Bavaria from South to North

Schwangau — Garmisch Partenkirchen — Bamberg

Nowshad
tripsharebd
Published in
13 min readJul 27, 2020

--

জার্মানি — দেশটির নাম শুনতেই আমাদের চোখে যে জিনিসগুলো ভেসে উঠে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে — বিয়ার, ঐতিহ্যবাহী পোশাক, বিশাল ফেস্টিভাল, ইত্যাদি। আর এই জিনিসগুলোর অধিকাংশই জার্মানির দক্ষিণের স্টেট বাভারিয়া বা বায়ার্ন থেকেই আসা। অস্ট্রিয়া — সুইজারল্যান্ড সীমান্ত ঘেঁষে থাকা এই স্টেটটি একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল ঠিক তেমনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরও যেন এক স্বর্গ। পৃথিবীর বিখ্যাত সব গাড়ির কোম্পানি অথবা স্বচ্ছ জলের লেক কিংবা আল্পস পর্বতমালা, সবই আছে এখানে।

করোনার প্রকোপ থেকে এখানকার জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করেছে, তাই হুট করে প্ল্যান করে ফেলা যে বাভারিয়া যাব। আমার পরিচিত আরও দুইজন এক্স-কলিগ যাদের সাথে বাংলাদেশে থাকার সময় কাজ করেছি তাদেরও আমন্ত্রণ জানালাম, দলে ভিড়তে কোন আপত্তি জানালো না কেউই। আমাদের তিনজনের বসবাস জার্মানির তিন শহরে — আমি কোলনে, মেহদী ভাই বার্লিন আর আসাদ ভাই বাভারিয়ার রাজধানী মিউনিখে। সারারাত ফ্লিক্সবাসে জার্নির পরে সকালে তিনজনের দেখা হল মিউনিখে। দেশের বাইরে আসার পরে বেশিরভাগ ট্রিপ আমি সলো বা “একলা চলো রে” স্টাইলেই করেছিলাম, তাই এভাবে একটা ট্রিপে তিনজন একত্রিত হবো সেটা আমার জন্যে বেশ এক্সাইটিং ছিল।

সকালে বাস স্টেশনে নেমেই চলে গেলাম আসাদ ভাইয়ের বাসায়। ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসে তো অবাক — বাভারিয়ার ট্র্যাডিশনাল সকালের খাবার, বেশিরভাগের নামও জানিনা। তবে ব্রেড এবং চিজ বরাবরের মতনই কমন জার্মান ব্রেকফাস্ট। খেয়ে দেয়ে ভাইয়ের গাড়িতে করে বের হয়ে পড়লাম দক্ষিণের দিকে মুখ করে আর সেই সাথে আমাদের ট্রিপও শুরু এখান থেকেই!

আমাদের আজকের মূল গন্তব্য একদম দক্ষিণের অস্ট্রিয়া — জার্মানি সীমান্তে (Schwangau) শোয়ানগাউ নামের জায়গায়। মিউনিখ থেকে কিছু দূরত্ব পেরোবার পরেই আশপাশের রাস্তার দৃশ্য বদলে যেতে থাকল; দালান কোঠার বদলে সবুজ গাছে ঘেরা পাহাড়ি পথ।

আমার বিদেশে এসে একটা জিনিস খুব আফসোস হয়, আমাদের দেশের মতন এখানে বাস বা ট্রেনের জানালা খুলে বাতাস খাওয়ার কোন সিস্টেম নাই। আর হাইওয়েতে গাড়ি যে গতিতে চলে, তার শব্দে জানালা নামানোও যেন একপ্রকার অপরাধ! তবে এই পাহাড়ি পথে কিছুটা স্বল্প ট্রাফিক, চারিদিক খোলা আর গাড়ির গতি একটু কম থাকায় চট করে নিজের অনেকদিনের শখ পূরণ করে ফেললাম। জানালার কাচ নামিয়ে দিতেই এক স্নিগ্ধ হাওয়ার ঝাপটা এসে মুখে লাগল; শীতল এবং শুদ্ধ বাতাস, বুক ভরে দম নিলাম, একেবারে যেন ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে আসলো!

