একজন বিশ্বাসীর সোশ্যাল মিডিয়া পলিসি কি হওয়া উচিত? — পর্ব ২
জীবনের সবচেয়ে দামী currency-এর নাম হলো সময়। কোন বুদ্ধিমান ও সচেতন ব্যক্তি কখনো ভার্চূয়াল দিয়ে তার আসল জীবনের সময় নষ্ট করে না
এই বিশ্বাসী কেবল কোন বিশেষ ধর্মের বিশ্বাসী নয়, বরং একজন বুদ্ধিমান, সচেতন এবং সৃষ্টিকর্তা ও মহাপ্রলয়ের পর (আখিরাত) জবাবদিহিতায় যে বিশ্বাস করে তাকে বিশ্বাসী বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
১. যথাসম্ভব শো-অফ বা রিয়া পরিহার করা
লোক-দেখানো পোস্টিং থেকে বিরত থাকা। অন্যে দেখুক — এটা কপটচারিতাকে উৎসাহিত করে। যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়া একটা ভার্চূয়াল পরিবেশ তাই রিয়ার কোন লিমিট থাকে না। আগের পোস্টের চাইতে আজকের পোস্টে আরো বেশি লাইক পাইতে হবে, এই বিষয়টাই এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে শোয়িং অফ এনকারেজ করতে থাকে যার কোন লিমিট নাই। কোনে নিজের অজান্তেই ধীরে ধীরে বেশি শো-অফে ঢুকে যেতে থাকে।
লেট আস নট শো-অফ অন সোশ্যাল মিডিয়া।
যে নিজেকে অযাচিত বা কপটভাবে সন্মানিত করার চেষ্টা করে, সৃষ্টিকর্তা, The Great Equalizer, তাকে আজ হোক কাল হোক তার প্রকৃত অবস্থা উন্মোচন করে অসন্মানিত করে, আর যে নিজেকে বিনয়ি রাখে, সৃষ্টিকর্তা তার সন্মান বৃদ্ধি করে।
আপনি কোন দামী রেস্টুরেন্টে কি খেয়েছেন সেই খাবারের ছবি দেখানোর কিছু নাই। বরং ঐ রেস্টুরেন্টের দরজার বাইরে যে ক্ষুধার্ত ব্যক্তি আছে তার জন্য একটা বনরুটি আর কলা কিনে তাকে গোপনে দিলে সেটা অনেক শ্রেয়। দামী খাবারের ছবিও একটা বাজে শো-অফের মধ্যে পড়ে।
২. ভালো কথা, কাজ প্রচার করুন। খারাপ কথা ও কাজ যথাসম্ভব প্রচারে বিরত থাকা
আল্লাহ কোনো মন্দ কথার প্রচারণা পছন্দ করেন না। তবে কারো ওপর অন্যায় হয়ে থাকলে, সে তা বলতে পারে। আল্লাহ (মজলুমের) সব (কথা) শোনেন, (জালেমের) সব (কিছুই) জানেন। — ৪. সূরা নিসা,১৪৮
৩. সোশ্যাল মিডিয়া অথবা অন্য যেকোন প্রযুক্তিকে ভালো কাজে ব্যবহার করে উপকৃত হওয়া
চাকু, চাকা বা কলমের মতো প্রযুক্তি একটি টুলস বা যন্ত্র। চাকু দিয়ে দরকারী কাজ করা যায়, আবার অন্যকে খুনও করা যায়। যেকোন প্রযুক্তি ভালো কাজে ও মন্দ কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। Technology ভালোকাজে ব্যবহারে করে উপকৃত হওয়া পদ্ধতি, উপায় খুঁজুন, পেয়ে যাবেন।
আপনার যে বিষয়ে জানার ও শেখার আগ্রহ আছে, ইউটিউবে আমি নিশ্চিত সে বিষয়ে যেমন অনেক টিউেটোরিয়াল রয়েছে তেমনি অনলাইনে নানান ধরনের ফ্রি ও পেইড কোর্স আছে যা থেকে সত্যিকারের উপকার সম্ভব। বুদ্ধিমান ও সচেতন ব্যক্তির এই অসম্ভব সম্ভাবনাময় প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারে সচেষ্ট থাকাই কাম্য।
