মুখস্ত করতে করতে আর প্রয়োগ করাই হলো না
বোঝার সুবিধার জন্য একটা উদাহরন দিয়ে শুরু করা যাক। — গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের কথাই ধরা যাক।
এই সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদ তুলে ধরা হলো:
আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া ২[ জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের] মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি;
৩[ আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল -জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে ;]
আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;
আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্খার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেইজন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য;
পুরো সংবিধানটি বাংলায় এখানে এবং ইংরেজীতে এখানে ডাউনলোড করে পড়তে পারবেন।
এই সংবিধানটির উদ্দেশ্য হলো একটি দেশ ও তার শাসন ব্যবস্থা, জনগন কিভাবে চলবে, কোন নীতিমালা অনুসরণ হবে, রাষ্ট্র যে আইন প্রয়োগ করে নাগরিকদের বিধান প্রদান করবে তার মহাকাঠামো বা সুপার স্ট্রাকচার প্রদান করা। খুব ভালো কথা।
বাংলাদেশের সংবিধানে মোট ১৫৩টা অনুচ্ছেদ আছে।
এখন কেউ যদি এসে অন্য আরেকজনকে বলে, ভাই সংবিধান থেকে এই পাঁচটা বা দশটা অনুচ্ছেদ মুখস্থ করবা। অনুচ্ছেদ মুখস্থ করাই তোমাদের ধ্যান ও জ্ঞান হবে। এর বাইরে যদি এই গোষ্ঠির (যারা মুখস্থ করে ও করায়) আর কোন কাজ না থাকে, অর্থাৎ তাদের মধ্যে যদি রাষ্ট্র শাসনের, রাষ্ট্র পরিচালনার কোন অবস্থান, পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য না থাকে সেক্ষেত্রে এই মুখস্ত করাকে নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু বলা যাবে?
সংবিধানের উদ্দেশ্য কি মুখস্ত করা ছিলো?
এখন আসি কোরআনের কথায়। স্রষ্টা যদি একজন থেকে থাকেন, তিনি সমগ্র মানবজাতির সংবিধান হিসেবে মহাপ্রভুর তরফ থেকে খুব অল্প কথায় এই কোরআনকে একটি সংবিধানের মতো করে পাঠিয়েছেন মানুষের জন্য। (পুরো কোরআনে লিগাল ইন্সট্রাকশন বা ফ্রেমওয়ার্ক খুব মিনিমাল কিন্তু এখানে মোটাদাগে মানুষের সমাজের ও জীবনব্যবস্থার প্রায় সব বিষয়গুলো এসেছে — যেমন: অর্থনীতি, ভূমি বন্টন, পরিবার, ব্যক্তিগত, প্রার্থনা, কল্যান রাষ্ট্রের ট্যাক্স, অসহায় যেমন এতিম ও বিধবা বা দরিদ্রের দেখ ভাল, ন্যায় শাস্ত্র, শত্রু মোকাবেলায় যুদ্ধনীতি তাও কেবল আগ্রাসীর বিপক্ষে, আগ্রাসনের মোকাবেলায় শুধুমাত্র)
আচ্ছা সব মানুষ বাদ দিলাম, যারা তথাকথিত ধর্মের বিভেদে বিশ্বাসী, তাদের ভাষায়, তথাকথিত মুসলিমদের জন্য সংবিধান।
তাই যদি হয়, তাহলে এর উদ্দেশ্যে ছিলো: এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ক্ষমতার মালিক ও বিধানদাতা হিসেবে স্রষ্টাকে যারা মেনে নিচ্ছে তারা তাদের জীবনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য এই কোরআনকে সংবিধান হিসেবে গ্রহন করবে, এর প্রাথমিক আউটলাইন ব্যবহার করে মুখ্য বিষয়গুলো সম্পর্কে যে গাইডেন্স দেওয়া হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে সময়ের প্রয়োজনে মানব সমাজ পরিচালনা করবে।
তো সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে, এই স্রষ্টার সংবিধানকে যে বা যারা সুর করে মুখস্ত করার ও পড়ার প্র্যাক্টিসকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে তাদের কাজকে আসলে কি বলবেন?
আমি নই, স্বয়ং স্রষ্টাই কুরআনের ভাষায় এ ধরনের জনগোষ্ঠিকে “ কিতাব বহনকারী গাধা” (৬২:৫) বলে ধিক্কার দিয়েছেন। গাধা যেমন জানে না তার পিঠের বইয়ের জ্ঞান বা সেই জ্ঞানের প্রযোগ অথচ বহন করেই যায়, নাই কোন উদ্দেশ্য; তেমনি তথাকথিত মুসলিমরা কি গত ১৪০০ বছর ধরে সেই ধরনের কাজই করছে না?
