সিকিম: দ্যা লস্ট কিংডম | পর্ব ৪

ছাঙ্গু লেক — কালিম্পং — ঢাকা

Nowshad
tripsharebd
7 min readFeb 27, 2019

--

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ গুছিয়ে নাস্তা করে নিলাম। এই কয়দিনে আজকেই প্রথম MG Marg এ রোদ পাওয়া গেল একটু আধটু। কিন্তু পারমিট এখনো হয়নি, হোটেলের অন্য গ্রুপগুলো বেড়িয়ে গেল, আমরা লবিতে ওয়েট করলাম। প্রায় ১০ টার কাছাকাছি সময়ে অর্জুন আসল পারমিট নিয়ে।

আমরা বাগ ট্যাগ নিয়ে উঠে পড়লাম গাড়ীতে। একবারে চেকআউট করে হোটেল থেকে বের হলাম কারণ অলরেডি ৩ রাত গ্যাংটক থেকেছি, আর ভাল লাগছে না এক জায়গায়। তাই সিদ্ধান্ত হল যে আজ ছাঙ্গু লেক ঘুরে সোজা কালিম্পং চলে যাব।

ছাঙ্গু লাস্ট কিছুদিনে কেউই যেতে পারেনি। যে একদিন রুট খোলা ছিল সেদিন ১৫ মাইল পর্যন্ত যাবার পারমিট ছিল। তবে আজকের একদম চকচকা রোদ দেখে মনে হল আরও কিছুদূর যাওয়া যাবে।এই রাস্তাটা একদম খাড়া পাহাড়ের পাশ কেটে উপরে উঠে গেছে। ছাঙ্গু লেক এর এল্টিটিউড ১২০০০ ফিট এরও বেশি। তাই এই ২৩ কিমি রাস্তাটিই প্রায় ১৫০০ মিটারের বেশি এল্টিটিউড গেইন করেছে।

হাই এল্টিটিউড ট্রাফিক জ্যাম

এই রাস্তায় আজ অনেক গাড়ী, কিছুদিন পর পারমিট পাওয়ায় আর একটু বেলা হয়ে যাওয়ায় বেশ জ্যাম রাস্তায়। তার উপর একটা জিপ উল্টে গিয়ে কিছুক্ষণ গাড়ি চলাচলে সমস্যা হয়।রাস্তার প্রায় অনেক আগে থেকেই চারিদিকে বরফ।যেদিকে চোখ যায় শুধু সাদা আর সাদা।তো বেশ কিছুক্ষণ চলার পর এক জায়গায় একটা খাবার দোকানের সামনে গাড়ী থামল। আমরা গরম গরম ম্যাগি খেয়ে নিলাম। আশেপাশে একটু আধটু ছবি তুলে আবার গাড়ীতে।

পিপড়ার মতন মানুষের ভিড়

সামনের রাস্তা ক্লিয়ার থাকা সত্ত্বেও আমাদের ১৫ মাইল এর Kyangnosla Market এর একটু পরে নামিয়ে দেয়া হল। সেখানে তখন পিপড়ার মতন মানুষ আর মানুষ। বরফ দেখে পাগল হয়ে গেছে টাইপের অবস্থা। এর মধ্যে অনেক টুরিস্টই আমাদের দেশের। আমরা যেহেতু আমাদের দেশে বরফ দেখি নাই, তাই এই মাঝপথে নামিয়ে দিলেও আমরা তেমন একটা আপত্তি করিনা, বরফ দেখেই সব ভুলে যাই। এই সুযোগটা অনেক ট্রাভেল এজেন্সি আর ড্রাইভারই নেয়। আমি আর মইন ঠিক করলাম যে হেঁটেই যাব ছাঙ্গু, এখানে থেকে ৮ কিমি রাস্তা, ১ ঘণ্টার একটু বেশি লাগতে পারে যেহেতু আপহিল আর এত উচ্চতায়।

হাটার পথের মাঝে যেখানে আর কোন টুরিস্ট নেই

দুইজনে হাটা দিলাম, বাকিরাও পেছনে বেশ কিছুদূর এল। উপরে উঠছি আর মানুষের ভিড় কমছে, একসময় পথে আমরা দুইজন ছাড়া আর কেউ নেই। কোলাহল থেকে দুরে এসে চারদিকে সাদা বরফে আবৃত সবকিছু, দেখতে বেশ ভাল লাগছিল। মাঝে মধ্যে দুই একটা গাড়ী উপড়ে উঠছে নামছে, এর মধ্যে আর্মির গাড়িও রয়েছে। তো অনেকদূর হেঁটে দুইজন ইন্ডিয়ান আর্মির সাথে কথা হল, তারা বলল সেখান থেকেও আরও ৩ কিমি হাঁটতে হবে। যেহেতু এল্টিটিউড অনেক, তাই একটু হাঁটলেই ক্লান্ত হওয়াটা স্বাভাবিক। আমরা একটা আর্মির গাড়ী সহ কয়েকটা গাড়িয়ে লিফট দেয়ার জন্য সিগনাল দিলাম, কিন্তু কেউ দাঁড়াল না।

