North-Eastern EuroTrip

7 countries, 25 days, 3500kms+

Nowshad
tripsharebd
11 min readSep 22, 2021

--

০৭ আগস্ট ২০২১

আমার বাসা বার্লিন সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে মোটামুটি দেড় কিমি দূর। হেটে গেলেও বিশ মিনিটের মতন লাগে। সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হলাম। বাসার কাছেই ট্রাম আছে সেন্ট্রাল স্টেশন যাবার। কাঁধের ব্যাগটা একটু ভারি, ভাবলাম ট্রামে যাওয়াই ভাল। কিন্তু বের হইতে হইতে কেমনে জানি দেরি হয়ে গেল। ট্রামটা চলে গেল, পরেরটা পনের মিনিট পরে!সেকেন্ড অপশন একটু হেটে গিয়ে বাস। বাসস্ট্যন্ডে গিয়ে দেখলাম গুগল ম্যাপ আর সেখানের শিডিউল মিলে না! দাড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করার মতন সময় নাই, কিন্তু ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম আর মাত্র আছে ১২ মিনিট কিন্তু সেখান থেকে হেটে যেতে লাগবে ১৭ মিনিট! দৌড়ানো ছাড়া গতি নাই। দৌড়ানোর অভ্যাস/ফিটনেস নাই একদিকে, অন্যদিকে কাঁধে ব্যাগ। একটু গিয়াই হাঁপায়ে গেলাম, কিন্তু থামার অপশন নাই, ট্রেনটা কোনমতেই মিস করা যাবেনা। এর মধ্যে পাশে দিয়ে বাসও চলে গেল, এক মিনিটের জন্য পরের ট্রামটাও মিস করলাম। দৌড়ে যখন স্টেশনের গেট দিয়ে ঢুকছি তখন মনে হল শরীরে আর এনার্জি নাই, দেড় মিনিট আছে, এর মধ্যে প্লাটফর্ম ১২ তে যেতে পারলে পারলাম, নাইলে নাই, আর দৌড়ানো সম্ভব না! কিন্তু ভাগ্য ভাল, ট্রেনটা ছাড়ার মোটামুটি ৩০ সেকেন্ড আগেই উঠতে পারলাম।

ট্রেনে উঠে হাঁপাচ্ছি দেখে পাশের এক ভদ্রলোক বলল — Seems like you had to run, but you made it!

আমি প্রায় অনেকক্ষণ দম নিয়ে শুধু বললাম — yeah, barely

অতঃপর ট্রেন ছুটে চলল পোলিশ ক্যপিটাল — Warsaw এর দিকে…

আমার টিমের দুই কলিগ এর বসবাস পোল্যান্ড এর Warsaw তে। তাই নিজে আর বিশেষ কিছু প্লান করি নাই। তাদের সাথে খাওয়া, গল্প-আড্ডা, ঘোরাফেরা করে ট্রিপের শুরুটা বেশ ভালই হল বলা যায়।

পরদিন একা একা টাউনের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে দেখলাম। Warsaw শহর বেশ মর্ডান বলা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে এইখানে আসলে এতই ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে যে পুরানো হাতে গুনা কয়েকটা স্থাপনা বাদে সবই আবার পুর্ননির্মান করতে হয়েছে। তাই বেশিভাগ বিল্ডিংই নতুণ, ওল্ড টাউনও আসলে পুরানো আদলে তৈরি করা নতুন স্থাপনার সমষ্টি! ঘুরে ফিরে পুরানো নতুন শহরের অনেকটাই দেখে আর পোলিশ মমো টাইপ কিছু ট্র্যাডিশনাল খাবার ট্রাই করে এবার পরের গন্তব্যের দিকে ছুটে চলার পালা

এর আগে দুই একটা দেশে যাওয়া হলেও কয়েকটা দেশে একসাথে যাওয়া হয় নাই, তাই এইবারের ট্রিপটা একটু স্পেশাল। তার মধ্যে অফিস থেকে ছুটি না নিয়ে ঘুরা আর কাজ একসাথে করাও একটা চ্যালেন্জ; তবে এক্সাইটিং চ্যালেন্জ।