জানালার বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে দূরের পাহাড়গুলোর কাছে আসা দেখছিলাম আর জীবন ব্যাপারটাকে মনে মনে এপ্রিশিয়েট করছিলাম। মাঝে আমাদের মনে হলো যে এমন সুন্দর পরিবেশে এই যে পাহাড়ি সবুজ ঘাসে চড়ে বেড়ানো গরু, এদের জীবনও কতই না সুখের। আমাদের চেয়ে তাদের জীবন কতই না সহজ-সরল, সারাদিন বসে-হেঁটে-শুয়ে ঘাস খাও, আর কোন চিন্তাই নাই!

প্রায় দেড় ঘণ্টা পর আমার মনে হলো একেবারে যেন পাহাড়গুলোর মাঝখানে চলে এলাম। প্রথমে যে জায়গাটায় থামলাম, একটা চার্চ। চারদিকে সবুজ ঘাসের প্রান্তর, পেছনে পাহাড়ি দৃশ্য, আর তার কেন্দ্রে একটি প্রাসাদ। কত কতবার এই দৃশ্য যে ইন্টারনেটের পাতায় দেখেছি, আর আজ নিজেই এই সুন্দরের মাঝে দাঁড়িয়ে! একটু এগিয়ে গিয়ে গাড়ি পার্ক করে নেমে পড়লাম। মানুষজন বেশ ভালই আছে বুঝা গেল। করোনার ভয়কে জয় করে মানুষজন নিজেদের দেশে টুকটাক ঘুরা ফেরা শুরু করেছে, আবহাওয়াও বেশ ভাল আর শনিবার হওয়ায় ভিড়ও একটু বেশিই মনে হলো।

আমাদের এখানের প্রথম দেখবার আছে নইশোয়াইন্সটাইন ক্যাসেল (Neuschwanstein Castle)। রাজা লুডভিক দুই (King Ludwig II) তার একরকম সামাজিক জীবনের থেকে দূরে থাকার উদ্দেশ্যে পাথুরে পাহাড়ের চূড়ায় একটি সুন্দর প্রাসাদ তৈরি করার কাজ হাতে নেন। তবে বেচারার আর সেখানে থাকা হয়নি, প্রাসাদ সম্পন্ন হবার ক’দিন আগেই তিনি পরলোক গমন করেন; তার মৃত্যুর সাত সপ্তাহ পর, ১৮৮৬ সালে এটি জনসাধারণের জন্য উম্নুক্ত করা হয়।

পার্কিং থেকে ক্যাসেল এর মূল ভিউপয়েন্ট এর দিকে গেলাম; এটি আসলে একটি লোহার ব্রিজ, যেটি আগে কাঠের তৈরী ছিল, নাম — মেরিয়েন ব্রিজ (Marienbrücke)। এখানে যাবার জন্য আপহিলে প্রায় ২০-৩০ মিনিট হাইক করতে হয়। অনেকদিন পরে বেরিয়ে এইটুকুন উঠতেই যেন হাঁপিয়ে গেলাম, তাই মাঝে থাকা পাহাড়ি ঝিরি থেকে পানি পান করে শীতল হলাম। ব্রিজের সামনে গিয়ে দেখি বিশাল লাইন। একসাথে বেশি লোক উঠা যায়না তাই লাইন ধরে ধরে মানুষ গুণে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে। তো প্রায় আধঘণ্টা লাইন ধরে শেষমেশ ঢুকতে পারলাম ব্রিজে। দেখার মতন দৃশ্য, পাথরের পাহাড়ের মাথায় পুরোটা জুড়ে বিশাল এক লাইমস্টোনের প্রাসাদ, সেটায় আবার কয়েকটা উঁচু পিলার টাইপ ওয়াচ টাওয়ারও আছে। আর পাহাড়, পেছনে লেকের ভিউটা আসলেই অসাধারণ।

