Weekend in Hamburg

A city of bridges

Nowshad
tripsharebd
6 min readJan 14, 2020

--

অফিসে বসে কাজের ফাকে প্রায়ই কম খরচের ফ্লাইট কিংবা বাসের টিকিটের অফার খোজাখোজি করা হয়। তো সেদিন দেখতে দেখতে ব্লা ব্লা বাস এর ১ ইউরোর অনেকগুলো ডিল খুঁজে পেলাম। প্রায় ৪-৬ ঘণ্টার বাস জার্নি মাত্র ১ ইউরো! ভাবলাম অন্য কোন বড় শহরে ঢু মেরে আসি। আমার শহর কোলনের চেয়ে বড় আছে বার্লিন, হামবুর্গ এবং মিউনিখ। দেখে শুনে বেছে মনস্থির করলাম যে বন্দর নগরী হামবুর্গ যাব। তবে যেসব বাস টিকিটের দাম ১ ইউরো সেগুলো দেখা গেল যে সুবিধাজনক সময়ে না, হয়ত বিকেলে নয়তো সন্ধ্যায়। একেতো বাসে যেতে সময় ট্রেন এর দিগুণ লাগে, তার মধ্যে এই অসময়ে গিয়ে আর ঘুরে পোষাবে না। কিন্তু যাওয়ার সিদ্ধান্ত যেহেতু নিয়েই নিলাম, যেতে তো হবেই!

ফ্লিক্সবাসে করে ইতোমধ্যে কয়েকটা ট্রিপ দেয়া হয়ে গেছে, তবে এদের ট্রেন সার্ভিস ফ্লিক্সট্রেন এখনো দেখা হয়নি। ওদের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখলাম কোলন থেকে হামবুর্গ চার ঘণ্টার জার্নি রাউন্ড ট্রিপ সুবিধাজনক সময়ে ৩০ ইউরো, তার মধ্যে আমার ছিল ২০% ডিস্কাউন্ট। আমি আর আমার অফিসের টিমমেট টিকিট কেটে, হোস্টেল বুক করে ফেললাম।

শনিবার ভোর ৬ টায় উঠে রেডি হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে গেলাম কোলন স্টেশনে। স্টেশনে এই অন্ধকার ভোর বেলাতেও মানুষের অভাব নেই, দোকানপাটও বেশিরভাগই খোলা। এখন শীতকালে আলো হয় সকাল ৮টা নাগাদ। সকালের খাবার কিনে খেয়ে ৭টার দিকে ট্রেনে উঠে পড়লাম। এই ট্রেনগুলো একটু পুরানো ধাঁচের। আমাদের দেশের ফার্স্টক্লাস কেবিন ট্রেন এর মতন অনেকটা, তবে মানের দিক দিয়ে অনেক ভাল, বিশেষকরে বাথরুম।

ট্রেন এ ভিড় তেমন একটা নেই। একটা কেবিনে মোট ৬ টা সিট থাকলেও মানুষ কম হওয়ায় প্রায় সব কেবিনেই যাত্রীরা আরামে শুয়ে বসে আছে, আমরাও দুইজন দুই সিটে পা তুলে শুয়ে থেকে জানালা দিয়ে সকাল হওয়া দেখতে দেখতে একসময় ১১টার দিকে হামবুর্গ পৌঁছে গেলাম।

হামবুর্গ জার্মানির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বার্লিনের পর। সাগর এর পাশে এই বন্দর নগরীর একটা বিশেষ দিক হচ্ছে ক্যানেল ও ব্রিজ। সাধারণত ক্যানেল এবং ব্রিজ এর জন্য ইতালির ভেনিস কিংবা নেদারল্যান্ডস এর আমস্টারডাম বিখ্যাত হলেও হামবুর্গের ব্রিজ সংখ্যা ভেনিস এবং আমস্টারডাম এর মিলিত ব্রিজ সংখ্যার চেয়েও বেশি!