Warsaw থেকে বাসে করে ৮ ঘণ্টার জার্নির পরে পৌছালাম লিথুনিয়ার রাজধানী ভিলনাস (Vilnius)। অবশ্য বাসে বসে ল্যপটপে কাজ করতে করতে ৮ ঘণ্টা বেশ তাড়াতাড়িই চলে গেল বলে মনে হয়েছে। Vilnius এ শহরের কেন্দ্র থেকে একটু দূরেই একটা প্রাকৃতিক পরিবেশের হোস্টেলে উঠলাম। একটু উঁচু-নিচু শহর, হোস্টেলের কাছে একটা ভিউপয়েন্টও আছে। তবে শহর অত বেশি বড় না, হোস্টেল থেকে হেঁটেই ১৫ মিনিটের মাঝে ওল্ড টাউন হয়ে একদম সিটি সেন্টারে চলে যাওয়া যায়।

Vilnius বেশ সুন্দর ছিমছাম শহর। ওল্ড টাউনটা বেশ সুন্দর আর ছিমছাম। বেশিরভাগ স্থাপনাই অক্ষত রয়ে গেছে বলে এখনো আসল ওল্ড টাউনই টিকে আছে। সরু অলিগলি ঘুরে ফিরে দেখলাম দেখতে দেখতে মনে হল যে একটা অডিও সেলফ গাইডেড ট্রিপ দেবার কথা। তো যেই ভাবা সেই কাজ, একটা অডিও ট্রিপ ডাউনলোড করে কানে হেডফোন গুঁজে বিভিন্ন জায়গার ইতিহাস শুনতে শুনতে মূল শহরের অনেক গুরুত্তপুর্ন স্থাপনা দেখে দেখে ঘুরে বেরালাম। একদিকে যেমন ঘন জঙ্গলের ভেতর গেদিমিনাসের ভিলনিয়াস এর গোড়াপত্তন করার কথা জেনে অবাক হলাম, অন্যদিকে ওজুপিস হিপস্টার রিপাবলিকের কথা জেনে মজাও লাগল বেশ।

একটু লোকাল খাবার হিসেবে ঠাণ্ডা বিটরুট সুপ একটা স্পেশাল খাবার। সুপ মানে সাধারণত গরম খাবার বলে জানি, কিন্তু এখানে ঠাণ্ডা সুপের অভিজ্ঞতা খারাপ লাগল না।

ভিলনিয়াস এর শেষ দিন একটা কন্সার্ট হল হোস্টেলে, লোকাল মানুষজনের ভিড় ট্রাভেলারদের থেকেও বেশি। তবে বেশ উপভোগ্য ছিল, লোকাল গান বাদেও অনেক পরিচিত ইংরেজি গানের পরিবেশনা হল। শেষ দিনে একটা ভাল সন্ধ্যা কাটালাম আর কি!

রিগা রিগা রিগা - এক কথায় সুন্দরের ছড়াছড়ি। সেটা সুন্দর ছিমছাম শহর, কাছের বাল্টিক সাগরের বিচ কিংবা নারী, যেটাই বলিনা কেন, লাটভিয়ার রাজধানী রিগা অতুলনীয়।

শনিবার রিগার একদম মাঝামাঝি একটা হোস্টেলে উঠলাম। দুই তরুণ বন্ধু এই হোস্টেল চালায়, একদিকে তারা যেমন অন্যদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ অন্যদিকে তাদের ব্যবস্থাপনাও চমৎকার। অনেকের সাথে গল্প, পরিচয় হল হোস্টেলের লবিতে। এই প্রথম আমার কাছে মনে হল যে সোস্যালাইজ করা খুব একটা কঠিন কাজ না, হয়তো হোস্টেলের পরিবেশের কারণেই।

রাতে হোস্টেলের প্রায় সবাই একটা ওপেন এয়ার ক্লাবে গেল, আমিও কৌতূহল মেটাতে যোগ দিলাম। কারণ আজকে সাইলেন্ট ডিসকো তে যাচ্ছে সবাই, আমি আগে ইউটিউবে দেখেছি মানুষজন হেডফোন কানে লাগিয়ে নাচানাচি করছে, কিন্তু এমনিতে বাইরে কোন মিউজিক নাই! ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত দেখালেও বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হল। তবে কানে হেডফোণ লাগাতেই সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। তিনদিকে তিন ডিজে তিনরকম মিউজিক বাজাচ্ছে, আর হেডফোনের সুইচ টিপে এই তিনটার যেকোনোটাই শোনা যায়। আর লাল, নীল, সবুজ এই তিন রঙের বাতি জ্বলে মিউজিক এর উপর নির্ভর করে। তাই দেখলেই বোঝা যায় যে কে কোন মিউজিক শুনছে।