এই ক্যাসেলের সবচেয়ে বড় পরিচিতি হয় ডিজনির সাথে যোগসূত্র থাকার কারণে, ওয়াল্ট ডিজনি এই ক্যাসেল থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্ববিখ্যাত ডিজনি ক্যাসেল নির্মাণ করেন।

ব্রিজের নিচে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণা, বেশ স্রোতও আছে দেখলাম। তো কিছুক্ষণ সেখানে থেকে, ছবি তুলে নেমে এলাম। নিচে নেমেই একটু পাশে আরেকটা পাহাড়ে হলুদাভ আরেকটা প্রাসাদ — Hohenschwangau Castle। তবে আমাদের আকর্ষণ করে তার পাশে থাকা পাহাড়ি লেক — Alpsee। স্বচ্ছ জলের লেকে চারদিকেই পাহাড়ে ঘেরা, একটা সবুজাভ আভা পড়েছে হয়তো চারিদিকের সবুজ পাহাড়গুলোর জন্যই। এখানে অবশ্য বেশিক্ষণ থাকা গেল না, কারণ আমাদের সবারই ক্ষুধা পেয়েছিল বেশ। তাই আবার গাড়িতে চড়ে শুরু হল খাবার জায়গা খোঁজা।

দুপুরের খাবারের সময় বেশ আগেই পার হয়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ খাবার জায়গাই বন্ধ, আর তার মধ্যে আমাদের দরকার অথেনটিক বাভারিয়ান ফুড। বেশ কিছুক্ষণ এদিক সেদিক করে শেষমেশ একটা ট্র্যাডিশনাল জার্মান রেস্টুরেন্টে জায়গা হল। বেশ মজাদার খাবার খেলাম, নামগুলো অবশ্য খেয়াল নেই। সোজা বংলায় আমি খেলাম আলু আর চিজ দিয়ে বানানো সালাদ, বাকিরা খেল শুকরের ঠ্যাং (অনেকটা আমাদের দেশের খাসির লেগ রোস্টের মতন) আর সালাদ।

খেয়ে দেয়ে পেটপুর্তি করে আস্তে ধীরে একটু টিপিক্যাল জার্মানদের মতন খাবার টেবিলে বেশ সময় ব্যায় করে, আবার গাড়িতে চড়ে বসলাম। এবার চলে গেলাম ফুঁসেন নামক ছোট্ট শহর ঘেঁষা বিশাল এক লেকে, নাম — ফরগেন সি (Forggensee)। দিনের ঘুরাঘুরি আর হেভি খাবারে শরীর একটু অলস লাগছিল, তাই একরকম বিছানা পেতে বসে ছিলাম লেকের পাড়ে। খুব শান্ত জল, আর চারদিকটাও বেশ চুপচাপ, এরকম শান্তি শান্তি পরিবেশে দিনের শেষ দেখা আসলেই একটা ভাল্লাগার অনুভূতি দেয়। লেকের পাড়ে অনেকক্ষণ ছিলাম, মাঝে একটু জুতা খুলে পাও ডুবালাম লেকের পানিতে। তারপর আবার গাড়িতে চড়ে বসলাম।

source: https://www.fuessen.de

তবে যাবার আগে একটা বোনাস লোকেশনে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য — লেখফলস (lechfall) । একটা পাহাড়ি নদী এসে কয়েকধাপ নিচে পড়ে গিয়ে লেকের সাথে মিশেছে, দেখে মনে হয় বিশাল এক ঝর্ণা। সেখানে বেশিক্ষণ থাকলাম না, ১০ মিনিটের মতন থেকে গাড়িতে আবার।

পথে আবার বাতাস খেতে খেতে আর উদাস উদাস একটা ভাব নিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে চলে এলাম মিউনিখ। আজকে আমি আর মেহদী ভাই হোস্টেলে থাকবো, তাই হোস্টেলের সামনেই গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। তারপর ফ্রেশ হয়ে রাতে একটু ক্ষুধা লাগায় হোস্টেলের বিপরীতে থাকা ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টে গিয়ে একটা পিজ্জা খেয়ে এদিনের মতন হিসেব নিকেশ চুকালাম।

