একজন বিশ্বাসীর সোশ্যাল মিডিয়া পলিসি কি হওয়া উচিত? — পর্ব ১
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রকৃত স্বরূপ (reality) হলো গাফলত, পরশ্রীকাতরতা, রিয়া / লোক-দেখানো এবং সময় অপচয়
একজন বিশ্বাসীর দুটো প্রধান বিশ্বাসের স্তম্ভ হলো একজন সৃষ্টিকর্তা ও শেষ দিবস বা মহাপ্রলয়ের জবাবদিহিতা। কোরআনে বিশ্বাসীদের কথা বলতে গিয়ে স্রষ্টা ও আখিরাতে বিশ্বাসী এই টার্মদুটো বারবার এসেছে। একজন মানুষ কতখানি ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা শুকনা আনুষ্ঠানিকতা পালন করে, তার থেকে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সৃষ্টিকর্তা ও শেষ দিবসের জবাবদিহিতা ভুলে না যাওয়া। একটি সমাজে যেমন স্তরে স্তরে জবাবদিহিতার অভাব হলে কি হয় তা বাংলাদেশীদের মতো আর ভালো কে বোঝে? ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি পরম বা সর্বশেষ জবাবদিহিতার স্থান হলো সৃষ্টিকর্তার কাছে। জীবন থেকে জবাবদিহিতা তুলে নেন, যা থাকবে তা হলো Chaos ও Suffering, বিভিন্ন কিসিমের Suffering।
এ ধরনের বিশ্বাসী অবশ্যই তার আখেরাতের অনন্তজীবনকে প্রায়োরিটি দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে চায়। সে জানে তার মৃতু্য চরম বাস্তবতা। এই মৃতু্যর পরই আর আখেরাতের অনন্ত জীবনে প্রবেশ। আর এই দুনিয়ার জীবন খুব সীমিত, দ্রুত প্রবাহমান এবং দেখতে দেখতে মানুষ আসলে সপ্তাহ, মাস, বছর, দশক অত:পর পুরো জীবন শেষ করে ফেলে।
এ কারনেই আমাদের যার বয়স যাই হোক না কেন, একটু ঘুরে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি, ঐতো সেদিন কলেজ শেষ হলো বা ভার্সিটি লাইফ শেষ হলো, ঐ তো সেদিন নতুন বছরের দিনটি শুরু হয়েছিলো, বোঝার আগেই বছর শেষ, বোঝার আগেই আমাদের তারুণ্য আমাদের পেছনে, কারো জন্য বোঝার আগেই গত পাঁচটি, দশটি বছর জীবন থেকে নাই।
সৃষ্টিকর্তা যখন (সাজাপ্রাপ্তদের) জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা পৃথিবীতে কত বছর ছিলে? ওরা বলবে, একদিন বা তার কম সময়। আপনি বরং যারা সময় গণনা করতে জানে, তাদের জিজ্ঞেস করুন।
সৃষ্টিকর্তা বলবেন, আসলে তোমরা খুব অল্প সময়ই পৃথিবীতে ছিলে। (আফসোস! তোমাদের পার্থিব আয়ুষ্কাল যে এত অল্প) একথা যদি সেদিন বুঝতে! তোমরা (কত নির্বোধের মতো) মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনা হবে না। — সূরা মুমিনুন, ২৩: ১১২-১১৪
এই যখন পরিস্থিতি এবং এই দুনিয়ার জীবন, আমরা প্রত্যেকেই বুঝতে পারি যে অতি দ্রুত আমাদের নাগাল থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছে, সেই অবস্থায় একজন বিশ্বাসী, যার কাছে অনন্ত জীবনের গুরুত্ব অনেক বেশি — তার সোশ্যাল মিডিয়ার পলিসি কি হওয়া উচিত? তার সোশ্যাল মিডিয়ার এনগেজমেন্ট কি ধরনের হওয়া কাম্য?