বিশাল বড় ট্রেন স্টেশন, অনেকদিকের ট্রেন, অনেক মানুষের ছুটোছুটি। অনেক অনেক খাবার দোকান, দামি কমদামী, দেশি বিদেশি সব রকমই পাওয়া যায়। জার্মানির সেন্ট্রাল স্টেশনগুলোর বাইরের আর্কিটেকচারও দেখার মতন। স্টেশন থেকে যখন বের হই তখনো গুগল ম্যাপের দিকে তাকিয়ে আছি কোনদিকে যাওয়া যায় সেটা ঠিক করতে। বিশেষ কোন প্লান নিয়ে আসলে হামবুর্গ আসা হয়নি, আর অনেক বেশি দৌড়ঝাপ করারও ইচ্ছে নেই, যেহেতু উইকেন্ড এবং সোমবার থেকে অফিস তাই একবারে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরার ইচ্ছা নেই।

ম্যাপ দেখে মূল শপিং স্ট্রিট বরাবর হাটা শুরু করলাম। সাধারণত এত প্রশস্ত রাস্তা বিশেষ করে শপিং স্ট্রিট এই পর্যন্ত আমি আর কোন শহরে দেখিনি, হেটে আরেকটু এগিয়ে খেয়াল করলাম যে আসলে হামবুর্গে মূল রাস্তা কম বেশি সবই কোলনের তুলনায় হাইওয়ে সাইজের রাস্তা, ছুটির দিনে রাস্তাগুলোয় গাড়ী আর মানুষ দুটোই কম থাকায় একটু বেশীই ফাকা ফাকা লাগছে। শপিং স্ট্রিটে পৃথিবীর সব নামকরা ব্রান্ড এর দামি দামি দোকানপাট আর আসে পাশে পুরানো ধাঁচের বিল্ডিং। হাটতে হাটতে সেইন্ট জ্যাকোবি (St. Jacobi) নামের ১৭০০ শতাব্দির বিশাল আকৃতির চার্চ এর সামনে চলে আসলাম, বাইরে অনেক চার্চের মতন বেশী বেশী কারুকার্য না থাকলেও এর বিশালাকৃতি চোখে পড়ার মতন। এক ব্লক সামনেই ঠিক একই রকম দেখতে আরেকটি চার্চ (St. Peter’s), এর একটু সামনেই রাথহাউস (Townhall) বা হামবুর্গ সিটি সেন্টার। বিশাল প্যলেস এর সামনে একটা ফাকা চত্বর যার দুইদিকেই শহরের বিভিন্ন দিকগামি বাসের স্টপ। প্রায় পুরোনো সব স্থাপনারই ছাদগুলো কেমন একটা সবুজাভ বা পেস্ট কালারে রঙ করা।

একটু ক্ষুধা পেয়ে গেছিল, তাই এক রেস্টুরেন্ট থেকে মাছের বড়ার মতন কিছু একটা কিনে খেতে খেতে খেতে আবার হাটা। হেঁটে আরেকটু সামনে গিয়ে দেখলাম শহরের অনেক স্থাপনাকে ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকা বেল টাওয়ার — সেইন্ট নিকলাস মেমোরিয়াল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পরে এটি আসলে একটা প্রাচীন চার্চ এর অবশিষ্ট।

একসময়য় হামবুর্গের বুকে বয়ে চলা নদী এলবে (Elbe) এর ধারে চলে এলাম। এখানে এসে প্রথমেই যেটা চোখে পড়ল তা হচ্ছে Speicherstadt। লাল ইটের বানানো প্রায় একই গড়নের বিল্ডিং এর সারি। একটু ইন্টারনেট ঘেটে জানলাম যে প্রায় দেড় কিমি লম্বা, নদীর মাঝের এই দ্বীপটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গুদাম (Warehouse)। ছোট ছোট ক্যনেল আর দুইপাশে সারি সারি কয়েকশ বছর আগের লাল ইটের স্থাপনা, দেখার মতন সুন্দর। বর্তমানে অবশ্য রিনোভেশন করে এগুলোকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে।

সেখান থেকে আরেকটা ছোট্ট ব্রিজ পেরুলেই হামবুর্গের সবচেয়ে আইকনিক স্থাপনার সামনে পৌঁছে গেলাম — Plaza Elbphilharmonie। একই সাথে ওয়েস্টিন হোটেল, মিউজিক থিয়েটার এবং অবজারভেশন ডেক। সাধারণ মানুষের জন্য প্রবেশ ফ্রি। এখানের মজার ব্যপার হচ্ছে, টিকিট নিয়েই ঢুকতে হয়, যেটা আসলে ফ্রি এবং দুইটা বিশাল লম্বা সুরঙ্গ মতন যার মধ্যে দিয়ে এস্কেলেটার করে উপরে উঠতে হয়। আমার দেখা সবচেয়ে লম্বা এস্কেলেটার। ডেক এ চারিদিকের ভিউ পাওয়া যায়, একদিকে ব্যাস্ত পোর্ট, দুইদিকে নদীতে ফেরি, জাহাজের ব্যস্ততা, আরেকদিকে শহরের কোলাহল, বেশ ভালই সময় কাটালাম এক কাপ কফি খেতে খেতে।