1st day highlights

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়লাম ট্রেন স্টেশনের উদ্দেশ্যে। বাভারিয়ার গ্রুপ ট্রান্সপোর্টেশন টিকিট কিনে চলে গেলাম মিউনিখ সেন্ট্রাল স্টেশনে। সেখানে সকালের নাস্তা কিনে, ট্রেনের প্লাটফর্মে গিয়ে আবার সবাই একত্র হওয়া। আজকের আমাদের গন্তব্য দক্ষিণের আরেকটি ছোট্ট শহর গার্মিস-পার্টেনকিরখেন (Garmisch-Partenkirchen)

গার্মিস-পার্টেনকিরখেন মূলত একটি স্কি টাউন। একসময় গার্মিস এবং পার্টেনকিরখেন নামে দুইটি ভিন্ন ভিলেজ থাকলেও ১৯৩৫ সালে উইন্টার অলিম্পিক উপলক্ষে মিলিত হয়ে একটি ছোট্ট টাউনে পরিণত হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ট্যুরিজমই এই অঞ্চলের মূল চালিকাশক্তি।

এদিনের শুরুটা একটু অন্য জায়গায় করার প্ল্যান আমাদের। প্রথমেই মিউনিখ থেকে রিজিওনাল ট্রেনে চড়ে রওনা দিলাম গার্মিসের উদ্দেশ্যে। প্রায় দেড় ঘন্টার ট্রেন জার্নি। তবে লেক আর পাহাড়ের সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে আর তিনজনে গল্প করতে করতে চোখের পলকেই পৌঁছে গেলাম। স্টেশনের আগেই পাশে পাহাড়ি নদী আর বিশাল বিশাল পাহাড়। তবে সেখানে নেমেই আবার আরেকটা বাসে উঠলাম, গন্তব্য ভালখেন লেক (Walchensee)। এই রাস্তাটা গতদিনের রাস্তার চেয়েও বেশি সুন্দর বললেও ভুল হবেনা। কিছুক্ষণ পড়েই নেমে পড়লাম লেকের ধারে। প্রথমে ইচ্ছা ছিল লেকের চারিদিকে সাইকেল ভাড়া করে চালাবো, কিন্তু কপাল খারাপ, তাই সাইকেলের স্টোরে ওই সময় কোন সাইকেলই ছিলনা, সব ব্যস্ত! তাই হেঁটে লেকের অন্যদিকে গেলাম, একটা মোটামুটি ছোট্ট কোনায় ঘাটি গাড়লাম। নীলাভ স্বচ্ছ জল, আর পরিষ্কার আকাশের রঙের জন্য চারদিকটাই দেখতে খুব বেশি সুন্দর লাগছিল। অনেকদিনের শখ ছিল এমন পাহাড়ি লেকের পানিতে ঝাপাঝাপি করবো। তাই আর অপেক্ষা না করে নেমে পড়লাম, সে এক প্রাণ জুড়ানো অনুভূতি।

