেট ভরে খেলাম, বিল হল ~ ১৫০০ রুপি।

তো পেট শান্তি করে হোটেলে এসে কথা বললাম। গত এক সপ্তাহে কেউ সাঙ্গু লেক এর রুট এর পারমিশন পায়নি খারাপ আবহাওয়ার কারণে। তারপরেও ওয়েদার আপডেট দেখলাম যে পরদিন আবহাওয়া ভাল থাকবে, তাই যদি পারমিশন হয় তাহলে যেন আমাদের প্যাকেজের ব্যাবস্থা করা হয়। ফিঙ্গারস ক্রসড।

--

--