আবার আরেক গোষ্ঠি আছে যারা সংবিধানটির কোন কোন অনুচ্ছেদনকে তাদের মুরিদদের বিশেষভাবে মুখস্ত করার ইন্সট্রাকশন দেয়। অমুক অমুক সুরা মুখস্ত করে আসো। তাদের মুরিদরাও নিজেদের মধ্যে বড়াই করে, জানিস আমি অমুক কয়টা সুরা মুখস্ত পড়তে পারি, তুই এখনো মুখস্ত করতে পারিস না?!
বাংলাদেশের সংবিধানের কয়েকটা অনুচ্ছেদ মুখস্ত করে কেউ যদি বড়ামি করে, সেটা যতখানি অর্থহীন, কুরআন মুখস্ত করা নিয়ে যে ধরনের প্রতিযোগিতা আর ব্যস্ততা, তার অর্থহীনতা এর চেয়েও বেশি। আফসোস আমরা দুই টাকার কমন সেন্স ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়ে শয়তানের কাজকে খুব সহজ করে দিয়েছি!
এবার আসা যাক কোরআনে কোথাও এর যে নাজিলের মালিক মহাপ্রভু স্রষ্টা, তিনি কি কখনো এটা মুখস্ত করাকেই এর উদ্দেশ্য বলেছে?
যদি কোরআন তিনি কেন নাজিল করেছেন এই প্রশ্ন নিয়ে কোরআনে খুজতে যান, তাহলে পাওয়া যাবে:
- এটা নাজিলের উদ্দেশ্য মানুষকে পথ দেখানো, সমাজকে স্রষ্টার নির্দেশিত মঙ্গলের পথে পরিচালনা করা
- অজ্ঞতা থেকে মানুষকে পরিশীলিত ও কল্যানের পথে নিয়ে আসা
- প্রত্যেক ব্যক্তি যেন নিজেই স্রষ্টার দেখানো সীমানা জেনে নিয়ে সর্বোচ্চ জবাবদিহিতার জায়গায় থেকে জীবন অতিবাহিত করে তার প্রশিক্ষন হিসেবে
- যারা শাসন করবে তারা যেন ন্যায় বিচার সুনিশ্চিত করে ও অন্যায় প্রতিরোধ ও ভালো কাজকে উৎসাহিত করে, পুরস্কৃত করে
- চিরদিনের জন্য ভালোকে ভালো এবং মন্দকে মন্দ হিসেবে চিন্হিত করতে
- সত্য মিথ্যার প্রভেদ অনুসারে তার প্রয়োগ
- মানুষকে সত্য পথে রাখার মানদন্ড হিসেবে
মুখস্ত করা কস্মিনকালেও কোরআন নাযিলের উদ্দেশ্য ছিলো না। বরং কোরআনে স্রষ্টা স্বয়ং রাসুলকে দ্রুত মুখ নাড়াতে মানা করেছেন (জিহ্বা বা মুখ আমরা কখন দ্রুত নাড়ি? মুখস্ত করার জন্য) এবং এর বিপরীতে এটাও বলেছেন যে স্রষ্টা স্বয়ং এর নাযিলকারী, তিনি এর সংরক্ষক এবং এর সামনে ও পিছন থেকে কোন ধরনের মিথ্যা এতে প্রবেশ করবে না, কষ্মিনকালেও করবে না। এবং স্রষ্টার প্রতিশ্রুতি চিরসত্য।
১৬-১৭. ওহী আয়ত্ত / মুখস্ত করার জন্যে তুমি তাড়াতাড়ি জিহ্বা নেড়ো না। এ বাণী সংরক্ষণ ও তেলাওয়াত করানোর দায়িত্ব আমার। ১৮-১৯. অতএব যখন আমি পাঠ করি, তখন তুমি এর শব্দমালা মনোযোগ দিয়ে শোনো। তারপরও মনে রেখো, এর অর্থ সুস্পষ্ট করার দায়িত্ব আমারই। — ৭৫. সূরা কিয়ামা
৯. নিশ্চয়ই আমি এই কোরআন (ধাপে ধাপে) নাজিল করেছি এবং আমি একে রক্ষণাবেক্ষণ করব। — ১৫. সূরা হিজর
মনে রেখো, এ এক মহিমাময় কিতাব। সামনে বা পেছন থেকে কোনো মিথ্যা এতে অনুপ্রবেশ করতে পারবে না। প্রজ্ঞাময় সদাপ্রশংসিত আল্লাহর কাছ থেকে নাজিল হয়েছে এই কিতাব। — ৪১. সূরা হা-মিম-সেজদা
কাগজ আবিস্কার হয়ে যাওয়ার পর, সেই কাগজের যুগ পার হয়ে যে আমরা এখন কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের যুগে ঢুকে গেছি এবং সর্বোপরি স্রষ্টার এই কিতাবের সংরক্ষনের যে সত্য ও প্রমাণিত প্রতিশ্রুতি তা সত্ত্বেও মুর্খের মতো কোটি কোটি সো কলড পথহারা মুসলিম যে কেবল কোরআন মুখস্ত করার পেছনে তাদের যাবতীয় বয়স, সময়, পরিশ্রম খরচ করে ফেলছে এবং ফেলেছে সেটার বদলে এর মাধ্যমে স্রষ্টা কি বলেছেন সেটা বোঝা, জীবন ব্যবস্থার, সমাজ পরিচালনার বিভিন্ন স্তরে সেটার সময়োপযোগি আধুনিক প্রয়োগ কেমন হওয়া উচিত সেটা নিয়ে গবেষণা ও প্রয়োগ করাই কি শ্রেয় নয়?
