ড্রাকেনফেলস | ড্রাগনের পাহাড়ে একদিন

প্রাচীন গল্পগাথায় মোড়া পাহাড়ে কিছুক্ষণ

Nowshad
tripsharebd
4 min readJun 18, 2020

--

সে অনেক কাল আগের কথা, সাতপাহাড়ের রাজ্যে তখন মানুষের মনে ভীষণ ভয়। রাইন নদীর তীরঘেষে যে উঁচু সবুজে ঘেরা পাহাড়টি দাঁড়িয়ে ছিল, তার গুহায় থাকতো এক বিকট ও ভয়ঙ্কর ড্রাগন। নদীর বুকে ভেসে চলা মানুষের জাহাজ বা নৌকো এক নিমিষে আগুনের নিঃশ্বাসে জ্বালিয়ে আর ডুবিয়ে দিত সে ড্রাগন। সে রাজ্যের বাসিন্দারা প্রতিদিন একজন করে মানুষ সাধারণত একজন দরিদ্র যুদ্ধবন্দী, আগুনে শ্বাস নেওয়া দৈত্যের গুহার কাছে আবদ্ধ করে রেখে আসত। তবে মাঝে মাঝে এই উৎসর্গ করা মানুষে ড্রাগনের মন ভরত না। একদিন, বাসিন্দারা অসম্ভব সুন্দরী এক খ্রিস্টান কুমারীকে বলিদান করেছিল। কিন্তু সাহসী সে কুমারী তার কাছে থাকা ক্রুশ ড্রাগনের সামনে ধরলে ড্রাগন তার কাছ থেকে দূরে পালিয়ে রাইন নদীতে ঝাপ দেয়। তারপরে আর কখনও সেই ড্রাগনের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

আর একটি কিংবদন্তি হল — ড্রাগন হত্যাকারী সিগফ্রিড। সিগফ্রিড জাটেন রাজ্য থেকে রাইনের দিকে যাত্রা করেছিলেন ড্রাগন বধের উদ্দেশ্যে। সাত পর্বত পেরিয়ে এখানে পৌঁছলেন এবং সেখানকার বাসিন্দারা ভয়ে তাকে যেতে বারণ করলেও তিনি নির্ভয়ে সেই ড্রাগনের গুহার উপরে উঠে তার তলোয়ার দিয়ে ড্রাগনকে হত্যা করেন এবং তার রক্তে স্নান করেন।

পৃথিবী এখন খুব একটা ভাল সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেনা। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে এবং শঙ্কায় স্বাভাবিক জীবন মাসের পর মাস প্রায় সম্ভিত। আর নিরাপদে বেঁচে থাকাই যখন মূল উদ্দেশ্য, তখন ঘোরাঘুরির চিন্তা না করাই ভাল। আর তাই গত তিন মাস ঘর থেকে একান্তই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউই বাসা থেকে বের হইনি। কিন্তু জার্মানিতে বর্তমান অবস্থার বেশ উন্নতি হওয়ায় জীবনযাত্রা কিছুটা হলেও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। তাই হুট করে এক শনিবার সকালে সিদ্ধান্ত নিলাম কোলন শহরের অদূরেই কোনিগসউইণ্টার (Königswinter) নামক ছোট্ট পাহাড়ের শহরে যাব, আর অনেকদিন দেখা না হওয়া কয়েকজন বড় ভাইয়ের সাথেও দেখা হবে এই সুযোগে।