ইয়াক এবং তার মালিক (পেছনে দুইজন আর্মি) || দূরের লাল ঘরটাই ছাঙ্গু লেকের শুরু

একজন ইয়াক মালিকের সঙ্গে দেখা হল, তার সাথে পাহাড়ের একটা শর্টকাট ধরে বেশ কিছুদূর এগুলাম। পথে পিপাসা পাওয়ায় পাহারের একটা ছোট্ট ঝিরি থেকে পানি খেয়ে নিলাম। তারপর দেখলাম আরও দুই কিমি বাকি, হয়তো আর ১০-১৫ মিনিট লাগবে আমাদের। তবে একটু কাহিল আর প্রচন্ড ঠাণ্ডায় একটু বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করছিল। রাস্তার দুইপাশে বরফ ছিল বলে কোথাও বসতে পারিনি, আর পায়েও নরমাল কেডস, তাই বরফে স্লিপ করার চান্স থাকে।

২ কিমি আগে বেশ কিছু ঘরবাড়ী আছে, সেখানে টুকটাক খেতেও পাওয়া যায়, আমরা গরম পানি চা কিংবা ম্যাগির খোজ করতে গেলাম। তখনই সামনে এসে আমাদের গাড়িসহ বাকিরা দাড়াল। ড্রাইভার আর গাইড আমরা এই পর্যন্ত চলে এসেছি দেখে একটু রাগ করল, বলল তাদের গাড়ীর এই পর্যন্ত আসার পারমিট নেই, তাও আমাদের নিতে এসেছে। গাড়ী দেখে আশান্বিত হয়েছিলাম যে দুই কিমি পথ গাড়ীতে করেই যাব, কিন্তু ওদের কথা শুনে গাড়িতে উঠে বসলাম, আর এতদূর এত কষ্টে আসা পথ এর সামাপ্তি ঘটিয়ে মাত্র ২ কিমি বাকি রেখে নিচে নেমে গেলাম।

ছাঙ্গু দেখা হয়নি, কিন্তু এইটুকু হাটার রাস্তার বাঁকে বাঁকে যে সুন্দর প্রকৃতি দেখছি তা বর্ননাতীত।

আমাদের যেতে হবে আজ কালিম্পং, গ্যাংটক থেকে ৪ ঘণ্টার রাস্তা। তবে আমাদের গ্যাংটক পৌঁছাতে বেশ সময় লাগল। ছাঙ্গু থেকে বের হবার চেকপোস্টে আজ সব ড্রাইভারের কাগজ চেক করা হচ্ছে যেহেতু সকালে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। সেখানটা পার হয়ে আবার গ্যাংটক এর ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে বেরুতে বেরুতেই বিকেল ৫টা। তারপর একবারে রংপো চেকপোস্ট।

গাড়ী থেকে নেমে রংপো FRO এ পারমিটের কাগজ ফেরত দিয়ে পাস্পোর্টে এক্সিট ডেট বসিয়ে আবার গাড়ীতে চেপে বসলাম।আমাদের সবারই অনেক ক্ষুধা পেয়েছিল, কিন্তু সব বন্ধ হবার আগেই কালিম্পং পৌঁছাতে হবে বলে আর মাঝে থামলাম না।

কালিম্পং যখন পৌছালাম তখন রাত ৮ টা। মেইন রোডে গেলাম, কিন্তু বেশিরভাগ দোকান পাট বন্ধ। একটু হোটেল খুঁজতে হল, কিন্তু এখানেই হোটেলের খরচ গ্যাংটক এর ডবল! কিন্তু মানের দিক দিয়ে যে খুব একটা ভাল তাও না। আসলে পরিচ্ছন্ন সিকিম ঘুরে এখন ওয়েস্ট বেঙ্গলের একটা ঘিঞ্জি ছোট শহরে খুব একটা ভাল লাগার কথাও না।

কালিম্পং মেইন রোড মোড়
হোটেল Gompus

একটু ঘুরে ফিরে শেষ মেশ OYO হোটেল চেইনের Gompus হোটেলে চেকইন করি। দুই রুম, একটা ডাবল, আরেকটা ত্রিপল বেড, ৩০০০ রুপি। রুমের মান ভালই। সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাই তাড়াতাড়ি বের হলাম রাতের খাবার খেতে। আমি মাছ দিয়ে পেট ভরে খেলাম। তারপর আবার হোটেলে ফিরলাম। আজকে বেশ কিছুদূর হাটার কারণে শরীর বেশ ক্লান্ত, তাই রুমে এসেই ঘুম।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে চলে গেলাম ডেলো পার্ক এ। তখনো সেখানে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। আমি ভেবেছিলাম এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবো, কিন্তু মেঘের কারণে তা আর হলোনা। আর এতদিন সিকিম ঘুরে এখন ডেলো পার্ক ভাল লাগানোটাও সবার জন্য একটু কষ্টকরই বটে। কিছুক্ষণ এভাবে ওভাবে সময় কাটিয়ে ফিরে এলাম। আলু পরোটা আর ডিম দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে হোটেলে চলে গেলাম। ব্যাগ গুছানোই ছিল, হোটেলের হিসেব নিকেশ চুকিয়ে তাই চলে গেলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ড এ।সেখান থেকে বাস, শেয়ার্ড ট্যাক্সি, রিজার্ভ ট্যাক্সি সবই পাওয়া যায়। তবে আমরা নিলাম সরাসরি চ্যাড়াবান্ধা বর্ডার পর্যন্ত একটা রিজার্ভ জিপ, ৪০০০ রূপিতে।