শেষ রাতে হোস্টেলে ফিরলাম, তারপরে মরার মতন ঘুম দিয়ে সকাল প্রায় ১০টায় উঠলাম। হোস্টেলের কিচেনে গরম গরম ওয়াফেল বানানো হচ্ছে, তা তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম ফ্রি ওয়াকিং ট্যুর এ। টাকা ছাড়াই গাইডেড ট্যুর প্রায় ৩ ঘণ্টার, রিগা শহরের ওল্ড টাউন থেকে শুরু করে বিশাল বড় খোলা বাজার, ইতিহাস থেকে খাবার, সবই কভার হল এই হেঁটে বেড়ানো ট্রিপে। ট্রিপ শেষ হল ট্র্যাডিশনাল খাবার দিয়ে, সাথে সুন্দরী গাইড। তারপরে বিকেলে বেলায় চলে গেলাম রিগার কাছেই বাল্টিক সাগরের পাড়ে জুরমালা বিচে। সাগরের পাড়ে হেঁটে হেঁটে সুযাস্ত দেখে দেখে একসময় ফিরলাম হোস্টেলে।

রিগা থেকে টালিন, এস্তোনিয়া - এই প্রথম দুই দেশের বর্ডারে পুলিশ চেকের জন্য বাস থামল, পুলিশ সবার পাসপোর্ট চেক করা শেষ হলে আবার যাত্রা চলল। টালিন নেমেই প্রথমে যেটা বুঝলাম যে আমার এই রকম ঠাণ্ডা বাতাসে থাকার জন্য কোন ভাল জ্যাকেট বা সোয়েটার নেই ব্যাগে। ট্রিপ শুরুর সময় আবহাওয়া ভাল দেখায়, শুধু একটা পাতলা হুডি বাদের সবই গরমের দিনের কাপড়। তাই টালিন এ হোস্টেলে চেক ইন করার পরের প্রথম কাজ ছিল একটা বাজেটের মধ্যে জ্যকেট কেনা। মার্কেটে গিয়ে স্বভাব বসতই মাস্ক পড়লাম, কিন্তু ভেতরে ঢুকে দেখি কারো মুখেই মাস্ক নেই! কোভিড শুরুর পরে এই দৃশ্য এই প্রথম চোখে পড়ল, মাস্ক পড়ার কড়াকড়ি কোন নিয়ম নেই এখানে!

একটু ট্রায়াল এর পরে ২০ ইউরো দিয়ে মোটামুটি একটা জ্যাকেট কেনা গেল। তারপরে চলে গেলাম টালিন পোর্টে। এই প্রথম পোর্টে ক্রুজ শিপ ভেড়ানো দেখলাম, আগে টিভি বা ইন্টারনেটে এই বড় জাহাজগুলো দেখছি, আজ নিজেই দেখছি, দেখেই কেমন জানি মনে হল এত কাছে এসেও চড়া হবেনা নাকি! তখনি মনের মাঝে চিন্তা এল আমার ট্রিপকে টালিনে শেষ না করে আরও দূর পর্যন্ত যাবার, তবে কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না।

পরদিন একটু বৃষ্টি, অফিসের কাজ শেষে ছাটা হাতে ওল্ড টাউন দেখতে বেরুলাম। বেশ সুন্দর, একটা পাহাড়ি এলাকায় এই পুরানো টাউন। সরু অলিগলি, পুরানো ধাঁচের স্থাপনা বাদেও সেখানে দুইটি ভিউপয়েন্ট আছে। এর দ্বিতীয়তটিতে গিয়ে দেখা হল টালিগঞ্জের এক তরুণ অভিনেতা ও তার বাবার সাথে, তারা এখানে শুটিং করতে এসেছেন। দুই দেশ হলেও বাঙ্গালি কাউকে পেয়ে তারাও বেশ খুশিই হলেন। তাদের নিয়ে ওল্ড টাউন ঘুরে সন্ধ্যা রাতের পোর্ট দেখতে গেলাম, তারপর হোস্টেলে ফিরলাম। পথে আমার রিগার হোস্টেলে পরিচয় হওয়া আরেক ট্রাভেলারের সাথে দেখা হয়ে গেল! তারা পরদিন ফেরিতে হেলসিঙ্কি, ফিনল্যান্ড যাচ্ছে।