সেখান থেকে নেমে পুরো আইল্যান্ড ঘুরে বেশ ভালই ক্ষুধা পেয়েছিল। আমাদের হোস্টেলের পথেই সেন্ট্রাল স্টেশন, তাই সেখানে এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে ঢুকে পেটপুজো করলাম। তারপর হোস্টেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট।

সন্ধ্যার দিকে আবার বেরুলাম, হেঁটে এবার স্টেশন পেরিয়ে গেলাম হামবুর্গের মাঝে থাকা লেক এ। লেক এর চারদিক ভালই মানুষের আনাগোনা, শপিং স্ট্রিট, বোট রেস্টুরেন্ট, অনেক কিছুই আছে। সেখানে বেশ কিছুক্ষন রাতের আলোয় হামবুর্গ দেখার পরে আবার গেলাম দুপুরের Plaza Elbphilharmonie তে রাতের আলোয় উপর থেকে চারিদিকটা দেখবো বলে। হলুদ-নীল আলোয় রাতের হামবুর্গ এবং পোর্ট দেখতে বেশ সুন্দর। সেখান থেকে নেমে পোর্টে একটু হাঁটাহাঁটি করে বেশ ক্ষুধা পেয়েছিল, তাই ফেরার পথে এক ইতালিয়ান রেস্টুরেন্ট এ ঢুকে পিজ্জা আর ডেসার্ট খেয়ে রাতের খাবারের পালা চুকালাম। আর সারাদিনের সকল ক্লান্তি নিয়ে হোস্টেলে ফিরেই ঘুম।

রবিবার সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরিই হল, এক দিকে আবহাওয়া খুব একটা সুবিধার না, অন্যদিকে আগেরদিনের ধকলে পা ব্যাথা। তাই ভাবলাম, আজ আর তেমন একটা হাটাহাটি করে কাজ নেই। তাই ডে টিকিট কিনে ট্রাম এ করে চলে গেলাম নদীর ধারে ফেরি ঘাটে। বিভিন্ন দিকের ফেরি আছে, প্রথমে একটায় চড়ে গেলাম নদীর অপর পাশে যেখানে পাশাপাশি দুইটা বিশাল থিয়েটার। বেশ সুন্দর লাগে অন্য পাশ থেকে হামবুর্গ শহর দেখতে।

ফেরিতে ওপারে ফিরে একটু এগিয়ে গেলেই একটা পুরাতন ডোম এর নিচে লিফট। এই লিফটে করে পৌঁছে গেলাম নদীর নিচে দিয়ে চলে যাওয়া টানেল এ (Alter Elbtunnel)। পুরো টানেল টাইলস এ মোড়ানো এবং প্রায় ১২০-১৫০ মিটার গভীরতা। ভেতরে হাটা বা সাইকেল চালিয়ে এপার থেকে ওপারে আসা যাওয়া করা যায়। সেখানে এপার-ওপার ঘুরে ফিরে একটু ক্ষুধা পেল।

ট্রামে করে সিটি সেন্টারে গেলাম, একটা ভিয়েতনামিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকে পেট ভরে খেলাম।

বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি, তাই এই ঠাণ্ডায় আর হাটতে ভাল লাগছিল না। চড়ে বসলাম বাস এ, তারপর সেই বিশাল লেকটার চারপাশে বাসে বসেই জানলা দিয়ে শহরটা দেখার চেষ্টা করলাম। দুইটা বাস চেঞ্জ করে পুরো শহরের যদ্দুর দেখা যায় দেখলাম। তারপর U3 নামের একটা ট্রেন লাইন আছে যেটার মূল সিটির চারদিকে চক্কর দেয়, সেটায় উঠে পড়লাম। পুরো এক চক্কর ধরে বসে রইলাম ট্রেন এ। শহরের ব্যস্ত এলাকা থেকে শুরু করে নীরব আবাসিক এলাকাও দেখা হল।

সন্ধ্যা ৬টার দিকে স্টেশন এলাম, একটা কফি শপ এ বসে কফি খেলাম আর ফোন চার্জে দিলাম। তারপর স্টেশনের ভেতরে ঢুকে ফিশ এন্ড চিপস খেয়ে ৭টার দিকে আমাদের ফেরার ট্রেন এ উঠে পড়লাম। আসার সময়েও দুইজন এক কেবিনে রাজার হালে শুয়ে বসে ঝিমাতে ঝিমাতে রাত ১১ঃ৩০ এর দিকে কোলন পৌছালাম। আর এরই সাথে সপ্তাহান্তের ট্রিপ এর সমাপ্তি ঘটল।

--

--