ঠাণ্ডা জলের পর একটু রোদে গা এলিয়ে দিতে ইচ্ছা করছিল, তাই মিনিট পাঁচেক রোদে বসে থেকে তারপর আবার লেকের যে দোকান ছিল সেখানে চলে গেলাম, আইসক্রিম কিনে খেতে খেতে ফিরে যাবার বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তারপর গার্মিসে ফেরত এসে প্রথমেই পেটপূজোর কাজটা সেরে নিলাম, হাতে সময় কম তাই ফাস্টফুডেই ভরসা। আবার বাসে করে চলে গেলাম আমাদের হোস্টেলে। হোস্টেল শহরের এক প্রান্তে, তবে লোকেশন খুবই সুন্দর, পুরাতন উইন্টার অলিম্পিক কমপ্লেক্সের পাশেই। বেশ পরিপাটি ছিমছাম এবং সুন্দর ভিউ দেখে ভালই লাগল। হাতমুখ ধুয়ে বেড়িয়ে পড়লাম আমাদের গন্তব্যে। হোস্টেল থেকে কাছেই একটা রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ি জলের ধারা ঘেঁষে, পানির রঙও কেমন সাদাটে। আমাদের গন্তব্য পার্টনাখ গর্জ (Partnach Gorge) । প্রায় পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটা বেজে যাওয়ায় বেশিরভাগ মানুষই অবশ্য ফিরে আসছিল। আমরা অবশ্য চিন্তায় ছিলাম যে সেটা খোলা থাকবে কিনা, তবে বেশ কিছুক্ষণ সুন্দর রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে পার্টনাখ গর্জ এ পৌঁছে গেলাম এবং দিনের শেষ হওয়াতে একরকম ভিড় ছাড়াই ঢুকে গেলাম। দুইপাশে খাড়া পাথরের পাহাড়ের দেয়াল মাঝে দিয়ে বয়ে চলা স্রোত এবং প্রচণ্ড শব্দ। মাঝে মাঝে পাহাড়ের পাশ কেটে আবার মাঝে মাঝে সুরঙ্গ করে সরু রাস্তা তৈরি করা হয়েছে হেঁটে হেঁটে দেখার জন্য। তো গর্জের একমাথা থেকে অন্য মাথা মোটামুটি বিশ মিনিট লাগল হেঁটে দেখতে।

ভিড় না থাকায় মাঝে মাঝে একটু থেমে ছবিও তোলা হল। অপরপ্রান্তের দিকে অনেকগুলো ছোট বড় ট্রেইল/হাইক এর রুট। হয়তো যারা সময় নিয়ে আসেন অথবা এডভেঞ্চার পছন্দ করে তাদের জন্য এইটা একটা স্বর্গ বলা যায়। দুইদিক থেকে আসা পাহাড়ি ঝিরি মিশেছে একসাথে। সেখানে থেকে একটু পানিতে তৃষ্ণা মিটিয়ে শুরু হল পরের পর্ব।

আগে যে পথে যাওয়া, সে পথেই ফিরে আসা যেত। কিন্তু এখন করোনার পর থেকে ভিড় এড়ানোর জন্য পুরো বিষয়টা ওয়ান ওয়ে। কিছুটা আপহিলে হাইক করে পাহড়ের উপর দিয়ে ফিরে আসতে হবে। তো শুরু হল উপরে উঠা, প্রায় ২০ মিনিট টানা আপহিলে উঠে বেশ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তবে একদম উপরে উঠে চারিদিক দেখে এক নিমিষেই যেন সব এনার্জি ফিরে পেলাম। একদম ছবির মতন ছোট্ট একটা ভিলেজ, মাঝে মাঝে দুইটা বিয়ার গার্ডেনও আছে ক্লান্ত পথিকের তৃষ্ণা মেটাতে। আমরা কিছুক্ষণ এক জায়গায় বসে ছবি তুললাম, একটু জিরিয়েও নিলাম। পাহাড়ে আমরা আগে টিভিতে দেখতাম গরুর গলায় ঘণ্টা। এখন সামনা সামনি দেখলাম, তবে চারিদিক চুপচাপ এবং কিছুটা দূরের প্রতিধ্বনির কারনে এই ঘন্টার শব্দ শুনতে বেশ আরাম লাগে কানে।