আমরা জানি যে সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুজের জন্ম হয়েছিলো ছেলেরা যেন মেয়েদের হোস্টেলের মেয়েদের ছবি দেখে আমোদ প্রমোদ করতে পারে, মেয়েদের চেহারা নিয়ে স্টাডি করে ভালো লাগা অনুসারে তাদের রেটিং (যা পরে লাইক) দিতে পারে। অনেকটা বখাটে ছেলেরা যেমন মেয়েদের স্কুল কলেজের সামনে দাড়িয়ে বিভিন্ন মেয়েদের দেখতো এবং নিজেদের মধ্যে আলাপ করতো কোন মেয়েটার চেহারা, দেহের গঠন সুন্দর, কারটা অসুন্দর ইত্যাদি — অনেকটা সেটার ভার্চূয়াল ব্যাপার।
সেই থেকে এর নাম দি ফেসবুক। পরে দি ফেলে দিয়ে শুধু ফেসবুক। ফেসবুকের কারনে গড়ে একজন মানুষ দিনে শত শত বার তার স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে নজর দেয়, ঘন্টার পর ঘন্টা কাজের সময় অপচয় করে, অন্যের জীবনের বাছাই করা ছবি দেখে পরশ্রীকাতরা অত:পর হীনমন্যতা ও ডিপ্রেশনে ভোগে।
এখন অবশ্য এ ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া ইন্টেলিজেন্স পাওয়ার জন্য, জনমত যাচাইয়ের জন্য খুব উপযোগী টুলস। সিআইএ, এমআইসিক্সের -এর মতো প্রতিষ্ঠান সরাসরি এ ধরনের প্লাটফর্মকে ব্যাকিং দেয়া থেকে শুরু করে এ থেকে ডাটা ব্যবহার করে; বিভিন্ন দেশের সরকার এখান থেকে গুপ্তচরগীরি করে থাকে। এর বাইরে ডাটা চোরদের কথা তো বাদই দিলাম যা ফেসবুকের থেকে ডাটা নিয়ে নানান হ্যাকিং করে থাকে।
প্রত্যেকের জীবনে চ্যালেঞ্জ আছে। কিন্তু ফেসবুকের চকচকে ছবিতে কেউ কেউ মনে করে তার জীবনটাই বুঝি পানসে, বাকিরা না জানি কত সুখে আছে, প্রত্যেকেই বোধহয় প্রতি সপ্তাহে ফাইভ স্টার হোটেলে খাবার খায় বা সুইমিং করে অথবা তিন মাস পর পর বিদেশে ভ্যাকেশনে কাটায়।
ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মের বিষাক্ততা সম্পর্কে ধারনা করতে স্যাম ভাকনিনের (উনি পৃথিবীর হাতে গোনা সর্বোচ্চ আইকিউ ধারি ইন্টেলেকচুয়াল) এই সাক্ষাৎকারটি অবশ্য পাঠ্য বা শোনা উচিত।
আমাদের এটা ভুলে যাওযা উচিত নয় যে আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যেখানে যা দেখা যায়, বাস্তবতা বা প্রকৃত ঘটনা প্রায়শই উল্টো। সোশ্যাল মিডিয়া এর একটা খুব ভালো উদাহরন। এটি নিজেকে ডাকে “সোশ্যাল মিডিয়া” নামে, কিন্তু এটি মানুষকে ভিষনভাবে আনসোশ্যাল বা অসামাজিক করে তুলছে। টিনএজ ছেলে মেয়েদের স্টাডি করে দেখা যাচ্ছে যে যারা অনেক সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে, এই ১৫ থেকে ২৪ বছরের ছেলে মেয়েরা এখন সামনা সামনি বসে থাকলেও তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন আরেকজনের সাথে কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এরা স্বাভাবিক রিয়েল ওয়ার্ল্ডের সম্পর্ক কেমন হয় তা ভুলে যাচ্ছে। অন্য আরেকজনের সাথে সম্পর্ক তৈরীতে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। বিদেশে ও দেশে দেখা যাচ্ছে লাইন ধরে বন্ধুরা বসে আছে কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বলছে না, প্রত্যেকে ফেসবুক করছে, এমনকি পাশে বসা মানুষটির সাথে কথা না বলে মেসেঞ্জারে হয়তো চ্যাট করছে!