৬. এ (কোরআন) তিনিই নাজিল করেছেন, যিনি মহাবিশ্বের সকল রহস্য জানেন। তিনি অতীব ক্ষমাশীল, পরমদয়ালু। — ২৫. সূরা ফােরকান
৪১. নিশ্চয়ই এই কোরআনে আমি আমার বাণীকে নানাভাবে বার বার উপস্থাপন করেছি, যাতে করে ওরা এর সত্যতা অনুধাবনের চেষ্টা করে। কিন্তু হায়! কার্যত (সত্য অস্বীকারকারীরা) সত্য থেকে নিজেদের আরো দূরে নিয়ে গেছে। — ১৭. সূরা বনি ইসরাইল
২১. আমি যদি এই কোরআনকে পাহাড়ের ওপর নাজিল করতাম, তাহলে তুমি দেখতে, আল্লাহর ভয়ে পাহাড় নুয়ে পড়েছে, টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। আমি এসব দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছি, যাতে মানুষ চিন্তা করতে শেখে। — ৫৯. সূরা হাশর
১০৫. আমি সত্যের দিক-নির্দেশক হিসেবে কোরআন নাজিল করেছি এবং সত্যসহই তা নাজিল হয়েছে। — ১৭. সূরা বনি ইসরাইল
৪৩. সুতরাং তোমার ওপর যে ওহী নাজিল হয়েছে, তা অনুসরণে অটল থাকো। তুমি সাফল্যের সরলপথেই আছ। ৪৪. নিঃসন্দেহে এই কোরআন তোমার ও তোমার অনুসারীদের জন্যে অত্যন্ত সম্মানের বিষয়। কিন্তু সময় হলে তোমাদেরকে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে (এই কোরআন নিয়ে তোমরা কী করেছ)। — ৪৩. সূরা জুখরুফ
৪৮-৫২. আল্লাহ-সচেতনদের জন্যে এই কোরআন নিঃসন্দেহে এক উপদেশনামা। আমি জানি, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ একে অমান্য করবে। অবশ্যই এই প্রত্যাখ্যান সত্য অস্বীকারকারীদের জন্যে গভীর দুঃখ বয়ে আনবে। কারণ এ কোরআন চূড়ান্ত সত্য। — ৬৯. সূরা হাক্কা
৪৩-৪৪. (হে নবী!) তোমার পূর্বেও ওহীসহ মানুষকেই রসুলরূপে পাঠিয়েছি। তা তোমাদের জানা না থাকলে পূর্ববর্তী কিতাবিদের জিজ্ঞেস করো। তাদের ওপরও সত্যের সুস্পষ্ট প্রমাণসহ কিতাব নাজিল করেছি। আর এখন তোমার ওপর কোরআন নাজিল করেছি, যাতে অতীতে যে সত্যজ্ঞান তাদের ওপর নাজিল হয়েছিল, তা সুস্পষ্টভাবে মানবজাতিকে বুঝিয়ে দিতে পারো। আর মানুষও যেন (চিরায়ত সত্য নিয়ে নতুন করে) চিন্তাভাবনা করার সুযোগ পায়। — ১৬. সূরা আন-নহল
৮২. এরপরও কোরআনকে অনুধাবন করার জন্যে ওরা কি গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হবে না (বা ওদের সহজাত বিচারবুদ্ধিও প্রয়োগ করবে না)? কোরআন যদি আল্লাহর কালাম ছাড়া অন্য কিছু হতো তাহলে অবশ্যই এর মধ্যে অনেক অসঙ্গতি থাকত। — ৪. সূরা নিসা
৫০. এখন (কোরআনের) এই সত্যবাণী ছাড়া আর কোন বাণীতে ওরা বিশ্বাস স্থাপন করবে? — ৭৭. সূরা মুরসালাত