৪. অনর্থক কিছু নয়
বিশ্বাসীরাই প্রকৃত সফল। … যারা অনর্থক কথা ও ফালতু কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখে। — ২৩. সূরা মুমিনুন
৫. অতিরিক্ত ছবি দেওয়া থেকে বিরত থাকা
ছবির মাধ্যমে মানুষ হারিয়ে যাওয়া সময় বা মুহুর্তকে ধরে রাখতে চায়। আপাত দৃষ্টিতে এই ধরে রাখতে চাওয়ার মধ্যে কোন অন্যায় নেই। হাজার হলেও ঐ মুহুর্তগুলোই তার জীবনের অংশ। কিন্তু যখন ছবি তোলাটা কম্পালসিভ ইম্পালসে পরিণত হয়, তখন মানুষ আসলে মিথ্যা বাস্তবতা (false reality) -কে প্রকৃত বাস্তবতার উপরে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। প্রকৃত বাস্তবতা হলো সময় কারো জন্য ফ্রিজ হয়ে থাকে না, ছবির ফ্রেম ফ্রিজ হলেও। সেলফি ক্যামেরা আপনার চেহারায় যে এফেক্ট দিয়ে স্মুথ করে, প্রকৃত বাস্তবতায় সেই এফেক্ট নেই। সুতরাং মেকি সেই রিয়েলিটিকে কম্পালসিভ ইম্পালসে পরিণত করা আর একজন ব্যক্তি যে মিথ্যা কথা বলতে বলতে এতটাই মজা পায় যে তার কাছে সত্য কথা পানসে লাগে — অনেকটা সেদিকে টার্ন নেয়। এ ধরনের কম্পালসিভ মিথ্যাবাদির সব কথা তিন চারগুন বাড়িয়ে বলাই এক সময়ে স্বভাবে পরিণত হয়।
একজন বিশ্বাসী যে সত্যের অনুসারি, সে সময়ের বহমানতা অস্বীকার করবে না, সে বাস্তবতা যেরকম তা থেকে বাড়িয়ে মেকি ভাবে বাস্তবতার উপস্থাপনকে জীবনের লক্ষ্য করবে না। শো-অফ করার সকল প্রবণতা (যা ছবির মাধ্যমে সবচেয়ে প্রকট) পরিত্যাগ করবে। সেই অনুসারে একজন বিশ্বাসীর সোশ্যাল মিডিয়ায় তার বা তার আপনজনের ছবি মিনিমাল পোস্টানো বা একদম না পোস্টানোই পলিসি হওয়া উচিত।
৬. অনুমান ভিত্তিক গুজব ছড়ানোয় নিজে জড়িত না হওয়া
যে বিষয় ভেরিফায়েবল নয়, সে ধরনের গসিপ, ফেক নিউজ, বানোয়াট খবর, কুৎসা ছড়ানোর মধ্যে না যাওয়া।
হে বিশ্বাসীগণ! কোনো ফাসেক (দুরাচারী, মিথ্যার পূজারী) তোমাদেরকে কোনো খবর বা তথ্য দিলে অবশ্যই তার সত্যাসত্য যাচাই করবে। তা না হলে (হুজুগে পড়ে) কোনো জনগোষ্ঠীর ক্ষতিসাধন করে ফেলতে পারো। পরে তোমরাই অনুতপ্ত হবে। — সূরা হুজুরাত, ৪৯.৬
তোমাদের ওপর আল্লাহর করুণা ও দয়া না থাকলে এ পাপের জন্যে দুনিয়া ও আখেরাতে কঠিন আজাব তোমাদের গ্রাস করত। তোমরা কানাঘুষা করে মুখে মুখে এসব কথা বলে বেড়াচ্ছিলে, যে-বিষয়ে তোমরা কিছুই জানো না। তোমরা বিষয়টিকে খুব সাধারণভাবে নিয়েছিলে কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে এ ছিল গুরুতর অন্যায়। — সূরা নুর, ২৪.১৪-১৫