জার্মান ট্র্যাডিশনাল আর্কিটেকচার

আমার এখান থেকে এক ঘণ্টা লাগে মোটামুটি কোনিগসউইণ্টার যেতে, বন শহরে গিয়ে সবাই দেখা করে একসাথে রাইন নদীর পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেলে করে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। ফুলে আর গাছে সাজানো নদীর তীর, তীরঘেষে রয়েছে সাজানো গোছানো ইউরোপিয়ান বাড়িঘর, আর পেছনে পাহাড়। আমাদের আজকের গন্তব্য এই অনেকগুলো পাহাড়েরই একটি, ড্রাকেনফেলস, যার বঙ্গানুবাদ হচ্ছে ড্রাগনের পাথর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩২১ মিটার উচ্চতার এই পাহাড়ের চূড়ায় প্রথম একটি দুর্গ নির্মাণ করা হয় আনুমানিক ১১৩৮ থেকে ১১৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে। এটি মূলত দক্ষিণ থেকে আগত যে কোন হামলা থেকে কোলন অঞ্চলকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল। অনেকদিনের ব্যবহারের পরে আর রক্ষণাবেক্ষণ না করায় এখন প্রাচীন দুর্গটির শুধুমাত্র একটু ভগ্নাংশ টিকে আছে। তবে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৫৬ সালে এই পুরো অঞ্চলকে জাতীয় উদ্যান বা ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর আরেকটি সমসাময়িক ঐতিহাসিক দিক হচ্ছে ১৮৮৩ সালে চালু করা কগ রেলগাড়ি যেটি আজও প্রচলিত আছে এবং অনেক টুরিস্ট আসেন এই রেলে চড়ে পাহড়ের চূড়ায় যাবার জন্য।

নতুন ক্যাসেল | পুরনো ক্যাসেলের ভগ্নাংশ

আমরা চারজন আস্তে ধীরে জিরিয়ে জিরিয়ে হেঁটে হেঁটে উঠছি পাহাড়ে। অনেকদিন পরে প্রকৃতির মাঝে এসে একটু বুক ভরে নির্মল বাতাস শরীরে প্রবেশ করে এক সুন্দর অনুভূতি পেলাম। ছোট-বড়-বয়স্ক সব বয়েসি মানুষজনই দেখা গেল। কেউ কেউ সাইকেল নিয়েও এসেছে। মাঝে একটু জিরিয়ে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য বিয়ারগার্ডেনও আছে। পাহাড়ের একটু উঁচুতে নতুন একটু প্রাসাদ বা ক্যসেল তৈরি হয় ১৮৮২–’৮৪ সালের দিকে, যার তৎকালীন মালিকের ভাগ্যে সেখানে থাকা হয়ে উঠেনি। তবে বর্তমানেও অত্যন্ত সুন্দর এই প্রাসাদটি অক্ষতভাবেই দাঁড়িয়ে আছে আর টুরিস্টদের জন্য টিকিটের মাধ্যমে ঢুকে দেখার ব্যবস্থাও আছে। বিভিন্ন বড় ইভেন্টে এটি ভাড়াও দেয়া হয়, যার অর্থের মাধ্যমে এর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। তবে প্রাসাদটি উপর থেকে দেখতে আরও বেশি সুন্দর মনে হয়, একদম যেন হ্যারি পটার কিংবা ডিজনির প্রাসাদের মতন।

তো আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে একসময় পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের চূড়ায়, ড্রাগনের দেশে। সেখানের ভিউপয়েন্ট থেকে চারদিকের দৃশ্য চোখ জুড়ানোর মতন। একদিকে সবুজে ঢাকা পাহাড় আর পাহাড়, তার পাদদেশে জনবসতি, অন্যদিকে রাইন নদীর আঁকা-বাঁকা বয়ে চলার দৃশ্য আসলেই অপরূপ। উপরের হাল্কা বাতাসে বেশ কিছুক্ষণ আশপাশ দেখে, আপেল জুস খেয়ে, খানিকক্ষণ জুড়িয়ে নিয়ে এখন নামার পালা। পাহাড় থেকে নামা সবসময়ই একটা কষ্টের কাজ। একদিকে যেমন নামার সময় উঠার মতন বিশেষ কোন মোটিভেশন থাকেনা, অন্যদিকে পায়ের উপরে প্রেশারটাও বেশি পরে। আর তার উপরে দীর্ঘদিন বাসায় বসে থেকে প্রায় জং ধরে যাওয়া শরীরের জন্য তো একটু কষ্ট বটেই। তবে এইরকম প্রকৃতির কাছাকাছি গিয়ে একটু শান্ত সময় কাটানোর জন্য খানিকটা ঘাম তো ঝরানোই যায়।

--

--