কিছুক্ষণ পরে একরকম খাড়া পথ বেয়ে নিচে নেমে এলাম। তবে ফিরে এসে কাছের এক পেট্রোল পাম্প থেকে বেশি দামে (যেহেতু রোববার সাধারণ দোকানপাট বন্ধ থাকে) পানীয় এবং কিছু স্ন্যাক্স কিনে হোস্টেলে ফিরলাম। তারপর বারান্দায় বসে তিনজন পাহাড়ের বুকে সন্ধ্যা থেকে আধার হওয়া দেখতে দেখতে আর গল্প করতে করতে কখন যে রাত বারোটা বেজে গেল টেরই পেলাম না। তাই এদিনের মতন অধিবেশন এখানেই সমাপ্ত ঘোষণা করে ঘুম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ গুছিয়ে বের হতে একটু দেরিই হয়ে গেল। আর বাসের শিডিউল আর ইন্টারনেটের শিডিউলে এদিক সেদিকের জন্য আরও দেরি। তবে এই দেরির মাঝেই চলে এলাম আজকের প্রথম গন্তব্যে — আল্পসপিটজে (Alpspitze)। এটি মূলত একটি পাহাড় যার উচ্চতা ২৬০০ মিটারেরও বেশি। তবে এখানের পাহাড়গুলোর ব্যবস্থাপনা বেশ চমৎকার বলা যায়। কেবল কারে উঠা নামা করা কিংবা বিভিন্ন নিয়মিত পরিচর্যা করা হাইকিং ট্রেইল সবরকম মানুষের জন্যই কিছু না কিছু আছে। আমরা টিকিট কিনে কেবল কারে চড়ে বসলাম। কেবল কার উপরে উঠে চলছে, আর পাহাড়ের মাঝে মাঝে ছোটছোট গ্রামগুলো দেখা যাচ্ছে। একসময় প্রথম কেবল কারের স্টপ ক্রেউজেক (Kreuzeck) এ নামলাম। এখান থেকে প্রায় ২০ মিনিটের একটা মোটামুটি হাইক করে আমাদের পরের কেবল কার স্টেশনে যেতে হবে।

আসলে পাহাড়ের উপরটা দেখার মতন, চারিদিকে আল্পস পর্বতমালার অন্য চূড়া দেখা যায়, আর দূরের গার্মিস শহরকে একটা মিনিয়েচার এর মতন লাগে। পাহাড় দেখতে দেখতে হাইকের শেষে Hochalm কেবল কার স্টেশনে চলে আসলাম, সেখান থেকে আবার অল্প সময়ের পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠে গেলাম।

কত কত ইউটিউব ভিডিও বা টিভিতে দেখতাম আগে যে ইউরোপের আল্পস পর্বতমালা, আর এখন নিজেই দাঁড়িয়ে আছি আল্পস এর একটা চূড়ার উপর! ভাবতেই ভাল লাগছিল, আর আশে পাশের চোখ জুড়ানো দৃশ্য তো আছেই। বেশ কিছুক্ষণ এদিক সেদিক দেখে, ছবি তুলে ক্ষুধা পেয়ে গেল। পাহাড়ের উপরেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে, তবে লোকজন বেশি হওয়ায় লাইন ধরে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। বাকিরা লাইন ধরে টেবিল পাবার অপেক্ষায়, আর আমি এই সুযোগে দুইটা প্লাটফর্ম ঘুরে দেখলাম, পায়ের নিচে দেখা যায় পাহাড়ের খাড়া খাদ, এমনভাবে দুইটা প্লাটফর্ম তৈরি করা। যাদের উচ্চতায় ভয়, তাদের জন্য নয়। তারপর আমিও রেস্টুরেন্টে এলাম, তবে অবাক করা ব্যাপার হল পাহাড়ের উপরে হওয়া সত্ত্বেও দাম মোটামুটি স্বাভাবিক। তাই খাবার অর্ডার করলাম, আর পেট ভরে খেয়ে তো আর নড়তেই ইচ্ছা করছিল না। তাও বেশ কিছুক্ষণ এই সুন্দর পরিবেশে বসে থেকে, আরেকদিক থেকে আলাদা কেবল কারে নিচে নেমে এলাম। এবারের কেবল কার বড় এবং একবারেই নিচ পর্যন্ত নিয়ে এল। আবারও বাসে করে কিছুদূর ফিরে একটা বাসস্টপে দাঁড়ালাম, গন্তব্য আইবসি (Eibsee)। একঘণ্টা পর পর বাস, বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বাস আসল ঠিকই, কিন্তু বাসে তিল ধারণেরও জায়গা না থাকায় ড্রাইভার বাস থামালই না! একটু মনক্ষুণ্ণ হয়ে আবার অন্য বাসে গার্মিস ফেরত আসলাম। এসে দেখলাম ১০ মিনিট পর আইবসি এর বাস, যেহেতু এটা বাসের স্টার্টিং পয়েন্ট সেহেতু ভিড় নেই, উঠে পড়লাম বাসে, আর আস্তে ধীরে একসময় পৌঁছে গেলাম লেকের ধারে। আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর লেক বলা যায়। জার্মানির সবচেয়ে উঁচু পাহাড় ইয়ুগস্পিতজে (Zugspitze) এর পাদদেশে অবস্থিত এই লেকের একদিকে যেমন স্বচ্ছ পানি, অন্যদিকে উঁচু পাহাড় এর প্রচিচ্ছবি সত্যি দেখতে পোস্টার এর মতন।