ডেলো পার্ক

কালিম্পং থেকে নেমে জিপ যখন তিস্তার রাস্তায় নামল তখন বেশ ভালই লাগছিল। রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নীল জলের তিস্তা। আসার সময় সন্ধ্যার পর ছিল বলে এই সুন্দর রাস্তাটার কিছুই বুঝিনি, এবার ভাল করে দেখার সুযোগ মিলল।

তিস্তা || অপালচাঁদ ফরেস্ট

পাহাড় থেকে নেমে গাড়ী সমতলে আসার কিছুক্ষণ পরই গাড়ীতে সমস্যা, ইঞ্জিন গরম হয়ে যাচ্ছে। তাই ড্রাইভার আমাদেরকে আরেকটা জিপে ট্রান্সফার করে দিলেন। এক বাঙ্গালী দাদা ড্রাইভার। এই রাস্তাটাও বেশ সুন্দর। প্রথমে কিছুক্ষণ চা বাগানের ভেতর তারপর অপালচাঁদ ফরেস্ট এর মধ্য দিয়ে ছুটে চলল গাড়ি।তারপর আরেক্টু চা বাগান পেরিয়ে তিস্তার ক্যানাল রোড ধরে চলল গাড়ী। এখানে আসলে গ্রামাঞ্চল, তবে একটা জিনিস দেখার মতন। স্থানীয়দের মধ্যে সাইকেলের ব্যবহার অনেক বেশি, বিশেষকরে মেয়েদেরকে সাইকেল নিয়ে চলাচল করতে দেখেছি অনেক। কি ছোট কি বড় সব মেয়েরাই যেন সাইকেল চালাতে জানে এখানে!

চলতে চলতে ৪ টার দিকে পৌছালাম চাংড়াবান্ধা বর্ডারে। ভারতের সাইডে ১০০ রুপি আর বাংলাদেশ সাইডে ২০০ টাকা দিয়ে পার হবার কাজ সারতে হল, এবার অবশ্য ঢুকার সময়ের মতন ঝামেলা করতে হয়নি। এস আর পরিবহনের ৬টার বাসের টিকিট আগেই কাটা ছিল। তাই প্রথমে বুড়ীর হোটেলে গিয়ে পেট ভরে খাসির মাংস দিয়ে ভাত খেলাম। কতদিন পর দেশের খাবারের টেস্ট!

বাস একটু দেরি করেই ছাড়ল। কিন্তু এক ঘণ্টা যেতে না যেতেই একটা এক্সিডেন্ট, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্রাক্টরকে ধাক্কা মারে বাস। তাতে সেখানের একজন আহত হওয়ায়।বাস আটকানো হয়, একটু উত্তপ্ত অবস্থায় সামনের গ্লাস আর দরজার সাইডে মানুষজন আঘাত করলে দরজা লক হয়ে যায়, আর সামনের গ্লাস ফেটে যায়। তবে পুলিশ আর স্থানীয় নেতা আসায় ঝামেলা বেশিদূর হয়নি।

বাস থানায় নিয়ে জরিমানা করে এবং দরজা ও হেডলাইট ঠিক করে আবার রওনা দিতে আরও দুই ঘণ্টা লেট। তারপর বাসের অবস্থা খারাপ দেখে এসি বাস থেকে নরমাল আরেকটা বাসে সব যাত্রিকে ট্রান্সফার করা হয়। সেটারও ড্রাইভিং খুব একটা ভাল ছিলনা। তখন পর্যন্ত বুঝলাম যে এই রুটে চট্টগ্রাম বা সিলেট এর মতন ভাল বাস নেই বললেই চলে। শেষমেশ রাস্তার জ্যাম ঠেলে ঢাকায় এসে পৌছাই পরদিন সকাল ১০-১১ টার দিকে।আর এর সাথে সাথেই পাহাড়ের সুন্দর দিনগুলিকে পেছনে রেখে আবার যান্ত্রিক ঢাকার জীবন শুরু।আর আরেকবার দিনগোনা শুরু। ততদিন পর্যন্ত ভাল থাকুক পাহাড় আর পাহাড়ের সহজ মানুষগুলো।

--

--