সোশ্যাল মিডিয়া প্রকৃত পক্ষে আনসোশ্যাল অভ্যাস তৈরীতে মানুষকে পুশ করছে।
মোটাদাগে সোশ্যাল মিডিয়ার সমস্যাগুলো
১. এটা মানুষকে আনসোশ্যাল করে, রিয়েল লাইফের বদলে একটা ঘোর লাগা, অবাস্তব ভার্চূয়াল লাইফে মানুষকে আটকে ফেলে।
২. বাস্তব জীবনে একটা মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের সম্পর্কের যে বিশাল ক্ষেত্র তাকে কেবল গুটিকয়েক ইমোটিকনে সীমিত করে।
৩. এটা মূলত হিংসা / পরশ্রিকাতরতা নামক ইমোশনকে উপজীব্যি করে। মাঝখানে যে মিমটি খুব পপুলার হয়েছিলো, “হিংসে হয়..” এটা আসলে খুবই বাস্তব। ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া মানুেষর ভিতরে এনভি বা হিংসাকেই চাঙ্গা করে। মনোবিজ্ঞানের গবেষণা সেটাই বলে।
৪. এটা মানুষকে কম্পালসিভ ব্যবহারে বাধ্য করে যা এডিকশন বা আসক্তিতে রূপ নেয়। একটা সময় পরে ফেসবুক ও ইন্টারনেট ছাড়া জীবন পানসে মনে হয়।
৫. শো-অফ বা লোক দেখানো বিষয়টা এখানে প্রধান নর্ম, লোক দেখানো কৃত্রিম চাকচিক্য ছাড়া লাইক শেয়ার হবে কিভাবে?
৬. মানুষকে বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে। যে মানুষ তার আপন নয়, তাকে মিথ্যা মিথ্যি ফ্রেন্ড বানায়; পরিনতিতে যে মানুষটা আপন সে যথাযথ মনোযোগ হারায়।
৭. অসম্ভব পরিমানে সময় অপচয় করায়। ঘন্টার পর ঘন্টা।
৮. যার ফলে মিনিংফুল কাজ ও অবদান কমে আসে।
৯. বারবার মনোযোগ নষ্ট করে যা একসময়ে পার্মানেন্ট ভাবে এ্যাটেনশন ডেফিজিট ডিজওয়ার্ড বা মনোযোগহীনতার রোগে পরিনত হয় ।কোন কিছুতেই আর লম্বা সময়ে মনোযোগ দেওয়া যায় না। যাবে কিভাবে? ক্রমাগত স্ক্রল করতে করতে ওটাই তো অভ্যাসে পরিনত হয়েছে? একটু বেশি সময় ধরে কোন কিছু করা তখন অসম্ভব।
১০. মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায অন্যের চকচকে মেকি ছবি দেখে অনেকের মধ্যে অসুখী প্রবণতা বাড়ে। এটা পরশ্রিকাতরার অবশ্যম্ভাবি পরিণতি। ডিপ্রেশন এবং টিনএজ সুইসাইডের সাথে বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের সরাসরি যোগসুত্র অনেক স্টাডিতে প্রমাণিত। স্যাম ভাকনিনের ইন্টারভিউতে বিস্তারিত পাবেন।
যেহেতু আপনি এটা সোশ্যাল মিডিয়ায়ই পড়ছেন, আমি ধরে নেবো আপনি হয়তো এতক্ষনে হাপিয়ে উঠেছে। কারন এটা তো আর ২ লাইনের স্ট্যাটাস না যে লাইক দিয়ে পালিয়ে যাবেন এবং নতুন স্ক্রল করা শুরু করবেন। আপনার মনোযোগের জন্য আপনাকে অভিনন্দন।
একজন বিশ্বাসী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তির সোশ্যাল মিডিয়া পলিসি কি হওয়া কাম্য তা লেখাটির ২য় পর্বে পড়তে পারবেন।
________________
Few Useful Resources:
Ehmke, Rachel. “How Using Social Media Affects Teenagers | Child Mind Institute.” Child Mind Institute. N.p., n.d. Web. 16 Dec. 2016.
Feiler, Bruce. “For the Love of Being ‘Liked’.” The New York Times. The New York Times, 2014. Web. 16 Dec. 2016.
Jung, Brian. “The Negative Effect of Social Media on Society and Individuals.” The Negative Effect of Social Media on Society and Individuals | Chron.com. N.p., n.d. Web. 16 Dec. 2016.
Ramasubbu, Suren. “Influence of Social Media on Teenagers.” The Huffington Post. TheHuffingtonPost.com, 26 May 2015. Web. 16 Dec. 2016.
Steiner-Adair, Catherine, and Teresa Barker. The big disconnect: protecting childhood and family relationships in the digital age. New York: Harper, 2013. Print.
Udorie, June Eric. “Social media is harming the mental health of teenagers. The state has to act | June Eric Udorie.” Opinion. Guardian News and Media, Sept. & oct. 2015. Web. 16 Dec. 2016.
Wick, Donna. “Social Media and Social Anxiety.” Mind to Mind Parent. N.p., n.d. Web. 16 Dec. 2016.