হেঁটে লেকের ধারের একটা ব্রিজের নিচে গিয়ে পানিতে পা ডুবিয়ে বসে রইলাম বেশ অনেকক্ষণ। চোখে যেন দিন শেষের রোদে চারিদিকের এই সৌন্দর্যে একরকম শান্তি লাগতে লাগলো। তারপর আস্তে ধীরে আবারও বাসে করে গার্মিস ফিরে এসে, ফাস্টফুড খেয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম। পড়ন্ত বিকেলের রোদ দেখতে দেখতে মিউনিখ এসে পৌঁছুলাম প্রায় ৯ টার দিকে। স্টেশন থেকেই তিনজন তিনদিকে বিদায়, আসাদ ভাই বাসায় চলে গেল, মেহদী ভাই রাতের বাসে বার্লিন ফিরবেন, আর আমি এই রাতে যাব বাভারিয়ার উত্তরে ব্যামবার্গ শহরে। এক ট্রেনে মিউনিখ থেকে রেগেন্সবার্গ, সেখান থেকে আরেক ট্রেনে নুরেনবার্গ, তারপর নুরেনবার্গ থেকে ব্যামবার্গ পৌঁছুতে রাত প্রায় দুইটা বাজে। একটানা বাভারিয়া স্টেট এর সর্ব দক্ষিণ থেকে সর্ব উত্তরে চলে এলাম প্রায় পাঁচ ঘন্টার জার্নির পর।

Day 2 & 3 highlights

ব্যামবার্গ শহর ছোট্ট একটা বাভারিয়ান পাহাড়ের টাউন। তবে আমার পরিচিত একঝাক মানুষজনের বসবাস, তাই সবার সাথে দেখা করতে আসা। আর উপরিপাওনা হিসেবে শহরটাও ঘুরে দেখা। রাতে এত টায়ার্ড ছিলাম যে একরকম মরার মতন নাক ডেকে ঘুমালাম। তারপর ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়লাম ব্যামবার্গ এর রাস্তায় রাস্তায়। একাই বের হলাম যেহেতু বাকিদের পরীক্ষা দুইদিন পর। হাঁটা শুরু সেন্ট্রাল ট্রেন স্টেশন থেকে। তারপর মেইন শপিং স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে নদীর পাড়ে। Regnitz এবং Main দুটি ছোট নদীর বয়ে চলেছে এই শহরের বুক চিরে। আর তাই নদীর পাড়ে গিয়েই প্রথমেই চোখে পড়লো অনেক অনেক ব্রিজ। একেকটা একেকরকম, কোনটা লোহার, কোনটা পাথরের, কোনটা সাজানো আবার কোনটা সাদামাটা। তবে একদম একটা ব্রিজ চোখ আঁতকে যাবার মতন, Altes Rathaus মানে পুরনো টাউন হল টা অবস্থিত Regnitz নদীরে মাঝে এবং দুইপাশে দুটো ছোট্ট পাথরের ব্রিজ দিয়ে দুই পাড়ের সাথে সংযুক্ত। এই জায়াগাটা একরকম টুরিস্টদের প্রাণকেন্দ্রও বলা যায়।