যে-বিষয়ে তোমার যথাযথ জ্ঞান নেই, সে-বিষয়ে (শুধু শোনা কথায় আন্দাজ-অনুমানের ওপর ভিত্তি করে) কখনো নিজেকে জড়াবে না। (মহাবিচার দিবসে) তোমার কান, চোখ ও মনকে জবাবদিহিতার জন্যে ডাকা হবে। — সূরা বনি ইসরাইল, ১৭.৩৬
৭. অন্যকে হেয় না করা
হে বিশ্বাসীগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে উপহাস বা বিদ্রুপ না করে, কারণ উপহাসকারীর চেয়ে সে ভালো হতে পারে এবং কোনো নারী যেন অপর কোনো নারীকে উপহাস বা বিদ্রুপ না করে, কারণ উপহাসকারিণীর চেয়ে সে ভালো হতে পারে। (সাবধান!) তোমরা একে অপরের বদনাম কোরো না। মন্দনামে ডেকো না। মন্দনামে ডেকে একে অন্যকে অপমান কোরো না। বিশ্বাস স্থাপন করার পর মন্দনামে ডাকা অতিগর্হিত কাজ। (এ ধরনের গর্হিত কাজ করার পর) যদি তওবা না করে, তবে তারা নিঃসন্দেহে সীমালঙ্ঘনকারী জালেম। — সূরা হুজুরাত ৪৯.১১
৮. সামাজিকভাবে উপকারী ভালো কাজে যুক্ত থাকার জন্য
সোশ্যাল মিডিয়ার সবেচয়ে কার্যকর কাজ হলো অন্যের সাথে প্রয়োজনীয় যোগাযোগের জন্য ব্যবহার। অর্থাৎ পূর্বের ডাক চিঠি, তারপর ফ্যাক্স, ইমেইল — এর এক্সটেনশন হিসেবে যারা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যোগাযোগ করেন তাদের ব্যবহার অপটিমাম।
অপরিচিত কেউ কি খেলো, ডিনারে কি না খেলো, সেটাতে লাইক দেওয়াকে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ বলা যায় না।
ভালো কাজে যুক্ত হওয়া, যেমন ১ টাকায় আহার, মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, পথ শিশুদের জন্য স্কুল, ১০ টাকায় বাসস্থানের মতো হাজার রকম চমৎকার সামাাজিক উদ্যোগ আছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, যে ধরনের কাজ সম্পর্কে জানতে ও তাতে যুক্ত হওয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া খুব ভালো মিডিয়াম। একজন বিশ্বাসী সৎকর্মে অন্যদের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার খুব অপটিমাম ভাবে করতে পারে।
এতো গেলো সব ভারী ভারী বিষয়। এখন সহজ বিষয়ে আসি। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহৃত হতে পারে মজা করার জন্য, আনন্দ ও কৌতুকের জন্য এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা কিন্তু নিজেকে নিয়েই বেশি কৌতুক করে। অন্যকে হেয় না করে, নিজের ছোট খাট ভুল ও দোষ ত্রুটি নিয়ে কৌতুক করা ও অন্যকে আনন্দ দেওয়া শ্রেয়। অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে স্ট্রেস কাটানোর জন্য ছোট ছোট ব্রেকে। সেটা যেন কম্পালসিভ বিহেভিয়ারে পরিণত না হয় অর্থাৎ আপনি যেন সোশ্যাল মিডিয়ার দাসে পরিণত না হন। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার যেন নেশায় পরিণত না হয়।
আপনার ব্যক্তিগত সোশ্যাল মিডিয়া পলিসি কি?