হোস্টেলে ফিরে মনে হল যে আগের প্লান মতন এস্তোনিয়া থেকে বার্লিন ফিরে যাব কি যাবনা! জ্যকেট তো কিনেই ফেলেছি, তাই রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এটা সেটা ভেবে শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেয়েই নিলাম হেলসিঙ্কি যাবার।

সকালের ফেরির টিকিট কেটেছি, বড় জাহাজ, দুই ঘণ্টার জার্নি টালিন থেকে হেলসিঙ্কি। ফেরির পোর্ট একদম এয়ারপোর্টের মতন। ইমিগ্রেশন, বোর্ডিং পাস, চেক - সবকিছু পেরিয়ে ফেরিতে উঠে পড়লাম। এই প্রথম এত বড় জাহাজে উঠলাম, ছয়তালা জাহাজের এদিক সেদিক ঘুরে দেখতে দেখতেই যেন দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেল! আর বড় জাহাজে উঠার ইচ্ছা অল্প সময়ের জন্য হলেও পূরণ হল।

হেলসিঙ্কি, ফিনল্যান্ড - ছিমছাম ও পরিষ্কার শহর। এই ট্রিপের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে এক্সপেন্সিভ শহর। ভাবাই যায়না যে মাত্র দুইঘন্টার দূরত্বে টালিনে সবকিছুর মূল্য হেলসিঙ্কির অর্ধেক ছিল! হোস্টেল থেকে শুরু করে খাবার, সবকিছুর জন্যই বিল দিতে গেলে বুঝা যায় কিভাবে পকেট খালি হচ্ছে। তবে যে হোস্টেলে উঠলাম, সেটা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভাল কোয়ালিটির হোস্টেলগুলোর একটা। সেখানেই অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হল, নানা দেশের নানান মানুষ। ইতালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, আমেরিকান, জার্মান, ফিনিশ, আরও কয়েকজনের সাথেও কথা হল। খরচ কমানোর জন্য কয়েক বেলা হোস্টেলে কিচেনে রান্না করার সময় গল্প কিংবা একসাথে কিছু বানানো, বোর্ড গেম, ঘুরতে যাওয়া, এসবের মাঝে কয়েকদিনের জন্য হলেও হোস্টেলের বাকিদের সাথে বেশ ভাল সময়ই গেছে।

এত মানুষের মধ্যে অনেকেই পুরো ইউরোট্রিপ দিচ্ছে, তবে বেশিরভাগই ২০-২২ বছরের স্টুডেন্ট যারা গ্যাপ সেমিস্টার বা বছরে ঘুরাঘুরি করছে, সেখানে নিজের ২৭ বছর বয়টাকেই অনেক বেশি বলে মনে হয়, তাদের সাথে এনার্জিতে পেরে উঠাও কঠিন কাজ বটে।

হেলসিঙ্কির মূল লাইব্রেরিতে গেলাম একদিন অফিসের কাজ করবো বলে, সে কি এক জায়গা। মর্ডান আর্কিটেকচার এবং একটা জাতির শিক্ষায় ইনভেস্টমেন্ট দেখে আসলেই অবাক হলাম। ৪ তলা এই লাইব্রেরি শুধু দেখতেই সুন্দর না, সব রকম মানুষের জন্যই পড়া, কাজ করার ব্যবস্থা আছে যা সবার জন্যই উন্মুক্ত।

