প্রধানমন্ত্রীর পরিবার চালিত প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করা নিয়ে ইউএনডিপি’র সাফাই

Netra News
Netra News
Published in
4 min readNov 19, 2020
সিআরআই-এর ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া স্ক্রিনশট, যেখানে দেখা যাচ্ছে ইউএনডিপি এবং সিআরআই-এর মধ্যকার এমওইউ সাক্ষর অনুষ্ঠানের ছবি। ওপরের ছবিতে সিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক সাব্বির বিন শামসের সঙ্গে ইউএনডিপি’র আবাসিক সমন্বয়ক (বামে)। নিচের ডান পাশের ছবিতে আছেন রাদওয়ান সিদ্দিক।

[২৩ অক্টোবর ইংরেজি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত।]

কিছুদিন আগে নেত্র নিউজ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল যে অত্যন্ত পক্ষপাতমূলক আওয়ামীপন্থী সংগঠন ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন’ (সিআরআই) এর ম্যাগাজিন প্রকাশনায় সংশ্লিষ্ট হওয়াটা ব্র্যাক এর নির্বাহী পরিচালকের জন্য কতখানি যথার্থ। সম্প্রতি ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক সিআরআই প্রকাশিত একটি নতুন ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের দুই সদস্য এই সিআরআই পরিচালনা করেন- একজন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং অন্যজন হাসিনার ভাগ্নে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। যুক্ত আছেন ববির বোন আজমিনাও। (নিবন্ধটি প্রকাশের পর ব্র্যাক নেত্র নিউজকে জানায় যে ব্র্যাক আর কখনো “[নেত্র নিউজের] কোন জিজ্ঞাসার জবাব দেবেনা।” পরবর্তীতে অবশ্য তারা এই হুমকি প্রত্যাহার করে।)

তবে এর চেয়েও হতবাক হবার মতো ঘটনা সম্ভবত গত সপ্তাহে উদ্বোধন করা ‘উইমেন্স সেইফটি ইন পাবলিক প্লেইসেস’ (জনসমাগমস্থলে নারীর নিরাপত্তা) নামক প্রকল্পে সিআরআই এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) একত্রে কাজ করা।

জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সব ধরনের সরকারের সাথেই কাজ করতে হয়। কিন্তু তারা সাধারণত অতিমাত্রায় পক্ষপাতদুষ্ট সরকার দলীয় কোন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেনা (নিঃসন্দেহে করা উচিতও নয়)। নিরুপায় হলে কিংবা বিরোধীদলের সমর্থক একই ধরনের কোন সংগঠনের সাথে কাজ করলে ভিন্ন কথা।

কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এক্ষেত্রে ইউএনডিপি’র এমনটি করার কোনো দরকার ছিলো না।

ইউএনডিপি যদি নারী ও তরুণদের নিয়ে কাজ করতে চাইতো তাহলে তারা বাংলাদেশের নিরপেক্ষ বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠানের মধ্যথেকে যেকোনোটিকে বেছে নিতে পারতো- যাদের উভয় ইস্যুতে কাজ করার অভিজ্ঞতা সিআরআই-এর তুলনায় অনেক বেশি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী শাসক পরিবারের দুজন সদস্যের দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পার্টনারশিপ যে ইউএনডিপি’র নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন করে তা কি জাতিসংঘের এই সংস্থা বুঝতে অপারগ?

তারওপর আওয়ামী লীগ এই উদ্যোগকে ব্যবহার করেছে প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে বাংলাদেশী নারীদের পরিত্রাতা হিসেবে উপস্থাপন করতে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুতুল ছিলেন প্রধান বক্তা।

সিআরআই-এর প্রধান ট্রাস্টি রাদওয়ান সিদ্দিক ইউএনডিপি’র কৌশলগত পরামর্শক স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভাইজার (গভর্নেন্স)* এবং কয়েক বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির জন্য কাজ করছেন। এ কারণেই হয়তো ইউএনডিপি নিজেদের নৈতিকতার বিষয়টি ভুলে গেছে। সিদ্দিকের মত ব্যক্তিকে ইউএনডিপিতে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি সেই শুরু থেকেই বেমানান ঠেকছিলো। কারণ তাঁর পক্ষপাত এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার। কিন্তু নিয়োগ দেয়ার পর এখন আবার সিদ্দিক পরিচালিত রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক সংগঠনের সাথে সমঝোতা চুক্তির (মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং) ঘটনা নির্দেশ করছে ইউএনডিপি এবং সিদ্দিক উভয়ে স্বার্থের সংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) তৈরির মত অবস্থায় উপনীত হয়েছেন।

নিজেদের একজন পরামর্শক দ্বারা পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে এতটা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা ইউএনডিপি’র জন্য কতটা সমিচিন?

জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা অনানুষ্ঠানিকভাবে (অফ দ্য রেকর্ড) নেত্র নিউজকে বলেন যে, এই দুই সংগঠনের মধ্যে পার্টনারশিপের ঘটনায় ‘বিস্মিত’ হয়েছেন। আরেক কর্মকর্তা বলেন, “সিআরআই-এর সাথে কাজ করা যেতে পারে যদি অন্যান্য মতের সংগঠনের সাথেও একইভাবে কাজ করে সামঞ্জস্য রক্ষা করা হয়। কিন্তু সেটি তো হচ্ছে না।” তিনি আরও বলেন: “সিদ্দিককে ইউএনডিপি’র বেতনভুক্ত রাখা এবং একইসাথে সিআরআই-এর সঙ্গে কাজ করা অস্বাভাবিক।”

সিআরআই কে পরিচালনা করছে সে প্রশ্নটি না হয় বাদই দিলাম। তারপরও এটা বোঝা মুশকিল যে ইউএনডিপি’র হিউম্যান রাইটস্ প্রোগ্রাম কেন সিআরআই-এর মতো একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে চাইবে- যার সামগ্রিক উদ্দেশ্যই হলো বর্তমান সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো কমিয়ে দেখানো বা আড়াল করা। নিঃসন্দেহে এমন একটি প্রতিষ্ঠান ইউএনডিপি’র হিউম্যান রাইটস্ প্রোগ্রামের সঙ্গে কাজ করার উপযুক্ত অংশীদার নয়।

নেত্র নিউজ ইউএনডিপি’র কাছে বিষয়টির ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিল। তারা জানিয়েছে:

“কারও সাথে কোনো অংশীদারিত্বে যাওয়ার আগে আমরা ইউএনডিপি’র জন্য বৈশ্বিকভাবে প্রযোজ্য নিরীক্ষা পদ্ধতি প্রয়োগ করি, যা একটি কঠোর যাচাই প্রক্রিয়া এবং এর ফলাফল সন্তোষজনক হলেই কেবল ইউএনডিপি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পার্টনারশিপ করে, যেখানে উদ্দেশ্য থাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিস্তৃত পরিসরে যোগাযোগ স্থাপন। এক্ষেত্রে সিআরআই-এর সাথে আমাদের পার্টনারশিপ হয়েছে তরুণদের কাছে পৌঁছে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে, কোনো রাজনৈতিক তাড়নায় নয়।”

কিন্তু ইউএনডিপি’র নিজস্ব দলিল ‘ম্যানেজিং পার্টনারশিপস্’ এ বলা আছে, কোনো বেসরকারি সংগঠনের সাথে অংশীদারিত্বে যাওয়ার আগে জাতিসংঘের নিরপেক্ষতা ভঙ্গ কিংবা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে কি-না (রেপুটেশনাল কম্প্রোমাইজ ইনক্লুডিং ইউএন নিউট্রালিটি) সেই ঝুঁকিও বিবেচনা করতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সিআরআই-এর সঙ্গে পার্টনারশিপ গড়ার ক্ষেত্রে ইউএনডিপি সম্ভবত এ বিষয়টি যথাযথভাবে বিবেচনা করেনি।

ইউএনডিপি আরও জানায়, তারা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুবাদে সিআরআই-এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি এসেছে, যেহেতু মানবাধিকার কমিশন সিআরআই-এর সঙ্গে কাজ করছিলো।

“আমাদের হিউম্যান রাইটস্ প্রোগ্রাম (এইচআরপি) বাংলাদেশের বিদ্যমান মানবাধিকার কাঠামোর সামর্থ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে দীর্ঘদিন যাবত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) সঙ্গে কাজ করে আসছে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রাথমিক আগ্রহ হলো নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে দেশব্যাপী তারুণ্য-নির্ভর একটি ক্যাম্পেইনে এনএইচআরসি’র নেতৃত্বকে সহায়তা দেয়া। যা যৌথভাবে সিআরআই-এর যুব প্ল্যাটফর্ম ‘ইয়ুথ-বাংলা’ এবং ইউএনডিপি এইচআরপি’র যুব প্ল্যাটফর্ম ‘যুব-বাংলা’ পরিচালনা করবে। আমাদের হিউম্যান রাইটস্ টিম জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত।”

নিশ্চয়ই এখানে আরও একটি প্রশ্ন জাগে যে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তো নিরপেক্ষ থাকবার কথা; তারাই বা কেন সিআরআই-এর সঙ্গে কাজ করছে। দুর্ভাগ্যজনক হলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশন মোটেও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান নয় এবং এই প্রতিষ্ঠান থেকে ভাল কিছু আশা করাও যায় না।

বাংলাদেশে স্বাধীন মত প্রকাশের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের একটি বিপরীতমুখী পরিণতি হলো- এর থেকে কেবল সরকার লাভবান হচ্ছে না; বরং ইউএনডিপি’র মতো প্রতিষ্ঠান যারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হোক চায় না, তারাও সুবিধা ভোগ করছে। ইউএনডিপি ভাল কাজ করে এবং সন্দেহ নেই যে প্রতিষ্ঠানটি মহৎ উদ্দেশ্যসম্পন্ন লোকে ভরপুর। কিন্তু ব্র্যাক এবং ইউএনডিপি’র মতো প্রতিষ্ঠানকে গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে আরও অনেক বেশি নজরদারি এবং জবাবদিহিতার মধ্যে রাখা উচিত, যা এ মুহূর্তে হচ্ছে না।

*ইউএনডিপি’তে রাদওয়ান সিদ্দিকের আনুষ্ঠানিক পদবিটি তাঁর লিঙ্কড ইন পেজ থেকে হালনাগাদ করা হয়েছে।

// ডেভিড বার্গম্যান

নেত্র নিউজের মূল ওয়েবসাইট দেখুন
বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য
বাংলাদেশের বাইরের পাঠকদের জন্য
ইউটিউব চ্যানেল

--

--

Netra News
Netra News

Netra News - a new independent and impartial online media platform publishing investigations, analysis, and opinion on Bangladesh politics and society