তো বেশ কয়েকটা ব্রিজেই ঘুরে ফিরে আরেক্টূ এগোতেই একটা চার্চ — Pfarramt St. Stephan। ভেতরের বেশ সুন্দর এবং একেক দিক দেখতে একেক রকম একটা চার্চ।

এরপরে গেলাম ব্যামবার্গ ডম (Bamberg Cathedral) এ। বেশ বিশাল কমপ্লেক্স রয়েছে এই এলাকাতে। আর ডম এর ভেতরটা অসাধারণ। পুরাতন আর্কিটেকচার, বিভিন্ন পেইন্টিংস, কারুকার্য, সব মিলিয়ে চমৎকার লাগল দেখে।

তো এই সুন্দর সুন্দর জিনসগুলো হেঁটে দেখতে দেখতে ক্ষুধা পেয়ে গেল, তাই তুর্কিস দোকান থেকে ডোনার-কাবাব কিনে নদীর পাড়ে বসে বসে খেয়ে এবেলার জন্য পেটকে শান্ত করলাম। তারপর সিটি বাসে চড়ে গেলাম মিশেলসবার্গ। ছোট্ট পাহাড়ের উপর বিশাল এক পুরানো স্থাপনা, দেয়ালে দেয়ালে কারুকার্য। তবে আমার চোখে পড়ল তার সামনের বারান্দা টাইপ জায়গা যেখান থেকে ব্যামবার্গ শহরের বেশিরভাগটাই দেখা যাচ্ছে। লাল রঙের টাইলের ছাদ সব বাড়িঘরের, পুরো শহরটা যেন একটা ছাদ মনে হয় উঁচু থেকে। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে বসে রইলাম, একটু হাঁটার মাঝে বিশ্রামও হল।

আমার পরের গন্তব্য অল্টেনবার্গ (Altenburg)। পুরানো একটা দুর্গ, অনেকটা মুভিতে যেমন দেখা যায় যে পাহাড়ের উপরে, ছোট্ট একটা ব্রিজ দিয়ে প্রবেশ করতে হয়, ঠিক তেমনটাই। ছবির জন্য সুন্দর লোকেশন, আর সাথে ব্যামবার্গ এর সবচেয়ে উঁচুতে থাকা বিয়ারগার্ডেন ও ভিউ তো আছেই। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে এদিক সেদিক দেখলাম। ব্যামবার্গ এর প্রায় চারিদিকই দেখা যায়। তবে জাগাটায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মাধ্যমে যাওয়া আসায় বেশ খানিকটা পথ হেঁটে যেতে হয়, আমারও অনেকটা হাঁটা লাগল।

সেখানে ঘুরে বেশ ক্লান্ত লাগছিল, তাই চলে গেলাম নদীর পাড়ের হাইনপার্কে (Hainpark)। কিছুক্ষণ বসে হেঁটে ফিরলাম শহরের কেটেন ব্রিজ (Kettenbrücke)। দিনের শেষের সোনালি আলোয় এত সুন্দর সূর্যাস্ত আমি এর আগে কখনো দেখেছি কিনা জানিনা, এত সুন্দর লাগছিল চারিদিক হালকা আলোতে। ব্রিজের উপর আরও বেশ কিছু চোখও দেখছিল সেই সোনালি আভা।

শেষমেশ আবার ফিরলাম হলে। রাতে দেখা হল বাকিদের সাথে, সবাই মিলে আড্ডা জমল বেশ খানিকক্ষণ। কে জানতো দেশে ঢাকায় থেকেও অনেকের সাথে দেখা হত না, আর এই হাজার মাইল দূরে বিদেশের মাটিতে থেকে এক ট্রিপেই এত জনের সাথে দেখা হবে!

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আবারও সেই ফ্লিক্সবাস, তারপর ফিরে আসা নিজের নীড়ে, নিজের বিছানায়, নিজের কমফোর্ট জোনে। আর শুরু হয় আবারও কোথাও উড়ে যাবার দিন গোণা…

--

--