অফিস থেকে একদিন ছুটি নিলাম আবহাওয়া একটু ভাল থাকার কারণে। হেলসিঙ্কি পোর্ট এ গেলাম, সেখানে গিয়ে সমুদ্রের পাড়ে বসে স্যালমন স্যুপ আর রেইনডিয়ার মিটবল টেস্ট করা হল - খেতেও বেশ। তারপর ফেরিতে চড়ে কাছেই সোমালিনা আইল্যান্ড এ গেলাম। পুরানো নৌবাহিনীর ঘাটি ছিল এই দ্বীপে, এখন কিছু মানুষের বসবাস এখানে আর ট্রুরিস্টদের আনাগোনা। হেঁটে হেঁটে এদিক সেদিক দেখে একটা দোলনা পাওয়া গেল, চারজন দোলনায় বসে গল্প করতে করতে ১ ঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম, ফিনিশ দ্বীপে সমুদ্রের বাতাস, মিষ্টি রোদ, আরামে একটু ঘুম ঘুম লাগছিল। তাই উঠে গিয়ে ট্রেডিশনাল এক রেস্টুরেন্টে খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিলাম। তারপর আবার ফেরত আসলাম হোস্টেলে।

পরদিন একটা সাইকেল ভাড়া করে পুরো শহরের বিভিন্ন জায়গা, বিচ এ ঘুরে বেড়ালাম। আর রাতে আমাদের ইতালিয়ান বন্ধু লেট নাইট Risotto রান্না করে খাওয়াল। চারটা ভাল দিন কাটিয়ে বিদায় নিলাম সবাই ই কম বেশি।

ফেরি জার্নি শেষ হয়নি, হেলসিঙ্কি থেকে বাসে করে গেলাম টুর্কূ নামক আরেক পোর্ট সিটিতে। পথে অবাক হয়ে ফিনিশ ল্যান্ডস্কেপ দেখলাম, অদ্ভুত সুন্দর! টুর্কূ নেমে পোর্টে গিয়ে আবারো সব চেক পার হয়ে বড় জাহাজে উঠে পড়লাম।

আজকের জাহাজ/ফেরি আগের দিনের চেয়েও বড়, মোট ১০ টা ফ্লোর লিফটে। তাতে এহেন কিছু নেই যা নেই। কয়েকটা ট্যাক্স ফ্রি শপিং স্টোর, কয়েকটা ভিন্ন ভিন্ন বড় রেস্টুরেন্ট-বার, এন্টারটেইনমেন্ট কর্নার, ক্যাসিনো, কি নেই, একটা ছোট খাট শহর বানানো যেন!
এই বারের জার্নি প্রায় ১০ ঘণ্টার বেশি, আমার একটা ছোট প্রাইভেট রুম আছে ফেরিতে, সেটায় টিভি, এসি, প্রাইভেট বাথ, ইন্টারনেট সহ সব সুবিধাই আছে, আর টিকিটের দামও কম! ওভারনাইট জার্নি, তবে প্রথমে রেস্টুরেন্টে গিয়ে রাতের খাবার খেলাম, তার পরে পাশে লাইভ মিউজিক হচ্ছিল সেখানে কতক্ষণ গান শুনে চলে গেলাম জাহাজের সবচেয়ে বড় ইভেন্টে, ফুল সাইজ কন্সার্ট। দুই তলা গ্যালারি, জানালার পাশে বসে ছোট ছোট দ্বীপের বাতি পেছনে ফেলে ছুটে চলেছি, আর স্টেজে গান-বাজনা বাজছে। প্রায় রাত ১ টা পর্যন্ত সেখানে থেকে রুমে এসে ঘুম।

স্টকহোম, সুইডেন - সকাল ৬ টার দিকে এসে পৌছালাম সুইডিশ ক্যপিটালে। একটা স্কুটারে করে চলে গেলাম হোস্টেলে। এবারের হোস্টেলও বেশ ভাল, সবাই এই হোস্টেলের ভাল রিভিউ দিয়েছে যাদের সাথে আগে দেখা হয়েছে। একটা কোজি, সোশ্যাল পরিবেশ। সবাই মিলে আড্ডা দেয়া, রান্না করা, বা ঘুরতে যাওয়া সব মিলিয়ে বেশ ভাল সময় গেল সেখানে।

স্টকহোম তুলনামূলক হেলসিঙ্কি থেকে একটু কম খরচের জায়গা। বাইরে খেলাম বেশ কয়েক বেলাই। ঐ সময়ে স্টকহোম এ এক বড় ভাই থাকায়, এক বেলা তার সাথেও দেখা হয়ে গেল।

স্টকহোম লাইব্রেরিও দেখার মতন সুন্দর। একটা সিলিন্ডার আকৃতির টাওয়ারের চারিদিকে বই, ছবির ফ্রেমের মতন একদম। স্টকহোম এর পোর্ট এলাকাও বেশ সুন্দর, ই-স্কুটার নিয়ে এমাথা থেকে সেমাথা ঘুরে বেড়ালাম, সুর্যাস্ত উপভোগ করলাম সমুদ্রের পাশে, আস্তে আস্তে শহুরে বাতিগুলোর জ্বলে উঠার দৃশ্য দেখে দিন কেটে গেল।

ফ্লিক্সট্রেনে করে স্টকহোম থেকে গথেনবুর্গ আসলাম, আসার রাস্তাটাও বেশ সুন্দর। এখানের হোস্টেলে এসে দুই অস্ট্রিয়ানের সাথে ফের দেখা, বেশ ভালই গল্প জমল রাতের খাবার টেবিলে। পরদিন আসে পাশে শহরের ভেতর ঘুরে বিকেলের দিকে গেলাম গথেবুর্গ আর্কিপেলাগো ভ্রমণে।

মেইনল্যান্ড থেকে কয়েক কিমি দূরে একগুচ্ছ ছোটছোট আইল্যান্ড মূলত, সেগুলোতে রঙ্গিন বাড়িঘর। আগে এগুলো স্ক্রিনেই দেখছি, সামনে থেকে দেখতে বেশ অন্যরকমই লাগছিল। নিয়মিত ফেরি আছে এক আইল্যান্ড থেকে অন্যটার যাবার জন্য। কোন গাড়ি চলেনা এই আইল্যান্ড গুলতে, তবে সবারই গলফ কার্ট এর মতন ছোট ছোট গাড়ি আছে। কেমন যেন একটা শান্তি শান্তি জীবন এখানে!
তিনটা আইল্যন্ডে ঘুরে দেখলাম, অনেক হাটাহটি করে বেশ ক্ষুধা পেলে একটা পিজ্জারিয়াতে ঢুকে ক্ষুধার নিরসন করলাম। এরপর পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখিয়ে ফিরে এলাম হোস্টেলে।

৪ ঘণ্টার বাস জার্নির পরে পৌছালাম কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক। বাড়ি ফেরার আগে এই শেষ স্টপ। দুইদিন এই সুন্দর শহরে থাকা। কয়েকজন মানুষের সাথে শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত ফিশিং স্ট্রিট এ ঘুরে বেড়ানো, ফেরিতে করে এইমাথা থেকে ওইমাথা দেখা, আধুনিক লাইব্রেইরিতে বসে অফিস করা, চালকবিহিন মেট্রো করে ঘুরে বেড়ানো, সাইকেল চালিয়ে পোর্ট এরিয়া ঘুরে দেখা, রাতের আলোক ঝলমলে কোপেনহেগেন - সব মিলিয়ে ছোট হলেও সুন্দর দুইদিন পার করে ফেললাম কোপেনহেগেন। তারপর বাড়িফেরার পথ ধরলাম।

ফ্লিক্সবাসে কোপেনহেগেন থেকে বার্লিন, ৮ ঘটার রাস্তা, মাঝে ২ ঘণ্টার ফেরি পারাপারও আছে। ফেরিতে উঠে জানালাম পাশে বসে উদাস হয়ে আস্তে আস্তে দূরে সরে যাওয়া ডেনমার্কের দ্বীপগুলো দেখছিলাম আর চোখে গত ২৫ দিনের সব স্মৃতিগুলোর যেন একটা হাইলাইট ভেসে উঠল। শেষ বিকেলের সোনালি রোঁদের আলো যখন শরীর ছুঁয়ে দিল, রস্টক পোর্টে এসে তখন একটা স্বস্তির অনুভূতি খেলে গেল মনে ও শরীরে - ঘরে ফিরে এলাম যেন, পরিচিত যায়গায়, পরিচিত ভাষায়, পরিচিত এই প্রবাস জীবনে...

--

--